কারা কাদের ‘মেন’

জীবনসায়াহ্নে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক,/ আর কিছু নয়,/ এই হোক শেষ পরিচয়।’ এখন অবশ্য এ উপলব্ধি আসতে জীবনসায়াহ্নের প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং কে কার লোক, তা প্রমাণ করতে যেন উদ্‌গ্রীব সবাই। বাংলাদেশ নিয়ে আল-জাজিরার বহুল আলোচিত প্রতিবেদনটি প্রচারের পর কে কার লোক, তা নিয়ে আলোচনা জমে উঠেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে লেখা বই ও সিনেমার নাম ছিল অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন। আল-জাজিরা খুব কষ্ট না করে তারই আদলে প্রতিবেদনের নাম দিয়েছে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’।

আল-জাজিরা এ প্রতিবেদনে ‘কী বলল’, তার চেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে ‘কে বলল’ তা নিয়ে। এর মধ্যেই আবার সরকারি দলের সমর্থক নেটিজেনরা ফেসবুকে তাদের প্রোফাইল ছবির সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা শুরু করেছে, ‘উই অল আর শেখ হাসিনাস মেন’। কে কার ‘মেন’ বা ‘ম্যান’ হবেন, তা যাঁর যাঁর ব্যক্তিগত বিষয় (একবচনে ম্যান ও বহুবচনে মেন)। কিন্তু এ রকম অনেক ‘ম্যান’ লুকিয়ে আছেন, যাঁদের পরিচয় দেশ ও জাতির স্বার্থে জানা দরকার। এই যেমন ব্যাংক ও আর্থিক খাতের এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত নাম প্রশান্ত কুমার বা পি কে হালদার। তিনি একাই চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কৌশলে দখল করে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দেশ থেকে পালিয়ে আছেন—এটা বিশ্বাস করা কষ্টকর। পি কে হালদার এটা করতে পেরেছেন কারণ, তিনি কারও না কারও লোক বা ‘ম্যান’ এবং তিনিও কাউকে কাউকে নিজের ‘ম্যান’ বানিয়েছিলেন।

পি কে হালদার প্রথমে নামে-বেনামে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও অন্য সহযোগীদের নামে কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার কিনেছেন। তারপর সেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় পরিচালনা পর্ষদে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকে তাঁদের ওই দুই ‘মেন’।

পি কে হালদারের দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল হক ২ ফেব্রুয়ারি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীর কাজ ছিল পি কে হালদারের সব অনিয়ম ‘ম্যানেজ’ করা। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেখভাল করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি বিভাগ আছে, নাম আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ। সব মিলিয়ে সাত বছর এ বিভাগের দায়িত্বে আছেন নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। তাঁকে প্রতি মাসে ঘুষ দেওয়া হতো দুই লাখ টাকা। যদিও এ খাতসংশ্লিষ্ট একজন জানালেন, অঙ্কটা আসলে ২ লাখ নয়, ১০ লাখ টাকা। প্রতি মাসে নিয়ম করে এ অর্থ তিনি পেতেন একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। জবানবন্দি থেকে পরিষ্কার হলো যে বাংলাদেশ ব্যাংকে পি কে হালদারের ‘মেন’ হচ্ছেন এস কে সুর চৌধুরী এবং শাহ আলম।

এস কে সুর ও শাহ আলমের এ কাণ্ডকীর্তিতে কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েনি, ভাবমূর্তি হয়তো কিছুটা নষ্ট হয়েছে। এস কে সুর ও শাহ আলমের এসব কীর্তি ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’। পি কে হালদার চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানই দখল করেছেন একই কায়দায়, শেয়ারবাজার থেকে শেয়ার কিনে। নিয়ম হচ্ছে কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে কমপক্ষে ২ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা থাকতে হয়। পি কে হালদার প্রথমে নামে-বেনামে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও অন্য সহযোগীদের নামে কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার কিনেছেন। তারপর সেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় পরিচালনা পর্ষদে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকে তাঁদের ওই দুই ‘মেন’। পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হয়ে এরপর নামে-বেনামে খোলা সেই সব কোম্পানির অনুকূলে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।

প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু শীর্ষ কর্মকর্তার কর্মকাণ্ড যদি ওপেন সিক্রেটই হয়, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন? এ প্রসঙ্গে গত ৪ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের সাক্ষাৎকারের একটি অংশের কথা মনে করতে পারি। তিনি বলেছিলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর সরকার নিয়োগ দিয়ে থাকে। এ দুটি পদে নিয়োগ অত্যন্ত যত্নসহকারে এবং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সুবিবেচনার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। এখন যা শুনি তা হলো, তাদের বাছাই করে কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপ। যেমন এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে কোনো কোনো ডেপুটি গভর্নর নিয়ে জিজ্ঞেস করলে জানতে চাইবে, অমুক না তমুক গ্রুপের? এটা তো খুব দুর্ভাগ্যজনক।’

বিষয়টি কিন্তু বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকের এমডিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ডেপুটি গভর্নর বা ব্যাংকের এমডিদের মধ্যে কে কার ‘ম্যান’, কোন ব্যবসায়ী গ্রুপ কার জন্য লড়ছেন, কে কার হয়ে লবিং করছেন—এটাও এখন ওপেন সিক্রেট।

পি কে হালদার তাহলে কার ‘ম্যান’? আবার শেয়ারবাজার থেকে শেয়ার কিনে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করাটাই বা পি কে হালদার শিখলেন কোথায়? ২০১৭ সালের ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা বদলের কথা একটু মনে করিয়ে দিতে চাই। সাতটি কোম্পানির নামে শেয়ারবাজার থেকে শেয়ার কিনে তারপরই ইসলামী ব্যাংকের মালিকানার বদল হয়েছিল। রাজধানীর র‍্যাডিসন হোটেলে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে ব্যাংকটির তখনকার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) পদত্যাগ করতে হয়েছিল। বাজার থেকে নতুন শেয়ার কিনে ব্যাংকটির এসব পরিবর্তনে ভূমিকা ছিল এস আলম গ্রুপের। পেছনে আরও শক্তিশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ভূমিকা ছিল। এরপর একই পদ্ধতিতে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখলের একাধিক ঘটনা আছে। অনেকেই হয়তো জানেন, পি কে হালদার যে দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি ছিলেন, সে দুটি ছিল এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন। এই ব্যবসায়ী গ্রুপটি তাহলে কার ‘মেন’?

আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। তাহলে বড় প্রশ্ন হলো শহিদ ইসলাম আসলে কার ‘ম্যান’। আবার যিনি বা যাঁরা এত কিছু ‘ম্যানেজ’ করে দিলেন, তাঁরাই বা কার ‘মেন’।

সাম্প্রতিক সময়ের আরেকটি আলোচিত ঘটনা হচ্ছে সাংসদ দম্পতি শহিদ ইসলাম ও সেলিনা ইসলাম-কাণ্ড। অর্থ ও মানব পাচারের অভিযোগে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাংসদ শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুলকে কুয়েতের আদালত চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫৩ কোটি ১৯ লাখ ৬২ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন। শুধু টাকার জোরেই সাংসদ হয়েছিলেন তিনি, এমনকি টাকার জোরে স্ত্রীকেও সাংসদ বানিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এ আসন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মহাজোটের শরিক এরশাদের জাতীয় পার্টিকে (জাপা) ছেড়ে দেওয়া হলে মনোনয়ন পেয়েছিলেন মোহাম্মদ নোমান। আর শহিদ ইসলাম ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। একপর্যায়ে নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ান জাপা প্রার্থী। প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগও। বরং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি থেকে চিঠি দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী শহিদ ইসলামের পক্ষে কাজ করার জন্য দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, ১২ কোটি টাকার বিনিময়ে নির্বাচন থেকে সরে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ নোমান। অর্থাৎ তিনি ছিলেন শহিদ ইসলামের ‘ম্যান’।

গত ২৪ জুন প্রথম আলোতে ছাপা হয় যে নির্বাচনে প্রার্থী সরানো, ভোটের মাঠ নিয়ন্ত্রণ এবং জয়ী হতে শহিদ ইসলামকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং দলের কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কয়েকজনকে সন্তুষ্ট করতে হয়েছিল মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে। বলে রাখা ভালো, আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। তাহলে বড় প্রশ্ন হলো শহিদ ইসলাম আসলে কার ‘ম্যান’। আবার যিনি বা যাঁরা এত কিছু ‘ম্যানেজ’ করে দিলেন, তাঁরাই বা কার ‘মেন’।

স্ত্রী সেলিনা ইসলামকে সাংসদ বানাতেও মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয়েছিল শহিদ ইসলামকে। এ কাজে তাঁকে সহায়তা দিয়েছিলেন ফরিদপুর-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী)। তাঁর বড় ভাই জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে কাজের ধরন অনুযায়ী কে কার ‘ম্যান’ তা বদলে যাচ্ছে।

অনেক বছর ধরেই ব্যাংক খাতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, বেসিক ব্যাংকের একসময়ের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু আসলে কার ‘ম্যান’। ব্যাংকটি থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনার পরও বহাল তবিয়তে আছেন তিনি। গত প্রায় ১০ বছরে বেসিক ব্যাংক ধ্বংসের জন্য দুদক তাঁর কোনো দায় খুঁজে পায়নি। যদিও ২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সাবেক অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘অনিয়মিত ঋণ মঞ্জুর, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা ছিল।’ জাতীয় সংসদে অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির তদন্তেও আবদুল হাইয়ের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গিয়েছিল। তারপরও কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারার কারণ কী? এর উত্তরও সাবেক অর্থমন্ত্রী ২০১৬ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে দিয়েছিলেন। ওই দিন সংসদে তিনি হল-মার্ক কেলেঙ্কারি ও বেসিক ব্যাংক জালিয়াতি নিয়ে বলেছিলেন, ‘জালিয়াতদের ধরতে বাধা নিজের দলের লোক।’ দলের কে কে বাধা দিয়েছেন, তা অবশ্য অর্থমন্ত্রী বলেননি। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে শেখ আবদুল হাইও কারও কারও ‘ম্যান’।

এ লোকগুলোও যদি তাদের ফেসবুক প্রোফাইলে কে কার ‘ম্যান’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখত, তাহলে কতই না ভালো হতো।


শওকত হোসেন: প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক

[email protected]