কারা কারা ষড়যন্ত্রকারী

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অভিযোগের রেওয়াজ বহু পুরোনো। এখানে বিরোধী দল অভিযোগ করে নির্যাতনের, সরকার ষড়যন্ত্রের। তবে নির্যাতন যতটা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করা যায়, ষড়যন্ত্র ততটা নয়। এ জন্য ‘ষড়যন্ত্র’ নিয়ে দোষারোপ ও ধোঁয়াশা তৈরির সুযোগ থাকে বেশি।

ষড়যন্ত্র নিয়ে এখন কথাবার্তা বিদেশিদের কাছে নালিশকেন্দ্রিক। সরকারের ভাষ্য অনুসারে এই ষড়যন্ত্র করছে বিএনপি, কখনো কখনো বিএনপি-জামায়াত একসঙ্গে। তাদের নালিশেই নাকি র‌্যাব-পুলিশের সাতজন নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন, মানবাধিকার নিয়ে বাংলাদেশ নিন্দিত হচ্ছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনীর বিরুদ্ধে তৎপরতা শুরু হয়েছে।

বোঝাই যাচ্ছে এসব কথাবার্তা দেশের মানুষকে শোনানোর জন্য। আসল পরিস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন। যেমন আন্তর্জাতিক কিছু প্রতিষ্ঠানে র‌্যাব-পুলিশের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উচ্চারিত হচ্ছে বহু বছর ধরে। সেটি হয়েছে বাংলাদেশের মন্ত্রী বা সরকারি প্রতিনিধিদের সামনে। কারা অভিযোগগুলো করেছে, তা তাঁরা জানেন। এসব অভিযোগ করার আইনসম্মত এখতিয়ার যে তাঁদের আছে, সেটিও তাঁরা জানেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ব্যবস্থায় যেকোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের অভিযোগ জানানোর অধিকার আছে এবং বাংলাদেশ (এবং পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্র) নিজেই এ ব্যবস্থায় সম্মত হয়েছে বহু বছর আগে থেকে।

কাজেই মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে ‘ষড়যন্ত্র’ যদি হয়ে থাকে, তাহলে এটি করেছে বহু ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, দেশ আর জাতিসংঘ মিলে। এই ষড়যন্ত্র মধুর ষড়যন্ত্র। এটি না থাকলে দেশে দেশে বর্বরতার কোনো সীমা থাকত না।

২.

মানবাধিকার সর্বজনীন এবং তাই কোনো দেশে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হলে অন্যান্য দেশেরও কিছু বলার আছে। আধুনিক মানবাধিকারের এই ধারণা সুশক্ত হয়ে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে জাতিসংঘের জন্মের মাধ্যমে। মানবাধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক নজরদারি করার অন্যতম প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল। বর্তমানে কাউন্সিলের অন্যতম কাজ হচ্ছে প্রতিটি রাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর বৈশ্বিক শুনানিমূলক রিভিউ (ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক্যাল রিভিউ বা ইউপিআর) আয়োজন করা। এই রিভিউতে জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি চার বছরে একবার করে পর্যালোচনা করা হয়।

রিভিউটি করার ক্ষেত্রে মানবাধিকার কাউন্সিল মানবাধিকারসংক্রান্ত জাতিসংঘের হাইকমিশনার অফিসের রিপোর্ট, অন্য রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক উত্থাপিত প্রশ্নাবলি ও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের উত্তর বিবেচনায় নেয়। এ ছাড়া এতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন ও থিঙ্কট্যাংকগুলোর সুযোগ থাকে প্রতিবেদন দেওয়ার, প্রশ্ন করার ও জবাব চাওয়ার। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে প্রতিটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি জানা এবং এর উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনে দেশটিকে পরামর্শ ও সহায়তা দেওয়া।

মানবাধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক নজরদারি করে থাকে বিভিন্ন মানবাধিকার চুক্তির মাধ্যমে গঠিত কমিটিগুলোও। এই কমিটিগুলোতেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সুযোগ থাকে তাদের অভিমত জানানোর। ইউপিআর এবং কিছু কমিটির কার্যক্রমে বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম, খুনসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছিল এরা, অন্য কিছু রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের বিভিন্ন অফিস। অভিযোগ উঠেছিল প্রকাশ্যে এবং সরকারি প্রতিনিধির সামনে।

কিছু উদাহরণ দিই। নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক চুক্তির পক্ষরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে দীর্ঘ ২০ বছর দেরিতে তার প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রদান করে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে। এটি বিবেচনার সময় বিভিন্ন পক্ষের মতামত শুনে নির্যাতনবিষয়ক কমিটি যে কনক্লুডিং অবজারভেশন প্রদান করে, এতে বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কে বিভিন্ন সমালোচনা ছিল। প্রধান সমালোচনার মধ্যে রাষ্ট্রের ‘অফিশিয়াল’-দের কর্তৃক গুম ও নির্যাতনের ‘নিউমারাস অ্যান্ড কনসিসট্যান্ট’ ঘটনাবলি, মামলা গ্রহণে অস্বীকৃতি, তদন্তে অনীহার কথা বলা হয়। এতে সুনির্দিষ্টভাবে র‌্যাবের বিরুদ্ধে নির্যাতন, স্বেচ্ছাচারী গ্রেপ্তার, অস্বীকারকৃত আটক, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ আনা হয়। কমিটি এসব বন্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করে। যেমন গুম, নির্যাতন, অবৈধ আটক ইত্যাদি বিষয়ক যে নয়টি আন্তর্জাতিক পরিদর্শক বা তদন্ত দল বাংলাদেশে আসার অনুমতি চেয়েছে, তাদের অনুমোদন দিতে বলা হয়। বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত এর কোনো সদুত্তর দেয়নি।

হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের ২০১৮ সালের ইউপিআরে যে ২৯টি স্টেকহোল্ডার গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করে, এর মধ্যে ছিল দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও থিঙ্কট্যাংক। এগুলোর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সরাসরিভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে অভিযুক্ত করে। বাংলাদেশের উত্তরসহ বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে ইউপিআর ২৫১টি সুপারিশ প্রদান করে। কিছু সুপারিশে বাংলাদেশ অ্যাগ্রিড বা সম্মত মন্তব্য করলেও গুমবিরোধী চুক্তি, আন্তর্জাতিক নজরদারি আরও সুশক্ত করাসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রটোকলে অনুসমর্থন ও এসব বন্ধে বিভিন্ন সুপারিশে শুধু ‘নোটেড’ বা দেখলাম ধরনের মন্তব্য করে।

এ ছাড়া নির্যাতনবিরোধী চুক্তি স্বাক্ষরের সময় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড এড়ানোর জন্য কেবল দেশে বিদ্যমান আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেয়। জার্মানি, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড, স্পেন, সুইডেনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র বাংলাদেশের ঘোষণাটির তীব্র সমালোচনা করে। ২০১৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে স্বয়ং বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড ও নজরদারি এড়াতে বাংলাদেশের কিছু ভূমিকার সমালোচনা করে।

গুম, খুন বা নির্যাতন হলে এর দায় যারা এসব করেছে, তাদের। এসব নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ নিন্দিত হলে বা বিভিন্ন পদক্ষেপের শিকার হলে এর দায়ও তাদের। এসব নিয়ে যারা অভিযোগ করেছে, দায় তাদের নয়।

৩.

ওপরের তথ্যাবলিতে এটি স্পষ্ট যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ব্যবস্থায় কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। এসব ব্যবস্থায় দেশি–বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, বেসরকারি প্রতিনিধি ও অন্য রাষ্ট্রগুলোর অংশ নেওয়ার ব্যাপক সুযোগ থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করে থাকে অভিযুক্ত দেশেরই গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে।

বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এ দেশে গণমাধ্যমের ওপর কালো আইন, বিজ্ঞাপন নীতিমালা, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে বর্জনসহ বিভিন্ন নিবর্তনমূলক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এরপরও তারা যতটুকু সংবাদ প্রকাশ করতে পেরেছে, তাতেই এ দেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র পাওয়া যায়। স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলে এটি যে আরও ভয়াবহ হতো, তা আমরা টেকনাফের ওসি প্রদীপের বাহিনীর অপরাধবৃত্তির অভিযোগগুলো থেকে আন্দাজ করতে পারি। টেকনাফে সিনহা হত্যাকাণ্ডের আগে যে শতাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার ইতিবৃত্ত, বিভিন্ন ঘটনায় গুম থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের বক্তব্য, মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানানো থানার আইন লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতার সুযোগ কোনো দিন তৈরি হলে হয়তো আরও বহু প্রদীপের ঘটনা সম্পর্কে আমরা জানতে পারব।

এসব জানানো কোনো ষড়যন্ত্র নয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলগুলো ও আমাদের সংবিধান অনুসারে এটিও একটি মানবাধিকার।

৪.

গুম, খুন বা নির্যাতন হলে এর দায় যারা এসব করেছে, তাদের। এসব নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ নিন্দিত হলে বা বিভিন্ন পদক্ষেপের শিকার হলে এর দায়ও তাদের। এসব নিয়ে যারা অভিযোগ করেছে, দায় তাদের নয়। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ জানানোর অধিকার সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের রয়েছে। এসব অধিকারকে ষড়যন্ত্র আখ্যায়িত করে দেশীয় রাজনীতিতে কিছু সুবিধা পাওয়া হয়তো সম্ভব; কিন্তু আন্তর্জাতিক নজরদারি ব্যবস্থাকে দুর্বল ও বিভ্রান্ত করার সুযোগ খুবই কম।

এসব ব্যবস্থাকে পাশ কাটানোর মতো যে শক্তিমত্তা চীন-রাশিয়ার রয়েছে অথবা যে একগুঁয়েমির দীর্ঘ ঐতিহ্য উত্তর কোরিয়া-মিয়ানমারের রয়েছে, তা বাংলাদেশের নেই। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে তাই বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার খড়্গ নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে। এমনও হতে পারে, এসব একদিন মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিচার্য হতে পারে দেশে-বিদেশের যেকোনো আদালতে।

ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র বলে শোরগোল না তুলে সরকারের তাই উচিত গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ এসব বিষয়ে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠানের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করা।

মনে হচ্ছে না সেই সদিচ্ছা সরকারের খুব একটা রয়েছে।

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক