কিশোর অপরাধী চক্রকে অবহেলা নয়

অপরাধ
প্রতীকী ছবি

রাষ্ট্রে কখনো কখনো নানা রকম সমাজবিরোধী শক্তির উপদ্রব ঘটতে পারে। একজন ব্যক্তি অপরাধ করতেই পারে। তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সে জন্য রাষ্ট্রে আইন-আদালত ও শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু একই রকম সংঘবদ্ধ অপরাধ যখন বারবার হতে থাকে, তখন তাতে সেই জনগোষ্ঠীর চরিত্র বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটে। খুনোখুনি সব দেশেই আছে, সমাজবিরোধী মানুষও আছে, কিন্তু পায়ুপথে পেটে বায়ু ঢুকিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা অপরাধের অভিনব সংযোজন। উঠতি বয়সী দু–একটি উচ্ছৃঙ্খল ও দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে আমাদের সমাজে সব কালেই ছিল। তারা অকাজ–কুকাজ করে তিরস্কৃত হয়েছে। কিন্তু কিশোর গ্যাং বলে কোনো সংঘবদ্ধ বাহিনীর কথা বাঙালি আগে এত শোনেনি।

একাত্তরে রাজাকার নামে ছিল রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী এক বিরাট ঘাতক বাহিনী। দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আরও দুটি সহযোগী বাহিনী ছিল—আলবদর ও আলশামস। কিশোর গ্যাং সম্পর্কে যেসব সংবাদ বেরোচ্ছে, তাতে মনে হতে পারে, এরা আলবদর ও আলশামসের চেয়ে কম দুর্ধর্ষ নয়। যারা পরিকল্পিতভাবে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে এবং অপরাধ করে তারা—তাদের বয়স কম–বেশি যা-ই হোক—খুব বড় সমাজবিরোধী।

এসব উঠতি বয়সী বিপথগামীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে তাদের সংশোধনাগারে নিয়ে আটকে রেখে শুধু কাউন্সেলিংও সমাধান নয়। পরিবারে ও সমাজে সবার সঙ্গে রেখেই তাদের উন্নত জীবনাদর্শে দীক্ষিত করা সম্ভব। সেটা সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য, কিন্তু তার কোনো বিকল্প নেই

পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীতেই কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ৬২। সারা দেশে সম্ভবত শতাধিক। বয়সের কারণে এদের বলা হয় কিশোর। কিশোর বলতে আমরা বুঝি সেই বালকদের, যাদের গোঁফ গজিয়েছে, তবে এখনো তা কামায়নি। কিশোরের সংজ্ঞা যা-ই হোক, তারা পুরুষ। পুরুষ তার পৌরুষ দেখাবে না, তা হয় না। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা তা দেখাচ্ছে। বঙ্গীয় সমাজে পেশিশক্তি অমূল্য সম্পদ। সেটা কিশোরেরা তাদের বড় ভাইদের দেখে দেখে জানছে। এ সমাজে যার পেশি আছে, অর্থবিত্ত তার পায়ে এসে পড়ে।

কিশোর গ্যাং স্বচক্ষে দেখার সুযোগ না হলেও সংবাদমাধ্যম থেকে যতটা জানতে পেরেছি, তাতে ধারণা করি তারা আমাদের সেই ষাট–সত্তর দশকের আন্ডারগ্রাউন্ড মাওবাদী সংগঠনগুলোর সদস্যদের মতো। তারা আছে আমাদের মধ্যেই, কিন্তু তাদের চেনা যায় না। তাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় তাদের কর্মে। সে কর্ম কখন কীভাবে সংঘটিত হবে, তা কেউ জানে না। এখন দেখা যাচ্ছে তাদের বহুবিধ কর্মের মধ্যে রয়েছে কিশোরীদের ওপর যৌন নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত। এসবের চেয়ে লঘু অপকর্ম তো অজস্র। এবং তাতে কোনো কোনো এলাকার মানুষ শঙ্কিত। কিন্তু দুঃসাহস করে প্রতিবাদ করবে এমন বুকের পাটা কারও নেই। বরং যখন তারা গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফোঁকে তখন অনেক উঠতি বয়সী মেয়ের বাবার বুক কাঁপে।

গ্যাংয়ের কিশোরেরা রাস্তার পিতৃমাতৃহীন অনাথ নয়, তারা বাস করে পরিবারে মা–বাবা ও অভিভাবকদের সঙ্গে। তারা কেমন ছেলে এবং তারা কী করে, তা তাদের অভিভাবকদের অজানা নয়। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রশ্রয় ছাড়া সন্তান বিপথে যেতে পারে না।

সমাজের অধিকাংশ মানুষই শান্তিতে বাস করতে চায় এবং দুষ্কর্ম অপছন্দ করে। খুব অল্পসংখ্যকই শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে। সমাজে শান্তি কোন গোত্র নষ্ট করল, তা বিচার্য বিষয় নয়—শান্তি ভঙ্গই অপরাধ। সে শান্তি ধর্মান্ধ জঙ্গিরা করুক, কোনো উগ্র রাজনৈতিক গোত্র করুক বা কিশোর গ্যাং করুক। যেসব কথিত প্রগতিবাদী মনে করেন শুধু ইসলামি উগ্রবাদী সন্ত্রাসীরাই সবচেয়ে খারাপ, কিশোর গ্যাং তত ক্ষতিকর নয়, তাঁরা খুব বড় ভুল করছেন। ইসলামি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী একটি রাজনৈতিক শক্তি। তার নির্দিষ্ট প্রতিপক্ষ আছে। সে প্রতিপক্ষ হতে পারে কোনো সরকার। শুধু প্রতিপক্ষই তার টার্গেট, অন্য কেউ নয়। কিশোর গ্যাংয়ের লক্ষ্য হতে পারে যে কেউ। গোটা সমাজ ও রাষ্ট্র।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দারা বিপথগামী কিশোরদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে পারেন; কিন্তু কী কারণে তারা এই অন্ধকার পথে এসেছে, তার ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ শুধু দক্ষ সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের পক্ষেই করা সম্ভব। সেই কাজটি যতক্ষণ না হবে, ততক্ষণ কিশোর অপরাধ নির্মূল সম্ভব নয়। বরং সংক্রামক রোগের মতো তার বিস্তার ঘটতে থাকবে।

কারও কারও বেলায় জেনেটিক ব্যাপার থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ উঠতি বয়সীর বিপথগামী হওয়ার জন্য আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ দায়ী। রাজনৈতিক নেতাদের দায় রয়েছে, তবে অভিভাবকদের দায়দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। মা–বাবাই সবচেয়ে বড় পুলিশ ও গোয়েন্দা। তাঁদের চোখ এড়ানো কোনো ছেলেমেয়ের পক্ষেই সম্ভব নয়। সুতরাং ভুল পথে যাওয়া কিশোরদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বও অভিভাবক, সমাজ ও রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।

শুধু কয়েকটি কিশোর গ্যাং নয়, আজ আমাদের যুবসমাজের একটি বড় অংশ পথভ্রষ্ট। তাদের সামনে কোনো নীতি, আদর্শ ও লক্ষ্য না থাকায় তারা অনেকে শুধু সমাজের ক্ষতির কারণ নয়, আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে। তারা নেশা করছে ও নানা রকম অপকর্ম করছে। সামান্য মতবিরোধ হওয়ায় সহপাঠীকে ছুরি মারছে। মেয়ে সহপাঠীকে রাস্তার মধ্যে চড় মারছে। সেদিন বোনের জন্মদিনে বন্ধুবান্ধব মিলে মদ পান করে দুই কিশোর মারা গেছে। রাষ্ট্র যদি মনে করে এসব খুব ছোট ঘটনা, তাহলে তা হবে খুব বড় ভুল।

জিডিপি বাড়া বা কমায় একটি দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়, সমাজ উন্নত কি না, সুখী ও সমৃদ্ধ কি না তার পরিচয় বহন করে না। সে জন্য ছোট দেশ ভুটান গ্রস ডমেস্টিক প্রডাক্ট বা জিডিপির চেয়ে গ্রস ডমেস্টিক হ্যাপিনেস বা জিডিএইচের ওপর জোর দিয়েছে। তাদের এই সিদ্ধান্ত পৃথিবীতে প্রশংসিত হয়েছে। একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র, কিন্তু তার সমাজ অধঃপতিত এবং মানুষেরা অসুখী, সে তো সোনার পাথরবাটি। শুধু বস্তা বস্তা টাকা থাকলেই একটি জাতি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও উন্নত সভ্যতার অধিকারী হতে পারে না।

কিশোর অপরাধ দমন করতে সব ক্ষেত্রে শাস্তি কোনো সমাধান নয়। এসব উঠতি বয়সী বিপথগামীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে তাদের সংশোধনাগারে নিয়ে আটকে রেখে শুধু কাউন্সেলিংও সমাধান নয়। পরিবারে ও সমাজে সবার সঙ্গে রেখেই তাদের উন্নত জীবনাদর্শে দীক্ষিত করা সম্ভব। সেটা সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য, কিন্তু তার কোনো বিকল্প নেই।


সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক