কিশোয়ারের হাত ধরে আলিশান রেস্তোরাঁয় ঢুকছে পান্তা?

মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় রন্ধনশিল্পী কিশোয়ার চৌধুরী ও তাঁর পান্তা

করোনার মধ্যে দেশ, রাষ্ট্র কিংবা জাতিগতভাবে পরিচিত হয়েছে অনেক কিছুর নাম। যেমন উহান, ইন্ডিয়ান ভেরিয়েন্ট, ইউকে ভেরিয়েন্ট, উইঘুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তাদের সঙ্গে আরও আছে মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া। যদিও অস্ট্রেলিয়া বললেই চলে আসে সিডনি অস্ট্রেলিয়ার কথা।

ধরেই নিচ্ছি, আমরা সবাই জেনে গেছি মাস্টারশেফ কী। তাই এ নিয়ে আর এগোবার তেমন দরকার নেই। এই সিজনের আগে মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া নিয়ে আমাদের মধ্যে এত বেশি কানাঘুষা হয়েছিল কি না, তা আমি নিশ্চিত নই। কারণ, এর আগেও এই একই অনুষ্ঠানে আরও একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক অংশ নিয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো এবার কেন এত বেশি শোরগোল?

তবে কি কিশোয়ার চৌধুরী নামের এই ভদ্র মহিলার জন্য? তথাকথিত পড়ালেখা জানা আমাদের পরিচিত-অপরিচিত আপা, ভাবি, বোন, মা-খালাদের মতো জীবনের শুরুতে বাবার ‘অ্যাপল অব মাই আই’ হয়ে, পড়ালেখা করে, তারপর বাচ্চাকাচ্চার মা বনে গিয়ে—উন্নত নাগরিক তৈরির বোঝা কাঁধে নেওয়া এই বিশেষ শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব করায়? যাদের জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটে চার দেয়ালের মধ্যে। সে তা ঘর সামলানোর জন্য হোক, হোক রান্না করার জন্য বা ঘর নিয়ে অবিরত চিন্তায়।

গার্হস্থ্যবিজ্ঞানের প্রতিটি অনুষদের প্রধানের দায়িত্ব নিজের করে নেওয়া এই প্রজাতির নামই কিশোয়ার। তিনি কখনো বোন, কখনো ভাবি, কখনো মা, খালা কিংবা প্রিয়তমা। এমন কিশোয়ার আমাদের চিরপরিচিত। এই অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত আমার নিজের বোন, আমার ভাবি ও আমার প্রিয় বন্ধুরাও, যাঁরা জীবিকার জন্য ছেড়েছেন দেশ। হয়েছেন জায়া-জননী। যাঁরা মায়ের সঙ্গে থাকার সময় কোনো দিন ভুলেও রান্না ঘরে যাননি। তবে এখন সবাই চমৎকার রান্না করেন। এই গল্প কি খুবই কমন নয়? বিদেশে গিয়েই তাঁরা রান্না করেন, সত্যি বলতে খুব ভালো করেন। এর কারণটা যে কী, সে উত্তর অজানাই!

আমার বোনকে আমি আমার মায়ের সঙ্গে ফোনে যত ঝগড়া করতে শুনেছি, তার থেকে বেশি শুনেছি চুলায় রান্না দিয়ে আটকে যাওয়ার পর কী করতে হবে, তার সমাধানের জন্য শরণে। এসব শুরুর দিকের কথা, যখন ইউএস রোবোটিকসের ডায়াল আপ মোডেম দিয়ে ইন্টারনেটে যেতে হতো। ঘটমান বর্তমান একেবারেই আলাদা। বিরিয়ানির দম যে ওভেনেও দেওয়া যায়, সে আমার বোন নিজেই শিখে নিয়েছেন।

ওভেন শুধু কেক-রুটি-পিৎজা পাকাবার জন্যই যে নয়, তাঁরা রপ্ত করে নিয়েছেন নিজে থেকেই। রাইস কুকারে পোলাও? আলবত তবদা খাওয়ার মতো খিচুড়ি! এগুলোর সবই পরিচিত বাংলার প্রায় প্রতিটি ঘরে। সে ঘর জাপানে হলেও কী, সাসকাচুয়ানের বিস্তীর্ণ সমভূমিতে হলেই-বা কী! খাবারের ধরনে কিছুটা পরিবর্তন এলেও এমন বিভুঁইয়ের ঘরে বাংলা খাবার না খাওয়ার রীতি এখনো তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না। এ যদিও আমার ধারণামাত্র।

স্থানের পরিবর্তনের সঙ্গে যেমন অনেক কিছু বদলাতে থাকে, বিভিন্ন খাবারের প্রতি টান বা আগ্রহও তৈরি হতে থাকে। আর হালের ফাস্টফুডের দুনিয়ায় ভাত ছাড়াও অন্য কিছু রোজ দিনে একবার হলেও খায় না, এমন মানুষ পাওয়া খুব কঠিন। সেটা আমেরিকার মানুষ হোক কিংবা গোয়ালন্দ ঘাটের মাঝি। কিন্তু আদতে আমরা কি খুব বেশি দিন নিজেদের পরিচিত খাবার না খেয়ে থাকতে পারি বা পেরেছি? আমার উত্তর—পারা খুব কঠিন। স্থান-কালের সঙ্গে পরিচিত খাবারের উপকরণেও পরিবর্তন এসেছে। নতুন মসলার যোগ হয়েছে, নতুন ধরনের স্বাদ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। সেটা চেতন কিংবা অবচেতনভাবে হলেও।

তাই কিশোয়ার নামের বাঙালি কন্যা-জায়া-জননীকে টিভির পর্দায় দেখে তাঁর মতন অনেকে সেঁটে গেছেন স্ক্রিনে! বিচারকেরা যখন জানতে চেয়েছেন, ‘এত দিন কোথায় ছিলে তুমি?’ তার উত্তরে কিশোয়ার বলেছেন, ‘জাস্ট অ্যাট হোম।’ ভিজে গেছে স্ক্রিনের দুই পার।

এই আনন্দাশ্রু কি শুধু কিশোয়ারের ছিল? আমরা কেউ এমন করে ফিল করিনি? যদি তা না-ও হয়, তবে কিশোয়ার হিসেবে কেউবা নিজেকেই দেখেছেন, কেউ দেখেছেন তাঁর প্রিয় মেয়েকে কিংবা পুত্রবধূকে। কেউবা তার মাকে কিংবা বোনকে। কিশোয়ার হয়ে উঠেছেন বাঙালি ঘরের অনুচ্চারিত, কিঞ্চিৎ অবহেলিত, একেবারেই অস্বীকৃত, অপুরস্কৃত সম্প্রদায়ের আইকন।

কথায় আছে, যাঁদের রান্নাঘর যত বেশি নোংরা, তাঁদের খাবার নাকি তত বেশি মজাদার। এ একেবারে দেশি অনুযোগ। খাবার নিয়ে আমাদের আদিখ্যেতায় একটি পালকমাত্র। পরিবেশ পরিস্থিতিতে যেকোনো চেনা জিনিসে পরিবর্তন আসে। কিশোয়ার যা করেছেন, তা আদতেই বাস্তবসম্মত ও স্বাভাবিক। আমাদের চেনা পরিচিত খাবারগুলোকে যে এভাবেও নিয়ে আসা যায়, তা-ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, সর্বজনীনের জন্য তা-ই প্রকাশ করেছেন কিশোয়ার। বিশাল সম্মানের ব্যাপার। কেননা খাবার প্রকৃতই স্বকীয়তার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ, যা কিনা একটা জাতি, দেশ, ভূখণ্ডকে পরিচিতি দেয়। আইডেনটিটি, যা খাবারের মাধ্যমে তার খাদকদের দেয় একটা গ্লোবাল স্ট্যাটাস। কিশোয়ার আমাদের সেই সুবিধা দিলেন, সুযোগ দিলেন, যা আমাদের জন্য জরুরি ছিল।

যিনি রাঁধেন, তিনি শুধু আমরা খাব বলেই যে রাঁধেন, তা নয়। তাঁকে নিজের সব থেকে ভালোটা বের করে নিয়ে আসতে হয়। এ সবকিছুর মধ্যে যাতে উপকরণের বৈচিত্র্যও বেশি থাকে না। একই মাছ রোজ আমরা খাব না। কিন্তু ওই একই মাছ কতভাবে যে রান্না করা যায়, তা অঞ্চলভেদে, ব্যক্তিভেদে পালটে যায়। যদি একেবারে গ্রামবাংলার কথা ধরা হয়—পুরো প্রক্রিয়ায় মৌলিক একটা ব্যাপার থাকে। রান্নার এই শৈল্পিক নির্মাণে আমরা ভিন্ন দেশের খাবার নিয়ে যে আস্ফালন দেখাই, নিজেদের বেলায় তার খানিকটা ব্যত্যয় ঘটে বৈকি!

কিশোয়ার যখন তার গ্র্যান্ড ফিনালেতে পান্তা রাঁধলেন, কিছুটা কষ্ট পাওয়ার মতন ব্যাপার। এত এত জিনিস করে শেষ খেলায় কেন এই পান্তা, কেন বাবা! পান্তার অনেক বাহবা এখন এলেও এ যে বাহবা পাওয়ার মতন কোনো খাবার নয়, তা হয়তো ভুলে যাওয়াই হয়েছে। পান্তা কেন করা হয় বা পান্তা কেনই-বা এল, এই প্রশ্নের উত্তর উইকিপিডিয়াতে মিলছে না। খানিকটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেল নানি-দাদি গোছের মানুষের সঙ্গে কথা বলে।

বস্তুত রাতের খাবারে ভাত বেশি হলে, তাতে পানি ঢেলে রাখা হতো। এ অনেক আগের কথা নয়। এখনো হয়ে থাকে। যদিও-বা ফ্রিজ এ ঘটনায় অনেকটা অন্তরায় ঘটিয়েছে, তবে ব্যাপার এমনই। বিশেষত গরমকালে বাড়তি ভাত সকাল পর্যন্ত থাকবে না বা নষ্ট হয়ে যাবে। তার জন্য ভাতের হাঁড়িতে নেওয়া হতো পানি। এ পানির পরিমাণও আছে নির্দিষ্ট। যাতে নাকি পান্তার স্বাদের ফারাকও তৈরি হতো। মাটির হাঁড়ি, সিলভারের (অ্যালুমিনিয়াম) হাঁড়িতে রান্না করা পান্তার ধরনও নাকি আলাদা হবে। আবার কোন চালের ভাত, কেমন পরিমাণ রান্না করা, ভাত হয়ে যাওয়ার পর ভাত শক্ত নাকি নরম, তাদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পানি দেওয়া হবে। তারপর কী দিয়ে খাওয়া হবে, সেটাও মাথায় রাখতে হতো। যদি সালুন (তরকারি) থাকে, তবে পানি কম আর যদি নুন দিয়ে পান্তা খাওয়া হয়, তবে তাকে বেশি নরম করার পালা।

পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে পান্তা খুব কমন একটা খাবার। ধান কাটা ও মাড়ার সময় কৃষকের লাঞ্চ মেন্যুতে পান্তা আনকমন এখনো নয়। পান্তা খুব ইজি। পান্তা খুব সিম্পল। পান্তা কষ্ট ইফেক্টিভ। পান্তা কোনো দিনও ‘পশ’ নয়। এর ওপর আমরা ঘি ছিটিয়ে দিলেও সে পান্তাই। এর মাঝে রাজকীয়তা নেই। ভণিতা নেই। পান্তা প্রয়োজনীয়তা আর ক্ষুধা নিবারণের নিয়ামকমাত্র। এর থেকে বেসিক কিছু হয় না। এর সঙ্গে কেবল শাড়ি বা ধুতিরই তুলনা করা চলে। একটা কাপড়কে আপনি কতভাবে পরতে পারেন, তা যাঁরা পরেন, তাঁরাই ভালো জানেন। দেখতে যদিও অবিকল এক লাগে। কিন্তু খানিক এদিক-ওদিক হলে আপনি নিজেকে যেভাবে প্রকাশ করতে চান, ঠিক তা-ই ফুটিয়ে তুলতে পারেন। উপকরণ একটিমাত্র থান কাপড়, যাকে আমরা শাড়ি বলি। এর থেকে সিম্পল কোনো পরিধিও আছে কি না, জানি না। পান্তাও ঠিক এমন। এর চেয়ে সাধারণ কিছু হয় কি না, জানি না!

কিশোয়ার গ্র্যান্ড ফিনালেতে এই পান্তাই করলেন। উনি তো কত কিছুই করতে পারতেন। মাছ পটোলের দোলমা, কলার মোচার চচ্চড়ি, ডার্ক চকলেট দিয়ে ভাপা পিঠা, মাংসের কুচি দেওয়া ফ্রেঞ্চ গ্যালেট বা মোগলাই পরোটা! কত কত সম্ভার! যিনি পানের ওপর আইসক্রিম ফেলার সাহস করেন, তিনি সবই পারেন। কিন্তু কিশোয়ার যে আটকে গেলেন পান্তায়। যখন উনি এত কিছু পারেন, তখন পান্তার সিদ্ধান্তটা হটকারি কি না, বলা মুশকিল।

খেলার শেষ সর্গে সবাই তাঁদের সেরাগুলো দিলেন। আমাদের কিশোয়ার দিলেন ফ্যান্টম পাঞ্চ। উনি মহাবীর মোহাম্মদ আলির মতো সনি লিস্টনকে পরাজিত করতে পারেননি। তৃতীয় হয়েও সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে এমন এক খাবারের ফুট প্রিন্ট রেখে দিলেন, যা নিয়ে আগে কেউ কথা বলেনি। পান্তা-ইলিশের তকমা হালের ‘ওয়ান ডে স্ট্যান্ড’ হলেও বিশ্বদরবারে এর সিগনিফিকেন্স নেই একেবারে।

সেখানেই কিশোয়ারের বিজয়। এই সাহস মিশেলিন স্টাররা করবেন না। এই সাহস মুকুট হারাবার ভয়ে কেউ দেখাবেন না। অপরিচিত, অরাজকীয়, অপ্রশংসিত একটা খাবারকে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য যে স্বকীয়তার তাড়না কাজ করে, তা প্রকাশ করার সাহস সবার থাকে না। এটাই কিশোয়ারের ফ্যান্টম পাঞ্চ। কিশোয়ারের সর্বত্র বিজয়। উনি গ্র্যান্ড ফিনালের মতো ভালো সুযোগ আর হাতছাড়া করেননি।
থ্যাংক ইউ কিশোয়ার। হয়তো-বা কোনো দিন পিকিং ডাকের সঙ্গে বং পান্তাও শোভা পাবে আলিশান রেস্তোরাঁর লেটার প্রেসে প্রিন্ট করা মেন্যুগুলোতে।

আপনার জয় হোক।

মুনতাসির মামুন ভূপর্যটক