কামাল লোহানী: শ্রদ্ধাভাজনেষু, বন্ধুবরেষু

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক কামাল লোহানী। প্রথম আলো ফাইল ছবি
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক কামাল লোহানী। প্রথম আলো ফাইল ছবি

এমন একজন মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া সত্যিই মুশকিল, যিনি আছেন শ্রদ্ধার জায়গায়, বন্ধুর জায়গায়। ষাটের দশকে যখন আমরা শিল্পের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করছি, তখন কামাল লোহানীকে দেখেছি দূর থেকে, দুর্দান্ত তাঁর অগ্নিঝরা বক্তৃতা, অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তি এবং সেই সঙ্গে কৃষক শ্রমিকের হাহাকার নিয়ে নৃত্যনাট্য। সেই নৃত্যনাট্যে প্রবীণ শিল্পী কামাল লোহানী। তার আগেই তিনি কারাবরণ করেছেন ১৯৫৫ সালে। পরিচিত হয়েছেন, জীবনচর্চা শুরু করেছেন সব দেশপ্রেমিক নেতার সঙ্গে।

জীবিকা আর প্রবল আগ্রহের কারণেই সাংবাদিকতার শুরু। এই সময় মানে পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলায় অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে—যেমন কাগমারী সম্মেলন; সেখানে মাওলানা ভাসানী সারা দেশ তো বটেই, বিদেশকেও নিয়ে জড়ো করেছিলেন সেখানে। কামাল লোহানী সেখানেও উপস্থিত। সম্ভবত সফেদ পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরার অভ্যাস তখন থেকেই। অসংখ্য কৃষক সম্মেলনে তাঁর উপস্থিতি। পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন সেই সময় থেকেই। ভাষা আন্দোলনেও সোচ্চার তিনি।

আইয়ুব খানের মার্শাল লর সময়েও তিনি বেশি দিন বাইরে থাকতে পারেননি। ১৯৬২ সালেই চলে গেলেন কারাগারে। সেই সময়ের কারাগারগুলো ছিল একধরনের শিক্ষায়তন। বড় বড় সব নেতা জেলখানায়। বাম নেতা বা ডান নেতার মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য থাকলেও জীবনাচরণে কোনো তফাৎ ছিল না। আর তরুণদের মধ্যে ছিল একধরনের স্কুল। রাজনীতি শিখতেন, জীবনের শৃঙ্খলা গণ চরিত্র কী করে অর্জন করতে হয়, সেসব শেখাতেন। সর্বোপরি একটা স্বপ্ন গড়ে উঠত। সেই স্বপ্নের তাড়নায় বাকি জীবন চলতেন।

আগেই বলেছি, কামাল লোহানী বেছে নিয়েছিলেন পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা আর ব্রত হিসেবে শিল্প। সেই কারণেই সত্যেন সেন যখন উদীচী গড়ে তোলেন, তিনি সেখানে যোগ দেন এবং গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে কিছু আদর্শগত পার্থক্যের জন্য গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি’। ক্রান্তি ষাটের দশকে এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। চীনের নয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সারা বিশ্বে আলোচনার ঝড় তুলেছিল। কামাল লোহানী তাতে অনেকটাই আকৃষ্ট হন। সদা ব্যস্ত, সদা আলোচনামুখর কামাল লোহানী তখন ঘুরে বেড়ান সারা দেশে।

ষাটের দশকটা চষে বেড়ানোর পর এল উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। সেখানেও লোহানী সক্রিয়। তারপর এল মুক্তিযুদ্ধ। কোথায় গেলেন তিনি? ঠিক জায়গায়ই গিয়ে পৌঁছালেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা তখন। তিনি বার্তা সম্পাদক। আমরাও সেখানে। এবারে শ্রদ্ধাভাজন এবং বন্ধুবরেষু, লোহানী ভাই। এত দিন দূর থেকে যাঁকে শ্রদ্ধা করেছি, ভয়ও পেয়েছি; তিনি তো বন্ধুর চেয়েও ঘনিষ্ঠ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে একটি অপরিসর কক্ষেই বসবাস। সুযোগ পেলেই একসঙ্গে চা খাই, কথা বলি। পুরোনো কথা শুনি। বঙ্গবন্ধুর জেলজীবনের কত কথা। মণি সিংহ, রবি নিয়োগী থেকে শুরু করে কত জেলখাটা বিপ্লবীর কাহিনি। নাটকের লোক বলে জিজ্ঞেস করি দেশ স্বাধীন হলে কত কী করা সম্ভব— এসব।

তিনি সহাস্যে উত্তর দেন, আবার কখনো উত্তেজিত আলোচনা শুরু হয়। দেশে ফিরে লোহানী ভাই বেশি দিন বাংলাদেশ বেতারে থাকতে পারেননি। কেন থাকতে পারেননি, তা কখনো জিজ্ঞেস করিনি। কারণ, এটাই তাঁর ভবিতব্য। মতবিরোধ বা আদর্শের বিরোধ নিয়ে তিনি
বেশি দিন এক জায়গায় থাকেননি। কর্তৃপক্ষ বলে যে একটা জিনিস আছে, তার সঙ্গে গলায়-গলায় ভাব তার কখনো হয়নি।একসময় শিল্পকলা একাডেমির দায়িত্ব নিলেন। তাঁর অফিসটি আমাদের খুবই আপন মনে হতো। কিন্তু সেও খণ্ডকালের। তাঁর সব পরিকল্পনা ভেস্তেই চলে গেল। দ্বিতীয়বারও তিনি এলেন। কিছু পারলেন, অধিকাংশই পারলেন না। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

কখনো লেখা চলল অবিরাম, সেই সঙ্গে আবার সেই সারা জীবনের ক্ষুধা; সাংস্কৃতিক সংগঠন। যেখানে বাধা, সেখানেই গিয়ে দাঁড়ান। অর্থ, বড় চাকরি, বিশাল ক্ষমতা—এসবের মধ্যে তিনি একেবারেই নেই। শেষ বয়সে এসে তিনি যেন এক অনিঃশেষ যোদ্ধা হয়ে দাঁড়ান। যেখানেই সত্য প্রতিষ্ঠার ডাক পান, সেখানেই ছুটে যান। বন্ধুরা তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ফয়েজ আহমেদ, কে জি মুস্তাফা থেকে শুরু করে অনেকে। তিনি অশ্রুসজল চোখে তাঁদের সামনে এসে দাঁড়াতেন। কখনো দেখতাম জনারণ্যে একা মানুষটি দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ছুটছেন কোনো সভায় বা লেখার তাগিদে।

এর মধ্যে ব্যাধি এসে তাঁকে ঘরে বসানোর চেষ্টা করেছে। চোখের দৃষ্টি কমে এসেছে, তবু ঘরে বসে থাকতেন না। কণ্ঠস্বরে কোনো দুর্বলতাই প্রকাশ পেত না। তাঁর সত্তরতম জন্মদিনে সময়ের সাহস বলে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। অনেকেই সেই গ্রন্থে লিখেছেন হৃদয় দিয়ে। এই অভাজনও একটি লেখা দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছিল। সেখানে বলেছিলাম যাঁর চোখে ছিল এক অলৌকিক আলো, যে আলো তাঁকে রেখেছিল যৌবনের মধ্যগগনে। কিন্তু সেখানে আঁধার এখনো গ্রাস করেনি।

অমিত গুণী কামাল লোহানীকে গতকাল আমরা হারালাম। কী দুর্ভাগ্য, জাতি তাঁর বিদায়ের কালে সেই আশ্চর্য আলোর চোখ দুটোকে দেখতে পেল না। কিন্তু কল্পনা করি, সেই চোখজোড়া এখনো আহ্বান করছে আবারও মানুষকে। বলছে মানুষ তুমি জাগো, তুমি সত্যের ঝান্ডাকে তুলে ধরো। একা নয়, সবাই মিলে আসো।

লোহানী ভাই, তুমি যুগ যুগ থাকো আমাদের সঙ্গে।

মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব