কৃষক আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ ও বিশ্বাসের ঘাটতি

দিল্লি চলো অভিযানে প্রধানত শামিল পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও কেরালার কৃষকেরা
রয়টার্স

রাজধানী দিল্লি কার্যত অবরুদ্ধ। হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় লক্ষাধিক কৃষক জড়ো হয়েছেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে করোনার জন্য সংক্ষেপিত সংসদীয় অধিবেশনে কৃষি ও কৃষি বিপণনসংক্রান্ত বিতর্কিত যে তিনটি বিল পাস করা হয়, তা প্রত্যাহারের দাবিতেই দেশের বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকদের এই ‘দিল্লি চলো’ অভিযান। কৃষকদের আশঙ্কা, নতুন আইন স্বাধীনতাই শুধু হরণ করবে না, তাঁদের বড় শিল্পোদ্যোক্তাদের দাসানুদাস করে তুলবে। নীলচাষিদের দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে। হতে হবে ক্রীতদাস।

দিল্লি চলো অভিযানে প্রধানত শামিল পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও কেরালার কৃষকেরা। তাঁরা তৈরি হয়েই এসেছেন। ট্রাক ও ট্রাক্টর-ট্রেলারকে গড়ে তুলেছেন অস্থায়ী আস্তানা হিসেবে। উত্তর ভারতের প্রবল ঠান্ডার মোকাবিলায় পর্যাপ্ত গরম জামাকাপড় ছাড়াও অগুনতি ট্রাক-ট্রাক্টরে মজুত দুই মাসের মতো খাদ্য-পানীয়, তাঁবু, ওষুধ, লেপ-তোশক-বিছানা। প্রতিটি ট্রাক-ট্রাক্টরে রয়েছে মুঠোফোন চার্জ করার একাধিক পয়েন্ট। নেতারা ঘোষণা করেছেন, দাবি না মেটা পর্যন্ত তাঁদের অবস্থান চলবে।

এক বছর আগের শীতকালে এই রকম অবস্থান আন্দোলন শুরু হয়েছিল দিল্লির শাহিনবাগে। প্রবল ঠান্ডা উপেক্ষা করে দাদি-নানিরা অবরোধ করেছিলেন সড়ক। দাবি ছিল নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) তৈরির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার। তিন মাসের বেশি চলা শান্তিপূর্ণ সেই অবরোধ সরাতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে একটিবারের জন্যও সরকার কথা বলেনি। করোনার আতঙ্ক শুরু হওয়ার পর অবরোধ উঠে যায়। এবার করোনা সংক্রমণ উপেক্ষা করে কৃষকেরা দিল্লি অভিযানে এসেছেন। পার্থক্য এটুকুই, কালক্ষেপ না করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আলোচনার বার্তা পাঠিয়েছেন। যদিও আন্দোলনের নেতারা তা অগ্রাহ্য করে বলেছেন, শর্তাধীন প্রস্তাব গ্রহণ অসম্ভব। সরকারকে আলোচনায় বসতে হবে তাঁদের অবস্থানের জায়গায় এসে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর শর্ত ছিল, সীমান্ত মুক্ত করে কৃষকেরা সীমান্তবর্তী এলাকা বুরারি চলে যান। কৃষকদের আশঙ্কা, নির্ধারিত জায়গায় চলে গেলে সেখানেই তাঁদের বন্দী করে রাখা হবে। এমন আশঙ্কা বা সন্দেহের কারণ, সাতটি স্টেডিয়ামকে অস্থায়ী জেলখানায় রূপান্তরের প্রস্তাব। মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল কেন্দ্রের হাতে স্টেডিয়াম তুলে দিতে রাজি হননি।

প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের দ্বিতীয় কারণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘মন কি বাত’। নতুন কৃষি আইন কতটা কৃষকদের স্বার্থে, এই সংস্কার কীভাবে দীর্ঘদিনের সমস্যা সুরাহা করবে, কীভাবে কৃষকদের মধ্যস্বত্বভোগী বা মিডলম্যানদের হাত থেকে বাঁচাবে, বাজারের ব্যাপ্তি ঘটাবে এবং কৃষকদের শৃঙ্খলমুক্ত করে তুলবে, রোববার তিনি তা ব্যাখ্যা করেন। কৃষকেরা মনে করছেন, সরকার কতখানি অনমনীয়, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই তা স্পষ্ট।

শাহিনবাগের মতো কঠোর অবস্থান ধরে রাখা সরকারের পক্ষে কঠিন। শাহিনবাগ আন্দোলনকে সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠের মেরুকরণে ব্যবহার করেছিল। কৃষক আন্দোলন সেই সুবিধা দেবে না। এ এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। দুই তরফের বিশ্বাসের ঘাটতি কীভাবে মেটে, সেটাই এখন দেখার

স্পষ্ট আরও একটি বিষয়। ট্রাস্ট ডেফিসিট বা বিশ্বাসের ঘাটতি। এই সরকার আজ পর্যন্ত যে যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কোনো ক্ষেত্রে কারও সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ দেখায়নি। সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেনি। ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টাও করেনি। নোট বাতিল, অভিন্ন পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) চালু, নাগরিকত্ব আইন সংশোধন, এনআরসি তৈরি কিংবা করোনার মোকাবিলায় তিন সপ্তাহের জন্য দেশজোড়া লকডাউন—সব সিদ্ধান্তই সরকার নিয়েছে একতরফাভাবে। আলোচনা না করে। এই কৃষি আইনও তেমন। এতগুলো সংগঠন। কারও সঙ্গে একবারও কথা বলেনি। সবচেয়ে বড় কথা, একটি ক্ষেত্রেও সরকার তার ভুল স্বীকার করেনি। এই প্রবল মন্দায় কোষাগার ঘাটতি কমিয়ে রাজস্ব বাড়ানো যখন বৃত্তকে চতুষ্কোণে পরিণত করার মতোই কঠিন, তখন প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ২০ হাজার কোটি টাকা খরচে নতুন সংসদ ভবন তৈরি ও রাজপথের দুধারের সৌন্দর্যায়নের কর্মসূচি থেকে সরে আসার কোনো ইঙ্গিত সরকার দেখায়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিরোধিতাকে উপেক্ষা করার এই মানসিকতা সরকারের প্রতি বিশ্বাসের ঘাটতি ক্রমেই বাড়িয়ে তুলেছে। গণতন্ত্রের পক্ষে যা মোটেই শুভ লক্ষণ নয়।

কৃষি আইনের বিরোধিতা চলছে সেই সেপ্টেম্বর থেকে। আর্যাবর্তে বেশি, দাক্ষিণাত্যে তুলনায় কম। পাঞ্জাবে তো রেল ও সড়ক অবরোধও অব্যাহত। কেন্দ্রীয় আইন চালু না করতে বিরোধী রাজ্য সরকার সচেষ্ট। তবু আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কেন্দ্র আলোচনায় বসেনি। অগত্যা ‘দিল্লি চলো’ অভিযান। অভিযান বানচাল করতে শাসকের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল হরিয়ানা ও দিল্লিতে। কিন্তু সব বাধা পেরিয়ে লক্ষাধিক কৃষক আজ দিল্লির দোরগোড়ায়। সরকার নমনীয়। আন্দোলনের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি নির্ভর করছে সরকারি সদিচ্ছা ও বিশ্বাসের ঘাটতির ওপর।

পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় ভারতের মোট খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫০ মিলিয়ন টন। ৭০ বছর পর উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষিক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ ১৫ শতাংশের কম। সংস্কারের অভাব ও সবুজ বিপ্লবের সুফল অন্তর্হিত হওয়া ভারতের শস্যভান্ডার রাজ্যগুলোয় চরম হতাশার জন্ম দিয়েছে। অসন্তোষ থেকে বাঁচতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার প্রতিবছর চাল, গম, আখ, তুলাসহ বিভিন্ন ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বেঁধে দেয়। এই প্রথা ক্রমেই এক রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। নতুন আইনে সহায়ক মূল্য নিয়ে কিছু বলা নেই। উত্তর ভারতে কৃষিপণ্যের বেচাকেনা হয় সরকার পরিচালিত বাজার ব্যবস্থায় বা ‘মান্ডি’তে। নতুন আইনে কৃষিপণ্যকে এই ব্যবস্থা থেকে উন্মুক্তই শুধু করা হয়নি, ফসল বা শস্য মজুতের ঊর্ধ্বসীমাও তুলে দেওয়া হয়েছে। চুক্তি চাষ বৈধ হয়েছে। অত্যাবশ্যক পণ্যের আওতামুক্ত হয়েছে চাল, ডাল, দানাশস্য, আলু, পেঁয়াজ ও তৈলবীজ। সরকারের দাবি, এর ফলে বাজার উন্মুক্ত হবে। বড় উদ্যোগপতিরা কৃষিপণ্যে আগ্রহী হবেন। বিনিয়োগ বাড়বে। মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালরাজ শেষ হবে। উপকৃত হবেন চাষি।

কৃষককুল এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁরা মনে করছেন, আইনে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্দিষ্ট না থাকায় বড় সংস্থা কৃষকদের বাধ্য করবে তাদের বাঁধা দামে ফসল বিক্রি করতে। চুক্তি চাষ তাঁদের নিজ জমিতে শ্রমিক করে তুলবে। মান্ডি ব্যবস্থার অবসানে ফসল বাজারজাত করতে বহুদূর পাড়ি দিতে হবে। কৃষকের বদলে উপকৃত হবে বেসরকারি ও বহুজাতিক সংস্থা।

শাহিনবাগের মতো কঠোর অবস্থান ধরে রাখা সরকারের পক্ষে কঠিন। শাহিনবাগ আন্দোলনকে সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠের মেরুকরণে ব্যবহার করেছিল। কৃষক আন্দোলন সেই সুবিধা দেবে না। এ এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। দুই তরফের বিশ্বাসের ঘাটতি কীভাবে মেটে, সেটাই এখন দেখার।


সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি