কী কী লেখা যাবে না

অনন্ত জলিলকে দুটো কারণে পছন্দ করি। এক: তিনি একজন স্বনির্মিত মানুষ। দুই: নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি কোনো অসততা করেননি। এ ছাড়া তাঁর পরোপকারিতার কথাও শুনেছি। তিনি অতিনাটকীয় অভিনয় করেন কি না বা তাঁর সমাজসচেতনতা কতটুকু, এসব আমার কাছে তেমন বিবেচ্য নয়।

কিছুদিন আগে হঠাৎ দেখলাম তাঁর একটি বক্তব্য নিয়ে তুমুল হইচই চলছে। তিনি এতে ধর্ষণের কিছু কারণের মধ্যে নারীর পোশাককে দায়ী করেছেন। তাঁর এ বক্তব্য ভুল এবং অগ্রহণযোগ্য। নোয়াখালীর সুবর্ণচর, সিলেটের এমসি কলেজ আর বেগমগঞ্জের বর্বরোচিত ঘটনাগুলো এর প্রমাণ। তাঁর বক্তব্যে কেউ কেউ ন্যায্য সমালোচনা করেছেন। কিন্তু অনেকে এমন তেড়েফুড়ে এসেছেন যে বিস্মিত হয়েছি। মনে হয়েছে এই মানুষগুলো আরও অনেক বড় অপরাধীদের ক্ষেত্রে (যাঁরা ধর্ষকদের পালনকর্তা, রক্ষক ও বেনিফিশিয়ারি) এভাবে সোচ্চার হন না কেন? কেন তাঁদের প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলেন সযতনে?

উত্তরটা সম্ভবত আমরা অনেকে জানি। এ দেশে সিংহভাগ মানুষ এখন প্রতিবাদটা করেন শুধু তা নিরাপদ মনে হলে। অনন্ত জলিলকে তুলাধোনা করলে মামলা, হামলা বা কোনো ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ধর্ষকদের বা অন্য অপরাধীদের (ব্যাংক লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী) পালনকর্তা, রক্ষক ও বেনিফিশিয়ারিরা অতি ক্ষমতাশীল। তাঁদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে সমস্যা হবে। তার চেয়ে বরং অনন্ত জলিল বা ধরা পড়ার পরের সাহেদ বা জি কে শামীমকে ধুয়ে ফেললে নিরাপদ থাকা যাবে, নিজের ‘উচ্চ নৈতিকতাবোধ’ ও ‘প্রগতিশীলতা’র একটা প্রকাশও ঘটানো যাবে। আমার ধারণা, এমন মনোভাব কাজ করে অনেকের ভেতর। বিড়াল মলত্যাগ করে নরম মাটিতে। আমরা এখন বাঘের জাতি থেকে বিড়ালে পরিণত হয়েছি।

২.

আমি নিজেই–বা কম কিসে! একটা সময় ছিল, পত্রিকার কলাম লিখতে বসলে মন খুলে লিখতাম। যা লিখতাম তাই ছাপানোও হতো। আর এখন লেখার আগে ক্লান্তিময় লড়াই চলে নিজের ভেতর। কী লিখলে মামলা হতে পারে, কী লিখলে অপপ্রচার বা আরও নানা সমস্যা সেটা নিয়ে চিন্তা করে করে বিমর্ষ হই। না ছাপানো গেলে শুধু শুধু লিখে লাভ কী—এটা ভেবে থেমে থাকি মাঝেমধ্যে।

আমার ধারণা, অন্য অনেকেরও একই অবস্থা। যাঁদের লেখা আমি পাঁচ–সাত বছর আগেও অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পড়তাম, তাঁদের অনেকে বিবর্ণ ও পানসে হয়ে গেছেন তাই। আমাদের বাক্‌স্বাধীনতা শুধু নয়, চিন্তার চর্চাও সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে নানাভাবে।

মনে মনে ঠিক করি কী লিখব, কী লিখতে পারি না। কী কী লিখতে পারি না তার তালিকা বিশাল। বিষয় হিসেবে সেগুলো গুরুত্বপূর্ণও। রাখঢাক করে তার একটা তালিকা দিই।

৩.

দুদিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশ এবং বিদেশ থেকে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকার, জনপ্রতিনিধি, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের নিয়ে অসত্য, বিভ্রান্তিকর ও উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে। বলা হয়েছে এ ধরনের অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু যা কিছু প্রচার হচ্ছে তা আসলে কতটুকু অপপ্রচার, কতটুকু সত্যি এ নিয়ে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ তদন্তও প্রয়োজন। এ বিষয়টি নিয়ে আমি বিশদভাবে লিখতে গেলে যেসব তথ্য অপপ্রচারিত হচ্ছে, তার কিছুটা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। কিন্তু আমি জানি এটা করা যাবে না।

লেখা বা বলার জন্য আরও হুঁশিয়ারি আমরা পাই সরকারের কাছ থেকে। যেমন ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন চলাকালে হুমকি দেওয়া হলো এ আন্দোলন থেকে সরকারের পদত্যাগ চাওয়া হচ্ছে কেন? এর আগে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ও আন্দোলনকে সরকার পতনের দিকে প্রবাহিত করার ষড়যন্ত্রের বিষয়ে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল। সরকার পতনের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন কেন করা যাবে না (বা সরকারের পদত্যাগ কেন চাওয়া যাবে না), এ প্রশ্ন তুলে আমি এ দেশের সংবিধান ও রাজনৈতিক আন্দালনের পরিপ্রেক্ষিতে একটা লেখা লিখতে চাই। কিন্তু জানি সেটাও করতে হবে রেখেঢেকে।

এমন আরও বহু জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে অদৃশ্য চোখ রাঙানো আছে। বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, প্রয়াত নেতাদের মূল্যায়নে মুক্তচিন্তা বিপজ্জনক, সাগর-রুনি, তনু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয় না কেন, এ নিয়ে বেশি বলা ঝামেলাজনক, সরকারি দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে উচিত কথা বলা সমস্যাসংকুল।

কী কী বিষয় নিয়ে লেখা যাবে না, বলা যাবে না—তার তালিকা আরও অনেক বড়। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে এর কোনো কোনোটির উল্লেখ করার পরিবেশ পর্যন্ত নেই দেশে এখন। মাসখানেক আগে ড. শাহদীন মালিক একটি আলোচনা সভায় বলেছিলেন, সমালোচনা করার ক্ষেত্রে এ দেশে কোনো কোনো লোকের নাম মুখে আনাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা জানি, তিনি অসত্য বলেননি।

এ অবস্থাটা দেশে ছিল না ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে পর্যন্ত। এর প্রায় ৩০ বছর আগে থেকে নিয়মিত পত্রিকা পড়ি। মনে পড়ে না আগে কোনো সরকারের আমলে কাউকে এভাবে ছাড় দেওয়া হতো গণমাধ্যমে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের অতি ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে লেখা যেত পত্রিকায়। আমি নিজে এমন লেখা লিখেছি, যা এখন কল্পনাও করা যায় না।

৪.

তথ্যের অবাধ প্রবাহ আর মুক্তচিন্তার চর্চা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে নতুন আলোচনার কিছু নেই। শুধু গণতন্ত্র, সুশাসন আর মানবাধিকারের জন্য তা প্রয়োজন নয়। প্রয়োজন সমাজে গুজব ও অপপ্রচার রোধ করার জন্যও।

সরকারের দোষত্রুটি নিয়ে অবাধে লেখার আর বলার পরিবেশ থাকলে গুজব বা অপপ্রচারের দিকে মানুষের আগ্রহ অনেক কম থাকে। কিন্তু তথ্য আর আলোচনার নিয়মতান্ত্রিক মাধ্যম রুদ্ধ করে দিলে মানুষ কম জবাবদিহিহীন উৎসের (ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব বিদেশ প্রচারিত অনলাইন) মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে। এসব উৎস সঠিক তথ্য যেমন দেয়, অসত্য ও বিপজ্জনক তথ্যও প্রচার করে।

তা ছাড়া এসব উৎস এত অবাধ যে কেউ না চাইলেও তার কাছে পৌঁছে যেতে পারে তা। যেমন আমার হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারে অপরিচিত কোনো ব্যক্তিও চটকদার বা ভয়াবহ কোনো তথ্য আমার সম্মতি ছাড়া পৌঁছে দিতে পারে। সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া এগুলো থামানোর কোনো উপায় সরকারের কাছে নেই। কিন্তু চীন বা উত্তর কোরিয়ার মতো কোনো দেশ ছাড়া কেউ এটা করে না, করলে আন্তর্জাতিক সমাজে মুখরক্ষা করা সম্ভব নয়। চূড়ান্ত সর্বনাশ ঠেকানোও সম্ভব নয়।

গুজব বা অপপ্রচার বন্ধ করতে চাইলে তাই সরকারকে বরং প্রথাগত গণমাধ্যমকে অবাধ করতে হবে। সংবাদপত্র ও রেডিও-টেলিভিশন নিয়ন্ত্রণকারী আইনের ব্যবহার থেকে সরে আসতে হবে। হয়রানিমূলক পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রচলিত গণমাধ্যম থেকে জনগণকে অনিয়ন্ত্রণযোগ্য সামাজিক গণমাধ্যমে ঠেলে দিলে সরকারের জন্য তা বিপজ্জনক হতে পারে।

সরকার এসব বুঝতে পারলে সমাজের মানুষ বিড়াল হয়ে থাকবে না। অপরাধী যত ক্ষমতাশালী হোক অবাধে তার বিষয়ে প্রশ্ন তুলবে। যত অস্বস্তিকর বিষয় হোক তা নিয়ে প্রকাশ্যে মতামত জানাবে।

কিন্তু সরকার কি আসলে চায় তা?

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক