কাবুল তালেবানের কবলে গেলেই গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে

পশ্চিমা বাহিনী সড়ে যাওয়া মাত্র কাবুল দখলে নেওয়ার অপেক্ষায় তালেবান বাহিনী।
ফাইল ছবি: এএফপি

২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে আসা যুক্তরাষ্ট্র আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেখান থেকে তার সব সেনা গুটিয়ে নেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধ শুরু করেছিল, গত ২০ বছরে তার কোনোটির বিষয়েই তারা সফল হতে পারেনি। তথাকথিত এ সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে তারা না পেরেছে সেখানকার সন্ত্রাসীদের শেষ করে দিতে, না পেরেছে তালেবানকে ধ্বংস করতে। এত প্রাণহানি, এত সম্পদ ক্ষয় ও এত সামাজিক বিপর্যয়ের মূল্য হিসেবে শেষ পর্যন্ত তালেবান ও সন্ত্রাসবাদীরাই আফগানিস্তানের পূর্ণ ক্ষমতায় আসার আশঙ্কাকে জোরালো করেছে।

আফগানিস্তানে মূলত দুটি আদলে যুদ্ধ চলমান আছে। প্রথমটি হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোট বাহিনীর সঙ্গে তালেবানসহ সব ধরনের পশ্চিমাবিরোধী শক্তির যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর বাহিনীর সঙ্গে অবশ্যই আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির জোট আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর বাহিনী সরে গেলে এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে।

তালেবান আবার ক্ষমতায় এলে তারা ইটিআইএমের সঙ্গে জোট বেঁধে চীনকে দুশ্চিন্তায় ফেলবে—এ ভাবনা থেকে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের পুনরুত্থানে আপাতত বাধা দিতে চাইবে না

দ্বিতীয় যে যুদ্ধটি সেখানে চলমান আছে, সেটি হলো পশ্চিমাদের মদদপুষ্ট আশরাফ গনি সরকারের অনুগতদের সঙ্গে তালেবানের গৃহযুদ্ধ। আফগান সরকারের বাহিনীর সঙ্গে তালেবানের এ গৃহযুদ্ধ দশকের পর দশক চলে আসছে। এর শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত।

প্রথমোক্ত আদলের যুদ্ধের পরিসমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে পুরো মাত্রায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। কারণ, গৃহযুদ্ধ অবসানে আশরাফ গনির সরকার এবং তালেবান কিছুতেই জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনে রাজি নয়। দুই পক্ষের সমঝোতায় পৌঁছানো যায় কি না তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে কাতারে যে বৈঠক হয়েছিল, সেখানেও কোনো সমঝোতা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহারের সুনির্দিষ্ট কোনো পথরেখাও তৈরি করেনি।

ইতিমধ্যে আফগান ন্যাশনাল আর্মি অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। দেশটির বেশির ভাগ প্রত্যন্ত এলাকা তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। তালেবান এখন তাদের অস্ত্রপাতিতে শাণ দিচ্ছে এবং মার্কিন বাহিনীর প্রত্যাহারের জন্য দিন গুনছে। মার্কিন সেনারা সরামাত্রই তারা কাবুলে সরকারের ওপর হামলা চালাবে।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ১ জুন একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন পেশ করা হয়, যাতে বলা হয়েছে, সুযোগ পাওয়ামাত্রই আল–কায়েদা ও হাক্কানি নেটওয়ার্ক হামরা চালানো শুরু করবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আল–কায়েদার ভিত্তি এত দৃঢ় যে তালেবানের সঙ্গে তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা শুধু কঠিন নয়, বলা যায় অসম্ভব ব্যাপার।

পাকিস্তানের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, তিনি মনে করেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বাহিনী সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আফগান সরকার রাজধানীর বাইরের বেশির ভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে। মার্কিন বাহিনীর আর এ অঞ্চলে থাকার কোনো আগ্রহ যেহেতু নেই, সেহেতু ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে খুব ভালো কিছু ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে হয় না।

৩ জুন আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ হানিফ আতমার, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি বৈঠক করেছেন। সেখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। প্রথমটি হলো আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান বিবাদ মেটানোর ক্ষেত্রে চীন ‘গঠনমূলক ভূমিকা’ রাখবে। যেহেতু পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে এখন সম্পর্ক খুবই তিক্ত অবস্থায় রয়েছে, সেহেতু ভারতের প্রধান প্রতিপক্ষ দেশ চীনের এ ধরনের ভূমিকা নেওয়ার ঘোষণা বাড়তি তাৎপর্য বহন করে। চীনের সঙ্গে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান উভয় দেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) চালু হলে সেটির নিরাপত্তায় এ দুই দেশে শান্তি থাকাটা চীনের জন্য জরুরি হবে। তবে চীন শুধু আশরাফ গনি আর ইমরান খানের হাত মিলিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ, আশরাফ গনির বাহিনী খুবই দুর্বল অবস্থায় আছে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, এ তিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একমত হয়েছেন, আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি (টিআইপি) অথবা ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম), আইএস এবং তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) মতো সংগঠনকে প্রতিরোধ করা হবে। আফগানিস্তান থেকে পরিচালিত টিটিপির তৎপরতায় পাকিস্তান ত্যক্ত–বিরক্ত। অন্যদিকে আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তান থেকে পরিচালিত ইটিআইএম চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলমানদের খেপিয়ে তোলে বলে চীন সন্দেহ করে থাকে। ইটিআইএমের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক আছে বলে আফগানিস্তান চীনের আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে এ তিন শক্তি মিলে তালেবানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

তালেবান আবার ক্ষমতায় এলে তারা ইটিআইএমের সঙ্গে জোট বেঁধে চীনকে দুশ্চিন্তায় ফেলবে—এ ভাবনা থেকে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের পুনরুত্থানে আপাতত বাধা দিতে চাইবে না। পাকিস্তানের গোয়েন্দারা মনে করছেন, তালেবান কাবুল দখল করলে তা টিটিপি ও ইটিআইএমকে যুগপৎভাবে পাকিস্তান ও চীনে হামলা চালানোয় সাহসী করে তুলতে পারে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

বিজয় প্রসাদ ভারতীয় লেখক ও ইতিহাসবিদ