কিশোর গ্যাং কেন বাড়বে না?

রথী-মহারথীদের কুকীর্তির খবরই দেখতে থাকলে কিশোরদের মনোজগতে সত্য-সুন্দরের আগ্রহ কীভাবে তৈরি হতে পারে?
প্রথম আলো

ইদানীং পত্রপত্রিকায় ‘কিশোর গ্যাং’ বিষয়ে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু খবর বেরোচ্ছেই। সমস্যাটি যে করোনার মতোই মহামারি হতে চলেছে, খবরের সংখ্যা বেড়ে চলা থেকেই সেটি স্পষ্ট। ১৭ নভেম্বর প্রথম আলোয় খবর হয়েছে ‘রাজশাহীতে অপরাধ মোকাবিলায় ৪০০ কিশোরের তথ্যভান্ডার’। প্রতিবেদনে বর্ণনাও আছে কীভাবে ১৮ বছরের কিশোর বন্ধুদের সহায়তায় নিজের অপহরণ ঘটনা সাজিয়ে পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছে একজন। কীভাবে অনলাইন গেম পাবজির মাধ্যমে অন্য কিশোরীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে, ফেসবুক ও মেসেঞ্জারে অন্তরঙ্গ ছবি ও ভিডিও আদান-প্রদান করে এবং শেষে ব্ল্যাকমেল করার মতো অপরাধেও ঝানু হয়ে উঠেছে তারা।

প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘পুলিশ ওই কিশোর গ্যাংয়ের হাইটেক ডিভাইস থেকে ছবি ও ভিডিও উদ্ধার করে। ‘হাইটেক ডিভাইস’টি কী, জানা না গেলেও অনুমান করা সহজ যে পেশাদার অপরাধী হয়ে ওঠার সব রকম প্রস্তুতিও প্রশিক্ষণ নিয়েই তারা তারুণ্যে পা রাখতে যাচ্ছে। আরেকটি বিষয়ও খবর হচ্ছে। সেটি ‘পুলিশি ব্যবস্থা’। একই প্রতিবেদনমতে, রাজশাহীতে সাইবার ক্রাইম ইউনিট চালু হয়েছে। ‘এই ইউনিটের মাধ্যমে কিশোর অপরাধীদের শনাক্ত করে ছোট ছোট দলে ভাগ করে আইন বিষয়ে সচেতন করা হবে। তাদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করা হবে। পরিবারের সদস্যদের ডাকা হবে। তাঁরা মুচলেকা দিয়ে নিজ নিজ সন্তানকে নিয়ে যাবেন।’

কিশোর অপরাধের আইনকানুন সংগত কারণেই লঘু। একেবারেই সংশোধনমূলক। যখন বলা হচ্ছে, ‘আইন বিষয়ে সচেতন করা হবে, ওয়ার্কশপ করা হবে’, বুঝে আসে না আসলে কী হতে চলেছে? তাদের কী বলা হবে, অপরাধ করলে তোমাদের সংশোধনীকেন্দ্রে পাঠানো হবে, প্রবেশন ও প্যারোলের ব্যবস্থা থাকবে, তোমাদের অভিভাবকেরা মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবে? আমরাই-বা কী করে জানলাম যে অসচেতনতার কারণেই তারা অপরাধী হচ্ছে? কীভাবেই-বা জানলাম যে আইন জানা না থাকায় অপরাধে জড়াচ্ছে? এই সিদ্ধান্তেই-বা কীভাবে পৌঁছালাম যে সচেতনতার আসর এবং ওয়ার্কশপ করা হলে তারা আর অপরাধে জড়াবে না? যারা অনায়াসে খুন, ড্রাগ, পর্নোগ্রাফি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ইত্যাদি অপরাধে ইতিমধ্যেই হাত পাকিয়ে ফেলেছে, তাদের জন্য এই সব কর্মসূচির ফায়দা আসলে ঠিক কী কী হওয়া সম্ভব? হয়তো আইন রক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের এ-সংক্রান্ত গবেষণা করাই আছে, আমরা জানি না। হয়তো সাফল্যের উদাহরণও আছে, যা আমরা পত্রপত্রিকায় পাচ্ছি না। আম-নাগরিক হিসেবে অবশ্য আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, সাফল্যের উদাহরণই যদি থাকবে, তাহলে গাঙের জলের মতো কিশোর গ্যাং বাড়ে কীভাবে?

খানিকটা অন্যদিকে নজর ফেরানো যাক। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত কিশোরদের উদ্ভট চুল রাখা সহ্য করেননি। তাঁরা কাঁচি নিয়ে ঘুরেছেন তাঁদের দৃষ্টিতে উদ্ভট ও আপত্তিকর ঠেকা কেশবিন্যাসে জড়িত কিশোরদের শায়েস্তা করতে। চুল কেটে দেওয়া হচ্ছিল। কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও একই কাজ করেছেন বলে গত কবছর ধরে খবরে এসেছে। আমলে নেওয়ার মতো বিষয় এই যে অনেক অভিভাবক ভ্রাম্যমাণ আদালত ও শিক্ষকদের এই ধরনের অভিযানকে সমর্থন দিয়ে এসেছেন। সামাজিক মাধ্যমে এই পদ্ধতিকে স্থূল পদ্ধতি বলে দুয়েকজন পোস্ট দিয়েছিলেন। খুব মনোযোগ নিয়ে খেয়াল করে দেখেছিলাম বিতর্কের ধরন। অনেকেই নিজেদের অভিভাবক দাবি করে লিখেছেন, এই পদ্ধতিতে তাঁদের আপত্তি নেই। ঘরে সন্তান কথা শোনে না। তা ছাড়া মা অথবা বাবা কেউ একজন অন্ধভাবে কিশোরদের পক্ষ নেন। দুজন এখন আর বসে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এই রকম যখন অবস্থা, বাইরের হস্তক্ষেপ মন্দের ভালো হলেও ভালো।

জনসমক্ষে চুল কেটে দেওয়া বড়জোর অসম্মান-অপমান করা হতে পারে, অন্যের সামনে কিশোরদের হীনমান করা হতে পারে, সমস্যার সমাধান কোনোভাবেই হতে পারে না। চুল দিয়ে কিশোর অপরাধী চেনা যায় না।

প্রশ্ন উঠতে পারে, চুল কেটে দেওয়ার প্রসঙ্গের অবতারণা কেন করলাম! সমাজভাবনার সূত্রপাত করতে হলে খুবই সামান্য বা আপাত-অনুল্লেখযোগ্য বিষয় ধরে শুরু করলেই বড় সমস্যার কারণ খুঁজে পাওয়ার রাস্তাগুলো একে একে খুলে যেতে থাকে। জনসমক্ষে চুল কেটে দেওয়া বড়জোর অসম্মান-অপমান করা হতে পারে, অন্যের সামনে কিশোরদের হীনমান করা হতে পারে, সমস্যার সমাধান কোনোভাবেই হতে পারে না। চুল দিয়ে কিশোর অপরাধী চেনা যায় না। বয়সটি তরুণ হয়ে ওঠার আসল সিঁড়ি। হরমোনজনিত কারণেই এই বয়সের স্বাভাবিক চাহিদা বৈচিত্র্যমুখী। নিজেকে অন্যদের চেয়ে যাতে আলাদা করে চেনা যায়, সে জন্য কিশোর-কিশোরীরা পোশাক-আশাক ও কেশবিন্যাসে বৈচিত্র্য আনে। সুবিন্যস্ত পরিপাটি ভদ্রস্থ চুলের অসংখ্য কিশোর অপরাধী আছে। আবার উদ্ভট সাজসজ্জার অসংখ্য নিরীহ কিশোর-কিশোরীও আছে। একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের কিশোর মনস্তত্ত্বটুকুও জানা না থকলেই উদ্ভট কেশবিন্যাসকে অপরাধী কিশোরের লক্ষণ ভেবে নেওয়া সম্ভব।

সম্প্রতি কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটি গবেষণার জন্য প্রস্তুতিমূলক পাইলট গবেষণা করেছি। ই-মেইলে এবং ফেসবুকের মাধ্যমে অভিভাবক এবং কিশোরদের জন্য প্রশ্নপত্র উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আগ্রহী অভিভাবকদের অনেকেই সাগ্রহে যেচে প্রশ্নপত্র নিয়েছেন। তাঁদের আগ্রহই বলে দেয় যে কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে তাঁরা সমস্যায় আছেন এবং সমাধানেও আগ্রহী। দুই সেট প্রশ্নের এক সেট ছিল অভিভাবকদের জন্য। অপর সেট কিশোর-কিশোরীদের জন্য। প্রশ্ন একই। উদ্দেশ্য কোভিড-১৯ কিশোর-কিশোরী ও অভিভাবকদের পারস্পরিক সম্পর্কে কী রকম প্রভাব বিস্তার করেছে, সেটি জানা। গোপনে ও সম্পূর্ণ বেনামে সাক্ষাৎকারদানের জন্য টেলিফোন ও ই-মেইলে যোগাযোগের সুবিধা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। বলে নেওয়া ভালো, গবেষণাটি শুধু ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে মাথায় রেখে শুরু হলেও মফস্বল ও অসচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেও যোগাযোগ করেছেন। কিশোর-কিশোরীরা প্রশ্নপত্রে উত্তর পাঠায়নি বললেই চলে। তবে ফোনে কথা বলেছে। চোখ খুলে দেওয়ার মতো অনেক তথ্য দিয়েছেন। সেগুলো শুধু করোনাকালের সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং পুরো দেশের কিশোর সমাজের মনোজাগতিক দোলাচলের খানিকটা দরকারি বিবরণ হয়ে উঠেছে। তারা কেন গোপন পদ্ধতিতে আগ্রহী হচ্ছে? কারণ, তারা বয়স্কদের ওপর আস্থা হারিয়ে বসেছে। ওয়ার্কশপ আর আইনসচেতনতা কি এই আস্থার জায়গাটি তৈরি করে দিতে পারবে?

সামাজিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার জাদুর কাঠিটির নাম ‘পরিবার’। উন্নয়নের অস্বাভাবিক ধাক্কায় পরিবারব্যবস্থা ভেঙে চুরমার হওয়ার দশা। কিশোর-কিশোরী ও অভিভাবকের সম্পর্ক তীব্র মাত্রায় দ্বান্দ্বিক হয়ে উঠছে। সহমর্মিতা ও সহযোগিতার ধ্রুপদি চরিত্রটি ধনী-গরিব সব পরিবারকাঠামো থেকেই দ্রুত বিলীয়মান হয়ে পড়ছে। ১৭ নভেম্বরের প্রথম আলো শেখ সাবিহা আলমের ‘নজর নেই, কিশোর অপরাধ বাড়ছে’ শিরোনামে অত্যন্ত সময়োপযোগী একটি দীর্ঘ প্রতিবেদনও ছেপেছে।

কিশোরদের আরও হাজারো সমস্যা আছে। কিন্তু গুরুত্ব পাচ্ছে শুধু ‘গ্যাং সমস্যা’ ও ‘কিশোর অপরাধ’। ‘রাজনীতিসম্পৃক্ততা’ কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। রাজনীতিসম্পৃক্ততা কমানোর কোনো সরকারি উদ্যোগ কেউ কি কখনো দেখেছে? উন্মুক্ত খেলার মাঠ এখন ছবিতেও দেখতে পাওয়া যায় না? রাষ্ট্রের তরফে বিকল্প ব্যবস্থার চিন্তার কথা কেউ কখনো শুনিনি। পাড়ায় পাড়ায় শিশুতোষ লাইব্রেরি আছে কি? সারা দেশে একসময় শিশু-কিশোর সংগঠনের অভাব ছিল না। যে গুটিকয় মূলধারার দৈনিক পত্রিকা ছিল, সেগুলোরও শিশুপাতাভিত্তিক সংগঠন ছিল। কিশোর ম্যাগাজিন একটি বিলুপ্তপ্রায় ধারণা। কয়টি টিভি অনুষ্ঠান আছে কিশোরদের জন্য? ইন্টারনেটসহ সামাজিক মাধ্যমে কিশোরদের জন্য বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষামূলক আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর জন্য রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার কথা কি কেউ কখনো শুনেছে? কিশোর-কিশোরীদের চোখে অনুকরণীয় হবেন, এমন একজন রোল মডেলও কি আছেন? পত্রিকার পাতা, ইন্টারনেট ঘেঁটে রথী-মহারথীদের কুকীর্তির খবরই দেখতে থাকলে কিশোরদের মনোজগতে সত্য-সুন্দরের আগ্রহ কীভাবে তৈরি হতে পারে? পরিবারেই অভিভাবকেরা আর সম্মানের আসনে নেই। কিশোর বয়সীরাও জানে তাদের পিতামাতারা অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অননুকরণীয়। ফলাফল কৈশোর বিপর্যয়।

অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্যও আছে প্রথম আলোর দীর্ঘ প্রতিবেদনটিতে। কিশোর অপরাধ দমনে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি শিশুকল্যাণ বোর্ড রয়েছে। টাইটানিক সাইজের এই বোর্ডে জাতীয় সংসদের স্পিকার মনোনীত একজন এবং সরকার ও বিরোধী দলের দুজন নারী সাংসদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ ১৭ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা আছেন। তবে শিশুদের অপরাধে জড়িয়ে পড়া বিষয়ে তাঁরা আজ পর্যন্ত কোনো গবেষণা করাননি (সমাজকল্যাণসচিব)।

এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি জানার পর এই কলামে কিশোর অপরাধ নিয়ে আর কোনো কিছু না লিখলেও চলে।

হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।