কানাডায় হেমন্ত, টিকা এবং ফটো-আইডি

শীতপ্রধান দেশগুলোতে ঋতু আসলে দুটো। গ্রীষ্ম আর শীত। গ্রীষ্ম আর শীতের মধ্যখানে আরও দুটো ছোট্ট ঋতু আছে, তাদের বলা যায় ক্ষণিকা, ক্ষণকালের অতিথি, সামারের পর আর উইন্টারের আগে আসে ফল-এফ এ এল এল, হেমন্ত, পাতাঝরার কাল। শীতের শেষে যখন তুষারপাত বন্ধ হবে, একটু একটু করে বাড়বে তাপমাত্রা, শুকনো ডালে আবার আসবে সবুজ পাতা। সেই বসন্তের প্রথম কিশলয় ওই সব অঞ্চলের মানুষের মনে আনবে সত্যিকারের ফুর্তি। আর তুষারপাত ঘটবে না, আর থাকতে হবে না ঘরবন্দী। এসে গেল মুক্তির দিন।

শীতে প্রায় সব গাছের পাতা যাবে ঝরে, কঙ্কালের হাতের মতো কতগুলো ন্যাড়া শাখা–প্রশাখা দাঁড়িয়ে থাকবে গাছে গাছে। পাতাঝরার আগে গাছে গাছে পাতায় পাতায় লাগবে আগুন। পাতা হলুদ হবে, লাল হবে, বেগুনি হবে, কমলা হবে, খয়েরি হবে। কানাডার জাতীয় পতাকার মধ্যে যে লাল পাতাটা আছে, সেটা ম্যাপলগাছের; আর ওই লাল রংটা ম্যাপলপাতা পাবে কেবল হেমন্তে। এদের ভাষায় ‘ফলে’।

এই সেপ্টেম্বরে ক্যালেন্ডারে হেমন্ত শুরু হয়ে গেছে। গাছে গাছে পাতারা হলুদ হতে শুরু করেছে। কিন্তু আসল ফল-কালার বা হেমন্তের রং দেখা যাবে অক্টোবরের মধ্যভাগে। ২৬ বছর আগে আমেরিকার কলারাডো স্প্রিংসে গিয়েছিলাম পাতায় পাতায় রঙের আগুন দেখতে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে আমাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন চক এসি, গেজেট টেলিগ্রাফ পত্রিকার কার্টুনিস্ট। প্যারাডাইস গার্ডেন নামের সেই স্বর্গের বাগানটির সৌন্দর্য এখনো চোখে লেগে আছে। আর কোনো দিনও কলারাডো স্প্রিংস যাইনি, সেই পত্রিকাটি আর নেই, কার্টুনিস্ট কোথায় আছেন, কেমন আছেন, জানি না। আইওয়াতে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ছিলাম ২০১০ সালে, তখন কি হেমন্তের পাতাঝরার রংবাহার দেখেছিলাম! এখন মনে পড়ছে না!

এবার এসেছি কানাডায়। প্রথমে টরন্টো, তারপর এডমন্টন, তারপর আবার টরন্টো, সেখান থেকে মন্ট্রিয়ল। ১৮ দিনে তিন রাজ্যের তিন শহরে। সাইফুল আর মুক্তার কল্যাণে মুক্তার ড্রাইভিংয়ে গাড়ি ছুটিয়ে একবার ওয়াটারলু, একবার ব্লু মাউন্টেন। এডমন্টন থেকে বুয়েটের আর্কিটেক্ট শাহিন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাব্বিরের গাড়িতে চড়ে আলবার্টার পাহাড় আর সরোবরশোভিত পথে ছুটে চলা আব্রাহাম লেকের দিকে। আব্রাহাম লেক এক আশ্চর্য হ্রদ, যেখানে পানির রং গাঢ় ফিরোজা। গাড়ির জানালা দিয়ে আমার তৃষিত চোখ খোঁজে ফল-কালার, হেমন্তের রং। একটুখানি হলুদ পেলেই চিৎকার করে উঠি, মেরিনা, ওই গাছটা দ্যাখো। ২৮ সেপ্টেম্বর মন্ট্রিয়ল থেকে জিয়া ভাই আর রানা আপার সঙ্গে মন্ট টারব্লাঁ গিয়ে মনে হলো, এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য বোধ হয় আর কখনো দেখিনি। দুই পাশে উঁচু পাহাড়, সবগুলো পাহাড়ই গাছে ঢাকা, আর সবগুলো গাছেই রং এসেছে, লাল, হলুদ, কমলা, গোলাপি, বেগুনি, খয়েরি ও সবুজ। কেবল-কারে চড়ে পাহাড়ের ওপরে উঠতে উঠতে নিচে তাকিয়ে দেখি পাহাড়ের ঢেউ, এক পাশে একটা শান্ত সরোবর, আর সবখানেই রং আর রং। রানা আপা মুঠোফোনে গান চালালেন ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও...যাওয়ার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও।’ মেরিনা ঝরাপাতার ছবি তোলে, আমি গুনগুন করে গান করি ‘ঝরাপাতা গো আমি তোমারই দলে...’।

আমরা কানাডা থাকতে থাকতেই নতুন নিয়মের বার্তা এল মুঠোফোনে, এখন থেকে রেস্তোরাঁয় বসতে হলে করোনার দুটো টিকা নেওয়ার প্রমাণ দেখাতে হবে। টিকার সনদ আর ফটো-আইডি। আমাদের টিকার সনদ মুঠোফোনে স্ক্রিনশট নিয়ে রেখে দিয়েছি। ছবিসমেত পরিচয়পত্রও রাখি সর্বদা সঙ্গে। যখন বড় দলে চলি, দেখা যায়, কারও টিকার সনদ নেই, কিংবা কারও ফটো-আইডি দূরে পার্ক করা গাড়িতে। সব সময় রেস্তোরাঁয় তাই বসা হয় না। রেস্তোরাঁর গেটে কর্মচারীরা খুবই সতর্ক, টিকার সনদের নামের সঙ্গে পরিচয়পত্রের নাম মিলিয়ে দেখে মুখের দিকে তাকান ছবি আর চেহারা মিলছে কি না, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেন। না মিললে রেস্তোরাঁয় বসার অনুমতি মেলে না। খদ্দেরদের বিদায় করতে তাঁদের ভালো লাগে না, কিন্তু হাজার ডলার জরিমানার ভয়ে তাঁরা সদা নিয়মনিষ্ঠ।

এত কড়াকড়ির কারণ হলো, দুটো টিকা নিতে নাগরিকদের উৎসাহিত করা। করোনারোধী টিকা নিয়ে ফেরিওয়ালারা ঘুরছেন, ‘টিকা নিন, টিকা নিন’। কিন্তু এই সব দেশের রক্ষণশীলেরা সেই রকম রক্ষণশীল। টিকা নেবেন না তাঁরা। তাঁরা করোনাতেই বিশ্বাস করেন না। আবার টিকা! কেউ কেউ মনে করেন, টিকার সঙ্গে শরীরে চিপস ঢুকিয়ে দেবে, তারপর গতিবিধির ওপরে নজর রাখা হবে। এদিক থেকে বাংলাদেশের মানুষ অনেক বেশি প্রগতিশীল। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা নিচ্ছেন তাঁরা।

ফটো-আইডি বা ছবিসহ পরিচয়পত্র নিয়ে একটা কৌতুক মনে পড়ে গেল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, আইনস্টাইন আর পাবলো পিকাসো একটা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। দ্বাররক্ষী বলছে, ‘ফটো-আইডি, প্লিজ।’ তিনজনের কেউই পরিচয়পত্র আনেননি।

আইনস্টাইন বললেন, ‘আমি বিজ্ঞানী আইনস্টাইন। আমাকে ঢুকতে দিন।’

দ্বাররক্ষী বললেন, ‘আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে? আপনি একটা কিছু লিখে দিন, যাতে আমি বুঝতে পারি, আপনি আইনস্টাইন।’

আইনস্টাইন লিখলেন, ‘ই ইকুয়াল টু এম সি স্কয়ার।’ সই করলেন। দ্বাররক্ষী খুশি, ‘আপনি মহান আইনস্টাইন, আপনি প্রবেশ করুন।’

পিকাসো একটানে শান্তির কপোত এঁকে সাইন করে দিলেন। দ্বাররক্ষী খুশি মনে পিকাসোকে ভেতরে ঢুকতে দিলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এগিয়ে গেলেন। আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, ‘আমি কোনো প্রমাণ দিতে পারব না।’

দ্বাররক্ষী বললেন, ‘এর আগে আইনস্টাইন আর পিকাসো নিজেদের পরিচয়ের প্রমাণ দিয়েই ভেতরে ঢুকেছেন। আপনাকেও প্রমাণ দিতে হবে।’

ট্রাম্প বললেন, ‘আইনস্টাইন আর পিকাসো! এঁরা কারা?’

দ্বাররক্ষী বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি, আপনিই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, আপনি ভেতরে ঢুকতে পারেন।’

আমেরিকায় যাঁরা টিকা নিতে চান না, তাঁদের বেশির ভাগই ট্রাম্পের অনুসারী। তাঁরা নাকি বিশ্বাস করেন, ট্রাম্প এখনো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এবং বিশ্বাস করেন করোনা বলে কিছু নেই।

কানাডা থেকে আমেরিকা যাচ্ছি। বিমানবন্দরের গেটে বসে আছি। এইবার কিন্তু আমাদের কাছ থেকে টিকার সনদ দেখতে চাওয়া হলো না। করোনা নেগেটিভ সনদ দেখিয়েছি। টিকার সনদ দেখাতে হলো না, কারণ আমেরিকানদের আপনি টিকা দিতে বাধ্য করতে পারেন না। টিকা না নেওয়ার অধিকার আমেরিকায় নাগরিক অধিকার।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক