কালামের হাজতবাস ও অভিবাসী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মন

জাহাজে করে রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রাম থেকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়।
ছবি: জুয়েল শীল


২০২০ সালের শেষ সপ্তাহে দ্বিতীয় পর্যায়ের ১ হাজার ৮০৪ জন ভাসানচরগামী রোহিঙ্গা বহরের ছবি তোলার সময় আবুল কালাম নামের একজন ফটোগ্রাফারকে আটক করা হয় এবং পরে কারাগারে পাঠানো হয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তির স্ত্রী জানাচ্ছেন কালামের বোন ওই বিদায়ী বহরের বাসযাত্রী থাকায় কালাম স্মৃতি ধরে রাখবে বলে ছবি তুলতে গিয়েছিল। বাংলাদেশেও সে ১৯৯২ সাল থেকেই বসবাস করছে। তা ছাড়া ফটোগ্রাফি তার শখের পেশা। সুখবর এই যে কালামের দ্রুত জামিন হয়েছে।

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে যখন আন্তর্জাতিক মহলের আরও সুদৃষ্টি আকর্ষণ দরকার, ঠিক সেই সময়টিতেই কালামের গ্রেপ্তারটি খুব সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ হয়েছে মনে করার কারণ নেই। পুলিশ যদিও বলছে আগের অন্য কোন এক পুরোনো মামলার অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে নাকি তাকে আটক করা হয়েছে। এই আটকের কাজটি নিশ্চয়ই দ্বিতীয় রোহিঙ্গা বহর ভাসানচরে যাওয়ার আগে বা পরে বা অন্য কোনো সময়ও করা যেত। ছবি তোলা আপত্তির বিষয় হলে ক্যামেরার মেমোরি কার্ড মুছে ক্যামেরা ফেরত দিয়ে সেই সময়ের জন্য তাকে চলে যেতে দেওয়া যেত। আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাটিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিতান্তই তুচ্ছ ঘটনা মনে করা হলেও আদতে বিষয়টি অতটা তুচ্ছ নয়।

বিদেশে টুইটারে ‘ফ্রি কালাম’ হ্যাশট্যাগও তৈরি হয়েছে। সেই আবেদন শেয়ারও হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। জোর দাবি উঠেছে কালামের মুক্তির। শুধু প্রবাসী রোহিঙ্গারাই নয়, সাধারণ বিদেশিরাও বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। ছবি তোলার সময়েই গ্রেপ্তার করায় আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের রোহিঙ্গাবিষয়ক অবস্থানের প্রতি সন্দেহ আরও বেড়েছে।

সম্প্রতি সমাজবিদ্যায় ‘স্ট্রেইস্যান্ড ইফেক্ট’ নামে একটি ধারণা আছে। গায়িকা বারব্রা স্ট্রেইস্যান্ড কী যেন একটি বিষয়কে অপ্রকাশ্য রাখতে চাইলেন। কিন্তু ফল হলো উল্টো। আরও অসংখ্য প্রচ্ছন্ন কেলেঙ্কারি আর প্রশ্ন বিস্ফারিত হতে থাকল। এই ঘটনা দিয়ে ‘স্ট্রেইস্যান্ড ইফেক্ট’ ধারণাটি প্রতিষ্ঠা পেল। এর মূল ভাষ্য, কোনো বিষয়কে চেপে রাখার চেষ্টা হলে সেটি তো বটেই, তার সঙ্গে আরও অসংখ্য ভুলভাল ধারণা ও প্রশ্ন উদোম হয়ে পড়ে। আরও অপ্রীতিকর ও বিব্রতকর প্রশ্নের জন্ম হয়। কালামের আটকের ফলও সে রকমই হয়েছে। ঘটনাটি দ্রুত আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মীদের নজর কেড়েছে। প্রতিক্রিয়ায় ৩৩ জন দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতা, ফটোগ্রাফার, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক দ্রুততম সময়ে নিদারুণ উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। কালামের মুক্তির দাবিও জানিয়েছেন।

বিদেশে টুইটারে ‘ফ্রি কালাম’ হ্যাশট্যাগও তৈরি হয়েছে। সেই আবেদন শেয়ারও হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। জোর দাবি উঠেছে কালামের মুক্তির। শুধু প্রবাসী রোহিঙ্গারাই নয়, সাধারণ বিদেশিরাও বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। ছবি তোলার সময়েই গ্রেপ্তার করায় আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের রোহিঙ্গাবিষয়ক অবস্থানের প্রতি সন্দেহ আরও বেড়েছে। অপ্রিয় কথামালা বাজারে আরও বেশি করে আলোচিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের মানবাধিকারকর্মীরাও কাউকে আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হস্তান্তরের যে আইনটি আছে, তা লঙ্ঘিত হওয়ার অভিযোগ করেছেন। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ায় বাধ্য করার জোরদার কূটনীতির বদলে স্থানান্তরই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে কেন, সেই প্রশ্নটি উঠেছে। ভাসানচরে এক লাখের আশ্রয় হলে বাকি নয় লাখকে কী করা হবে, সেই জিজ্ঞাসা করতেও ছাড়ছেন না তাঁরা।

যুক্তরাজ্যে স্থায়ী একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক, চিত্রগ্রাহক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা তাঁর তীব্র উষ্মার কারণ জানিয়ে লিখেছেন, এমন হীন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। তিনি জানান যে রোহিঙ্গাদের মধ্যে একদল শখের চিত্রগ্রাহক ও নির্মাতা তৈরি হয়েছে, যাদের সৃজনশীল চিত্রগ্রহণ আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতেও প্রশংসিত হচ্ছে। শরণার্থী জীবনে সামান্য নান্দনিক চর্চাও কী তাহলে নিষিদ্ধ? নমুনা হিসেবে তাই কালামের একটি উদাহরণই তাঁরা যথেষ্ট মনে করছেন।

ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়। প্রবাসী রোহিঙ্গাদের অবস্থাও সে রকমই। তাঁরা ফেসবুকে টুইটারে মন্তব্য লিখছেন যে কালামের আটক ঘটনার ভিত্তিতে এই আশঙ্কা করা অমূলক হবে না যে বাংলাদেশেও রোহিঙ্গারা কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। কালামের আটকের মতো বিষয়ে খানিকটা সতর্কতা ও সুবুদ্ধি দেখালে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ সম্পর্কে এই রকম নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হওয়া ঠেকানো যেত।

দুই

পৃথিবীর যেসব দেশে শরণার্থী ও অভিবাসন কর্মসূচি আছে, সেগুলোর সবগুলোতেই রোহিঙ্গাদের একটি অংশ অভিবাসী হয়েছে। কেতাবি ভাষায় কোনো অভিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সমাজকে ‘ডায়াস্পরা’ বলা হয়। রোহিঙ্গা ডায়াস্পরা সমাজে মোটামুটি শিক্ষিত হতে শুরু করে সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিতজনও আছেন। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনবিদ, শিক্ষাবিদ, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ইত্যাদিও আছেন। সুতরাং প্রবাসেও রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কথা বলার জন্য মুখপাত্রর অভাব নেই। তাঁরা আসলেও যথেষ্ট সরব।

তাঁদের মধ্যে যাঁরা উচ্চশিক্ষিত-আন্তর্জাতিক মহলে তাঁদের পরিচিতি এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিও রয়েছে। রোহিঙ্গা অধিকার ও সুরক্ষাবিষয়ক বড়-ছোট অনেকগুলো সংগঠনও আছে। তাঁদের অনেকেই মানবাধিকারকর্মী এবং রাজনীতিসচেতন। কানাডা ও আমেরিকার সিনেটসহ, জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামেও তাঁদের বিচরণ রয়েছে। আছে গ্রহণযোগ্যতাও। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন সামাজিক ও মানববিদ্যা অনুষদগুলোতে তাঁদের ডাকা হয় বক্তৃতা ও মতামতদানের জন্য।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান বিষয়েও তাঁরা উচ্চকণ্ঠ ও তৎপর।

বাংলাদেশের পক্ষে গুডউইল অ্যাম্বাসেডরের কাজ করতে পারার মতো একটি শক্তি প্রবাসে মজুত আছে। বাংলাদেশ তাদের কাজে লাগিয়ে অকূটনৈতিক বৈশ্বিক ফোরামগুলোতে মিয়ানমারবিরোধী শক্তিশালী জনমত তৈরির সুযোগ নিতে পারত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ডায়াস্পরা সমাজগুলোতে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার ধরন-ধারণ নিয়ে সন্তুষ্টির বদলে অসন্তোষ প্রতিদিনই বাড়ছে

একটি নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর সদস্য হওয়ায় বিদেশে তাঁদের প্রতি সহানুভুতিশীলদের সংখ্যাই বেশি। তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার জন্য মিয়ানমার হতে অভিবাসী হওয়া অনেক অ-রোহিঙ্গা সহযোদ্ধারাও আছেন। এ কথা সত্য যে তাঁদের সংঘবদ্ধতাকে ইস্পাতকঠিন বলা চলে না। বিভেদ-বিভক্তি তাঁদের মাঝেও আছে। ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বের সংকট, প্রতিযোগিতা, স্বার্থপরতা ইত্যাদিও রয়েছে। পারস্পরিক পছন্দ-অপছন্দের মেরুকরণ আছে। তাঁদের সব কর্মকাণ্ড সব মহলে সমানভাবে আদৃতও হয়তো নয়। সবকিছুর পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মানবাধিকারকর্মীদের মহলে তাঁদের সহজ প্রবেশাধিকার আছে।

অর্থাৎ বাংলাদেশের পক্ষে গুডউইল অ্যাম্বাসেডরের কাজ করতে পারার মতো একটি শক্তি প্রবাসে মজুত আছে। বাংলাদেশ তাদের কাজে লাগিয়ে অকূটনৈতিক বৈশ্বিক ফোরামগুলোতে মিয়ানমারবিরোধী শক্তিশালী জনমত তৈরির সুযোগ নিতে পারত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ডায়াস্পরা সমাজগুলোতে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার ধরন-ধারণ নিয়ে সন্তুষ্টির বদলে অসন্তোষ প্রতিদিনই বাড়ছে। তারা সমালোচনামুখরই থাকছে না, বাংলাদেশের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর বিষয়ে বিরোধিতামনস্ক হয়ে উঠছে নিত্যই। ডায়াস্পরা সমাজগুলোর ধারণা বাংলাদেশ তাদের গোনাতেই রাখে না, মতামত বা অনুভব-অনুভূতিকে আমলে নেওয়া তো অনেক পরের বিষয়। উপরন্তু, তারা মনে করে বাংলাদেশ তাদের প্রতি শত্রু মনোভাবাপন্ন। অথচ আন্তর্জাতিক মহল তাদের মনোভাবকে কূটনৈতিক মহলের রাজনৈতিক ও দাপ্তরিক ছক বাঁধা মতামতের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এই যোগাযোগের সমস্যার কারণেও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সমাজের সহানুভূতি হারাচ্ছে।

বাংলাদেশের দায়িত্বশীল মহল এই ডায়াস্পরা সমাজকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক মতামত তৈরির কোনো চেষ্টা করেছে কি? উত্তর সম্ভবত ‘না’। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় ডায়াস্পরা সংগঠনগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের মহানুভবতার দারুণ প্রশংসা করেছে, এমন অনেক প্রমাণ আমাদের হাতে মজুত আছে। এই কথাগুলো টানার কারণ বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রয়োজনে মিয়ানমারের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক মতামত তৈরির চেষ্টায় নিরলস পরিশ্রমরত শুনতে পাওয়া যায়।

আন্তর্জাতিক মহল মিয়ানমারের বিপক্ষে যথার্থ ভূমিকা রাখছে না, এমন অভিযোগও এন্তার শোনা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ডায়াস্পরা সংযোগের প্রয়োজনকে অবজ্ঞা বা উপেক্ষা করা হতে থাকলে আন্তর্জাতিক মহলের মন জোগানো আরও কঠিন হয়ে উঠবে। মনে রাখা প্রয়োজন, রোহিঙ্গা সমস্যাটির সমাধান শুধু কূটনৈতিক ক্ষমতার জোরে মোটেই সম্ভব নয়। অকূটনৈতিক মহল যেমন গবেষক, মানবাধিকার ও শান্তি আন্দোলন সংস্থা-সংগঠন এবং বিশ্ব জনপরিসরে মতামত সৃষ্টিকারী ডায়াস্পরা সমাজ ও নাগরিক সমাজেরও সমান অংশগ্রহণের প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ এই দিকটিতে যত তাড়াতাড়ি নজর দিতে পারবে, ততই সংকট কাটার সম্ভাবনা বাড়বে।

ড. হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।
ড. কাওসার আহমেদ নির্বাহী পরিচালক, কনফ্লিক্ট অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কানাডা।