কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস কোথায় চলেছে...

কুড়িগ্রামের জন্য আসন বরাদ্দ ১২৫টি। যাত্রী উঠতে পারে শুধু কুড়িগ্রাম স্টেশন থেকেছবি : প্রথম আলো

১৮ জুন ২০২২। রায়হান কবীর (৩৫), মমিনুর রহমান (৪৫) ও বর্তমান কলাম লেখক। ঢাকা থেকে যাওয়া হবে কুড়িগ্রামে। গণকমিটির আন্দোলনে পাওয়া কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের যাত্রী। বগি গ-এর ৩৭, ৪১ ও ৪৫ নম্বর আসন। বিমানবন্দর স্টেশনে এসে পৌঁছান রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে। ঢাকা থেকে ছাড়ার কথা আধা ঘণ্টা আগে। চোখের সামনে দিয়ে চট্টগ্রামের ২টি, পঞ্চগড়ের উদ্দেশে ১টি, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, বেনাপোল, নরসিংদীসহ সব কটি ট্রেন চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। ট্রেন এল ১৯ জুনের রাত সোয়া একটায়।

বগুড়া অগ্রণী ব্যাংকের কর্তা, তাঁর বাড়ি রংপুরের ইসলামবাগে। বগি গ-এর আসন ৪২-এর এই যাত্রী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। কমলাপুর স্টেশনে তাঁর অভিজ্ঞতাটি এ রকম: ২ ঘণ্টা পর অপেক্ষমাণ যাত্রীদের উদ্দেশে রেল পুলিশের একজন যাত্রীদের ট্রেন আর ছাড়বে না বলে জানান। পরে যাত্রীদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে আরও ঘণ্টাখানেক পর রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের র‍্যাকের বদলে কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেসের র‍্যাক নিয়ে কুড়িগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করে। বিমানবন্দর স্টেশনে বসে থাকলেই বোঝা সম্ভব, কর্তৃপক্ষ কুড়িগ্রামকে কোন চোখে দেখে।

রাত দুইটা। ক্যানটিনে খাবার নেই। কেন নেই, জানতে চাইলাম ক্যানটিন বয় নাঈমের (২৫) কাছে। তিনি বলেন, ‘যেদিন নাকি খাবার থাকে, সেদিন যাত্রীরা খান না।’ পরে লালমনিরহাটের ডিআরএমকে ফোন করা হয়। সেই গভীর রাতে তিনি ফোন ব্যাক করে নাম ও আসন নম্বর জেনে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন। তার কিছুক্ষণ পর ক্যানটিনের কর্মচারীরা আসনে এসে জানান, ট্রেন আর কুড়িগ্রাম যাবে না মনে করে তাঁরা বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে পড়েছিলেন। তাই আর ক্যানটিনে খাবার তোলেননি। এ-ও কি কুড়িগ্রামের প্রতি তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিভঙ্গি নয়?

ব্রহ্মপুত্রের চরগুলো হচ্ছে উর্বরা ও বৈচিত্র্যময় ফসলের আধার। কাইম এলাকায় প্রতি একরে যেখানে ভুট্টা হয় ৫০ মণ, চরগুলোতে তা ১০০ থেকে ১২০ মণ। তিল, তিসি, কাউন, শর্ষে, পেঁয়াজ, মৌরি, ধনে, কালিজিরাসহ নানা জাতের কালাই। বাড়িতে কেউ কেউ তাঁতও চালান। কিন্তু বাজারের অভাবে কৃষকের জীবনমান নিচে নামছে। ৫০টির বেশি নদ-নদী ও বিপুল চরাঞ্চল নিয়ে কুড়িগ্রাম।

২.

নাম কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস। কিন্তু কুড়িগ্রামের জন্য আসন বরাদ্দ ১২৫টি। যাত্রী উঠতে পারে শুধু কুড়িগ্রাম স্টেশন থেকে। কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পথে রাজারহাট থেকে যাত্রীও ওঠানো হয় না। সদর উপজেলা ছাড়া বাকি উপজেলার জনগণ আন্তনগরটির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সকালে বিক্রির জন্য ছাড়া টিকিট কাটতে প্রতিদিন রাতে এসে যাত্রীরা লাইনে দাঁড়ান। পুরো জেলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে যাত্রীরা টিকিট সংগ্রহ করতে আসেন। টিকিট কালোবাজারির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী প্রভাষক আবদুল কাদের (৫০) বলেন, আন্তনগরের নাম কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস আর দ্বিগুণ আসন বরাদ্দ রংপুরের জন্য। অথচ ট্রেনের নাম যখন ‘ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস’ চাওয়া হয়, তখন রেলমন্ত্রী বলেছিলেন, ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস নাম হলে তো পুরো রংপুরবাসীর জন্য ট্রেনটি বরাদ্দ দিতে হয়। ট্রেনটি শুধু কুড়িগ্রামের জন্য।

প্রতিশ্রুতি ছিল বিখ্যাত চিলমারী বন্দরের রমনা রেলস্টেশন থেকে ট্রেনটি চলবে। সঙ্গে পরিবহন করবে ভারত ও ভুটান থেকে আসা পণ্য। এমনকি সোনাহাট ও রৌমারী স্থলবন্দরের মালামালও রমনা স্টেশন হয়ে পরিবহন হওয়ার কথা। সদ্য চালু হওয়া চিলমারী নদীবন্দরের জন্য ভরসা নৌপথ ও সড়কপথ। নৌপথের সঙ্গে রেলপথটি ব্যবহার করা গেলে পণ্য পরিবহন আরও সাশ্রয়ী হওয়ার কথা। কুড়িগ্রাম জেলার কৃষক লীগের নেতা মমিনুর রহমান (৪৫) বলেন, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসে পণ্য পরিবহনের বগি জুড়ে দিলে উৎপাদকেরা সহজেই ঢাকার কারওয়ান বাজারে ফসল তুলতে পারতেন। ফলে চরাঞ্চলের সার-বিষমুক্ত উৎকৃষ্ট ফসল-মাছ ঢাকাবাসীরা পেতে পারতেন।

৩.

৬৩ থেকে ৭০ শতাংশে, এরপর ৭৯ শতাংশে উত্তীর্ণ কুড়িগ্রাম জেলার গরিব মানুষের সংখ্যা। সম্ভবত খোদ প্রধানমন্ত্রীও বিব্রত। কেন? অন্যান্যের সঙ্গে এটাও বড় কারণ, আগে রমনা রেলস্টেশন থেকে লালমনিরহাট, চিলাহাটি, পার্বতীপুর ও সান্তাহারে মোট ৪টি লোকাল ট্রেন চলাচল করত। এখন একটিও নেই। সব কটি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে গেছে সাত-আট গুণ। বাহাদুরাবাদ ঘাটের রেলস্টেশনের সঙ্গে রমনা রেলস্টেশনের স্টিমার সংযোগ ছিল, এখন তা-ও নেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবেরা যখন ৫০০ টাকার সামাজিক বেষ্টনী থাকার পরও কেন গরিব বাড়ছে বলে বিস্ময় প্রকাশ করেন, তখন পরিবারপ্রতি যাতায়াত বাবদ কত গুণ খরচ বেড়েছে, সেই হিসাবও রাখতে বলা যায়। সঙ্গে প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাওয়া খাল-বিলের মাছ, কুড়িয়ে পাওয়া শাক, খেতে পরিণত এজমালি গোচারণ ভূমি ও জ্বালানির উৎসকেও বিবেচনায় নিতে বলি। রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির তাজুল ইসলাম (৫২), আবদুল মোমেন (৪৬), খন্দকার আরিফসহ (৩৪) অন্য নেতারা বলেন, বাংলাদেশের অন্যান্য রুটের আন্তনগরগুলোতে দু-তিনটি সুলভ বগি থাকলেও দারিদ্র্যের চ্যাম্পিয়ন কুড়িগ্রামবাসীর বেলায় তা রাখা হয়নি। এটা তো তামাশা!

ব্রহ্মপুত্রের চরগুলো হচ্ছে উর্বরা ও বৈচিত্র্যময় ফসলের আধার। কাইম এলাকায় প্রতি একরে যেখানে ভুট্টা হয় ৫০ মণ, চরগুলোতে তা ১০০ থেকে ১২০ মণ। তিল, তিসি, কাউন, শর্ষে, পেঁয়াজ, মৌরি, ধনে, কালিজিরাসহ নানা জাতের কালাই। বাড়িতে কেউ কেউ তাঁতও চালান। কিন্তু বাজারের অভাবে কৃষকের জীবনমান নিচে নামছে। ৫০টির বেশি নদ-নদী ও বিপুল চরাঞ্চল নিয়ে কুড়িগ্রাম। ঢাকার কুড়িগ্রাম সমিতির সাবেক মহাসচিব সাইদুল আবেদীন বলেন, পৃথিবীর সুন্দরতম চরগুলো কুড়িগ্রামে আর স্বাদু পানির সেরা মাছ এখানেই পাওয়া যায়। এত জাতের মিঠাপানির মাছ আর কোথাও মেলে না। ফলে দলে দলে পর্যটকেরা আসতেনই। কিন্তু তার আগে চাই কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস কার, এটা ঠিক করা।

নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
[email protected]