কার্টুনিস্ট কিশোরের ৬৯ ঘণ্টা আর একটি ‘অচ্ছুত আইন’

কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর
ছবি: প্রথম আলো

ছবিটি ছাপা হয়েছে প্রথম আলোতে। অসহায় এক মুখ, কাঁচা-পাকা দাড়ি, চোখের কোনায় জল, মুখের প্রতিটি রেখায় কষ্ট আর অসহায়ত্বের ছাপ। ছবি যে লেখার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী, ছবি যে কথা বলে, সেই ছবিটি তার প্রমাণ।

দীর্ঘ ১০ মাস পর কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে নিজের ওপর চলা নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন কিশোর। কে জানে কান্নাটা তাঁর বুকের গভীরে হয়তো জমাট বাঁধাই ছিল বহুদিন ধরে। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, কিশোর প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছেন। মুশতাকের ভাগ্যে সেটি ঘটেনি।

৬ বার জামিন নাকচের পর ১০ মাস কারাগারে কাটিয়ে কিশোর যখন মুক্ত হলেন, তখন ডেইলি স্টার-এর সাংবাদিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাঁর প্রথম বাক্যটি ছিল, ‘আমার কাছে এলে পাবেন পুঁজের দুর্গন্ধ।’ কিশোরের ওপর নির্যাতনের তীব্রতা বোঝার জন্য এই একটি বাক্যই যথেষ্ট ছিল। এরপর পুরো সাক্ষাৎকারটি পড়লেই দেখা যায়, কী ভয়াবহ নির্যাতনের ভেতর দিয়ে গেছেন মানুষটি।

বাংলাদেশে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নতুন কিছু নয়। আইনজীবী হওয়ার সুবাদে জানি, এ দেশে রিমান্ডে নেওয়ার পর ১৬৪ ধারায় যে জবানবন্দি দেওয়া হয়, পরবর্তী সময়ে প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই সেটি প্রত্যাহারের যুক্তি হিসেবে সামনে আনা হয় নির্যাতনের কথা। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত এই নির্যাতন বন্ধের ব্যাপারে বারবার সতর্ক করলেও বাস্তব অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। হেফাজতে নির্যাতন এবং অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু এখনো বাংলাদেশে স্বাভাবিক ঘটনা। যদিও এই রকম অপরাধ নিয়ন্ত্রণকল্পে একটি আইন আছে; আইনটির নাম ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩ ’।

সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্যাতন ও নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ থাকলেও এই দেশে যুগের পর যুগ এই আইন করা হয়নি। আইনটির প্রস্তাবনায় ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার অথবা দণ্ডবিরোধী সনদ অনুস্বাক্ষর করাকে কারণ হিসাবে জোর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সদিচ্ছা যতটা নয়, চাপ কাজ করেছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি।

২০১৩ সালে এই আইনটি প্রণয়নের পর থেকে প্রতিটি পুলিশ সপ্তাহে এই আইন বাতিলের জন্য পুলিশ বাহিনী প্রধানমন্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জানিয়ে আসছে। পরপর চার বছর বাতিলের দাবি অগ্রাহ্য হলে পুলিশ এই আইনের ২০টি ধারার মধ্যে ১৪টি ধারার সংশোধন চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায়। প্রস্তাবে আইনের ৭টি ধারা বিলুপ্ত করার দাবি তোলা হয়। পুলিশ বাহিনীর দাবি এখন পর্যন্ত অগ্রাহ্য হয়েছে, আইনটি বাতিল বা সংশোধিত হয়নি ঠিকই, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, আইনটি নিয়ে পুলিশ বাহিনীর এত আপত্তির কারণ কী?

পুলিশের যুক্তি, এ আইনের কারণে নাকি অনেকেই পুলিশের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের সুযোগ পাচ্ছে। অথচ বাস্তবতা হলো, আইন ও সালিস কেন্দ্রের মতে, গত ১০ বছরে হেফাজতে ৮৪২ জন প্রাণহানীর শিকার হয়েছেন। আর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বিবেচনায় নিলে এই সংখ্যা অগণিত।

পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত যে কোনো অপরাধের মামলার তদন্ত পুলিশের হাতে থাকা আদতে আইনটিকে অর্থহীন করে তুলছে বলেই প্রতীয়মান হয়। অভিজ্ঞতা বলে, পুলিশের ভয়ে অধিকাংশ মানুষ মামলা করতে আগ্রহী হয় না।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ ভয়ে পুলিশ যা বলে তা-ই মেনে নেয় । নির্দোষ মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করে সেই মানুষের স্বজনদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার অভিযোগ এই দেশে অনেক। ২০১৭ সালে খুলনার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শাহজালালকে ধরে এনে ছেড়ে দেওয়ার জন্য দাবিকৃত এক লাখ টাকা না পেয়ে তাঁর দুই চোখ উপড়ে ফেলার তথ্য আমাদের অনেকেরই মনে আছে এখনো।

পরিস্থিতি এখন সম্ভবত এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ধৈর্য ধরে অপরাধের তদন্ত করার চেয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে ১৬৪ ধারায় একটা স্বীকারোক্তি আদায় করার সহজ পথই পুলিশ বেছে নিয়েছে। কিছুদিন আগে নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকার ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরী নিখোঁজ হওয়ার পর পুলিশ ওই এলাকার তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর তিন আসামি দুই দফা রিমান্ড শেষে কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। ‘নিখোঁজ’ কিশোরী নিখোঁজ হওয়ার ৫১ দিনের মাথায় ফিরে আসে এবং জানায়, নিজের ইচ্ছাতেই বাড়ি ছেড়েছিল সে।

২০১৩ সালে আইনটি পাসের পর গত সাত বছরে হেফাজতে অসংখ্য নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও মামলা হয় মাত্র ১৮টি, যার মধ্যে ১৪ টিতেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া প্রতিটি মামলাতেই কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘তথ্যগত ভুল’। উল্লেখ্য, নিজেদের অপরাধের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত প্রতিটি মামলা তদন্ত করেছে পুলিশ নিজে।

আলোচ্য আইনটির অধীনে মামলার প্রথম চূড়ান্ত রায় হয়েছে গত বছর, ২০২০ সালে। মিরপুরের জনির হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় পাঁচজন আসামির মধ্যে তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আর অপর দুজনের সাত বছর করে কারাদণ্ড হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই আইনে দায়ের করা এটিই প্রথম মামলা, যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয়েছে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত না হলে এই মামলার পরিণতিও হয়তো পূর্বোল্লিখিত মামলাগুলোর মতোই হতো।

পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত যে কোনো অপরাধের মামলার তদন্ত পুলিশের হাতে থাকা আদতে আইনটিকে অর্থহীন করে তুলছে বলেই প্রতীয়মান হয়। অভিজ্ঞতা বলে, পুলিশের ভয়ে অধিকাংশ মানুষ মামলা করতে আগ্রহী হয় না। মামলা করলেও বেশির ভাগ সময় চাপে পড়ে আপস করে ফেলে। পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে তদন্ত ভিন্ন খাতে নেয়, অনেক সময় উল্টো বাদীর বিরুদ্ধেই মামলা করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহনুর র‍্যাব হেফাজতে মারা যাওয়ার পর যখন থানা মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়, তখন যে আদালত অভিযোগকে এজাহার হিসেবে বিবেচনার নির্দেশ দেন, তাঁর বিচারককেই ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে বদলি করে দেওয়া হয়। তাই বাস্তবতার নিরিখে আইনটি সংশোধন করে বিচার বিভাগীয় তদন্তকেই একমাত্র অপশন রাখা জরুরি।

আইন তৈরি হয় অপরাধীকে শাস্তির আওতায় এনে সমাজে অপরাধের মাত্রা কমাতে এবং নাগরিকদের জন্য একটা নিরাপদ রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে। কিন্তু কোনো আইন যদি প্রায় অব্যবহৃতই থেকে যায়, ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অব্যাহতি দেয়, ভুক্তভোগীর মনে ন্যূনতম কোনো আশ্বাস না জাগিয়ে বরং নতুন করে বিপদে পড়ার ভীতি তৈরি করে, অসংখ্য মানুষের ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার দেখানোর আগে শত ঘণ্টা অজ্ঞাত স্থানে থাকার হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই আইনটি রেখেই-বা কী হবে?

রুমিন ফারহানা সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।