কিশোর গ্যাং দমনে বাধা যখন শিশু আইন

শিশু আইন, ২০১৩ নিয়ে জটিলতা রয়েছে। কিশোর গ্যাং-এর উদ্ভব ও বিস্তার নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো হিমশিম খাচ্ছে। আইনের বিভিন্ন ধারাকে কিশোর অপরাধ দমনে অন্তরায় মনে করা হচ্ছে। প্রথম শিশু আইনটি ছিল বেঙ্গল চিলড্রেন অ্যাক্ট, ১৯২২। সেটি রহিত করে হয় শিশু আইন, ১৯৭৪। সম্প্রতি সেটি রহিত করে কিছু পরিবর্তনসহ শিশু আইন, ২০১৩ প্রণীত হয়েছে। আইনে ‘শিশু’র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে ‘এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে অনূর্ধ্ব-১৮ বছর পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু গণ্য হইবে।’ আইনটির মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কল্যাণ এবং শিশু অপরাধীদের বিচার। আইনে অনাবশ্যকভাবে ‘ভিকটিম শিশু’কে ‘আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু’ এবং ‘শিশু অপরাধী’কে ‘আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশু’ বলা হয়েছে।

আইনে ‘শিশু’ ও ‘কিশোর’-এর প্রভেদ স্পষ্ট নয়। পেনাল কোড, ১৮৬০-এর ৮২ ধারামতে ৯ বছর পর্যন্ত কোনো শিশু অপরাধ করতে পারে না। ৮৩ ধারামতে, ‘৯ বছরের অধিক এবং ১২ বছরের নিম্নের কোনো শিশু কর্তৃক কৃত কোনো কর্ম অপরাধ হবে না, যদি মনে করা হয় কর্মটি যে অপরাধ উহা অনুধাবন করার মতো পর্যাপ্ত মানসিক পরিপক্বতা শিশুটির ছিল না।’ ৯ বছর অতিক্রম করে শিশু কিশোর হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত সে অপরিপক্ব কিশোর গণ্য হতে পারে। এ কারণেই ১৯৭৪ সালের শিশু আইনে ‘চাইল্ড অফেন্ডার’-এর স্থলে ‘ইউথফুল অফেন্ডার’ এবং ‘চাইল্ড কোর্ট’-এর স্থলে ‘জুভেনাইল কোর্ট’ বলা হয়েছিল।

পেনাল কোড-মতে, ৯ বছর হলেই একটি শিশু অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার জন্য পূর্ণবয়স্ক গণ্য হতে পারে। ১২ বছর হলেই শিশু পুরোপুরি পূর্ণবয়স্ক। রহিত আইনে শিশুর বয়স ছিল অনূর্ধ্ব-১৬ বছর। ১২ থেকে ১৮ তথা ৬ বছরের এই ব্যবধানের সমন্বয় কঠিন। পেনাল কোড, ১৮৬০-এর ৪০ ধারামতে ‘অপরাধ’ হচ্ছে আইনের অধীন শাস্তিযোগ্য কোনো কর্ম। আইনি ব্যাখ্যার প্রধানতম আইন জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট, ১৮৯৭-এর ৩৭ ধারামতেও ‘অপরাধ’ হচ্ছে কোনো কর্ম, যা প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য।

১৫ ধারার বিধানমতে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র ও বিচার ভিন্ন ভিন্ন হবে। কোনো একটি অপরাধে সময়, স্থান, সংশ্লিষ্ট ঘটনাপ্রবাহ, শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদের সমন্বিত ভূমিকা এমন অবিচ্ছেদ্যভাবে বিজড়িত থাকে যে আলাদা করে বিচার অনুষ্ঠান দুষ্কর। সাক্ষী, সময়, ঘটনাস্থল, অপরাধ সবই অভিন্ন। ফলে অপরাধের ভিন্ন ভিন্ন বিচার হলে সাক্ষীরা মতিভ্রমহেতু বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, অসত্য বা প্যাঁচালো সাক্ষ্য প্রদান করে দুটো সত্য মামলাকেই অসত্য প্রতিপন্ন করতে পারে। অপরাধ চক্রের জন্য অপরাধপ্রবণ কিশোরেরা হয়ে উঠতে পারে সদস্য সংগ্রহের উর্বর ক্ষেত্র।

খুনের মামলায় এমনও হতে পারে, পুলিশ যখন ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগপত্র দাখিল করল, তখন প্রাপ্তবয়স্ক দুজন অপরাধীর বয়স ৪০-এর অধিক এবং দুজন শিশু অপরাধীর বয়স যথাক্রমে ১৭ বছর ও ১৭ বছর ৬ মাস। বিচারক যখন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করলেন, তখন শিশু অপরাধীদ্বয়ের বয়স যথাক্রমে ১৭ বছর ৯ মাস ও ১৮ বছর ৩ মাস। মোট সাক্ষী ১৫ জন। ১ জন সাক্ষীর জবানবন্দি ও জেরা শেষ হতে হতে ১৭ বছর ৯ মাস বয়স্ক শিশুর বয়স ১৮ অতিক্রম করল। ১৪ জন সাক্ষীর পরীক্ষা বাকি রয়েছে। এ অবস্থায়ও কি বিচার ভিন্নভাবে চলবে, না একীভূত হবে। দোষী সাব্যস্ত হলে দণ্ডারোপের মানদণ্ড কী হবে? কারাদণ্ড হবে না আটকাদেশ হবে? আইনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এমন অসংখ্য জটিল অবস্থার উদ্ভব হতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিভক্ত বিচারের প্রয়োজন নেই। দৈনন্দিন বিচারকার্য স্বল্প সময়ের জন্য হয়ে থাকে। শিশু অপরাধীকে ডকে না তুলে অভিন্ন বিচারে একই আদালতে আলাদাভাবে বসতে বা দাঁড়াতে দিলেই উদ্দেশ্য অর্জিত হতে পারে। প্রয়োজনে ক্যামেরা ট্রায়াল হতে পারে। শিশু আইনের ৭০ থেকে ৮৩ পর্যন্ত ১৪টি ধারায় উল্লিখিত প্রাপ্তবয়স্কদের দ্বারা শিশু-কিশোরদের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধগুলো বিচার ও দণ্ড শিশু আইনের অধীন হবে। বিষয়টি বিসদৃশ। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ কার্যকর থাকতে উল্লিখিত ১৪টি ধারায় অপরাধগুলো প্রয়োজনে সেখানে সন্নিবেশিত হতে পারত। আইনের ৩৩/৩৪ ধারামতে কিশোর অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং কারাদণ্ড প্রদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারাদণ্ডকে ‘কারাদণ্ড’ না বলে বলতে হবে ‘আটকাদেশ’। তবে অপরাধ মারাত্মক, গুরুতর, জঘন্য বিবেচিত হলে আটকাদেশ না দিয়ে কারাদণ্ড দেওয়া যাবে। ‘মারাত্মক’, ‘গুরুতর’, ‘জঘন্য’ ইত্যাদি নির্ধারণ করা হবে আদালতের জন্য বাড়তি জটিলতা।

আইনেই বলা যেতে পারত যে অপরাধের শাস্তি ১০, ১২ বা ১৪ বছরের অধিক কারাদণ্ড হলে তা ‘মারাত্মক’, ‘গুরুতর’, বা ‘জঘন্য’ অপরাধ গণ্য হবে। ১৭ বছর বয়সে খুন করে জামিনে থেকে ২৫ বছর বয়সে পুনর্বার খুন করলে দণ্ডবিধির ৭৫ ধারা কিংবা ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ৫৬৫ ধারা প্রযোজ্য হবে না; এবং ২৫ বছর বয়সে দণ্ডিত হয়ে অব্যবহিত পরেই যেকোনো পদে নির্বাচিত হতে কোনো আইনে অযোগ্য হবেন না। দণ্ডিত শিশুর অযোগ্যতা অপসারণ সম্পর্কিত ৪৩(খ) ধারার এমন সব অতি-উদার বিধান কাউন্টার-প্রোডাকটিভ হতে পারে। কিশোর-অপরাধের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি অতীব নমনীয় না হয়ে সার্বিক জননিরাপত্তার স্বার্থে বস্তুনিষ্ঠ হওয়া বাঞ্ছনীয়। শিশুর অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে কি না, আইনে তা-ও স্পষ্ট করা হয়নি।

আইনে ‘আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু’ এবং ‘আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশু’ না বলে সহজ পরিভাষায় ‘ভিকটিম শিশু’ এবং ‘শিশু অপরাধী’ বলা প্রয়োজন। ‘শিশু অপরাধ’-এর স্থলে ‘কিশোর অপরাধ’ বলা বাঞ্ছনীয়। কিশোর অপরাধ-সংশ্লিষ্ট সব বিষয় এই আইন থেকে সরিয়ে দণ্ডবিধি আইন, ১৮৬০ এবং ফৌজদারি কার্যবিধি আইন, ১৮৯৮-এ সন্নিবেশিত করা যেতে পারে। কিশোর অপরাধীদের নির্দোষ বা নিরপরাধ সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের সঙ্গে একত্রে শিশুকল্যাণ বোর্ডের অধীন আশ্রম বা সংশোধন কেন্দ্রে রাখা হলে তারাও অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন বিচারের বিধান রহিত করা না হলে দেশের বিপন্ন অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও বিচারব্যবস্থা আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়তে পারে। পুলিশ ও প্রবেশন কর্মকর্তার দ্বৈত ভূমিকার জটিলতা পরিহার করে কিশোর অপরাধীদের প্রচলিত নিয়মে পুলিশ, আদালত এবং কারাগারের অধীনে ন্যস্ত করে কিশোর অপরাধীদের জন্য বিশেষ সুবিধা দিয়ে বিশেষ বিধানসমূহ প্রচলিত সংশ্লিষ্ট অপরাধ আইনসমূহেই সন্নিবেশিত করা যেতে পারে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাই আইনের মুখ্য বিষয়বস্তু হওয়া বাঞ্ছনীয়। সুবিধাবঞ্চিত শিশু এবং কিশোর অপরাধীকে অভিন্ন মানদণ্ডে বিবেচনা করা সমীচীন হয়নি। ‘শিশু আইন’ শিরোনাম পরিবর্তন করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ‘শিশু কল্যাণ আইন’ করা যেতে পারে।

কাজী হাবিবুল আউয়াল সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব