কৃষকের চিন্তায় জাতীয় বাজেট কীভাবে এল?

.
.

পরিবর্তনটি চোখে দেখা যায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪৫ বছরে বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এককভাবে কৃষিতে যে পরিবর্তন ও সাফল্য সূচিত হয়েছে, তা বর্ণনাতীত। আমি ব্যক্তিগতভাবে চার দশক ধরে নিবিড়ভাবে এই পরিবর্তনের সঙ্গেই লেগে আছি বলা যায়। কৃষকের সংকটগুলো নিজের মতো করে দেখেছি। চরম দুর্দশা দেখেছি, অস্তিত্বের তীব্র সংকট দেখেছি, নতুন উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছি, আবার অভাবনীয় সাফল্যে ঘুরে দাঁড়াতেও দেখেছি। মর্যাদার প্রশ্নে পিছিয়ে থাকা কৃষককে দেখেছি অধিকার সচেতন হয়ে মনের ভেতরের কথা গুছিয়ে বলতে। দৃঢ় হয়ে সামনে দাঁড়াতে। এই পরিবর্তনগুলো খুব ভালো করে দেখতে পেরেছি মূলত জাতীয় বাজেটের সঙ্গে কৃষককে সম্পৃক্ত করতে গিয়ে।

কৃষকের চিন্তায় বাজেট
প্রেক্ষাপটটি একটু খুলে বলা যাক। স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিবছর আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রস্তুত করার জন্য জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়। এর আগে দেশের বিভিন্ন সংগঠন ও শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আলোচনা করে থাকেন। এটি প্রচলিত রেওয়াজ। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে জাতীয় আয়ের বৃহৎ অংশ কৃষিজ উৎস থেকে আসে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কৃষিতে ৭০ ভাগ মানুষ নিয়োজিত থাকার পরও প্রাক্‌-বাজেট আলোচনায় এই শ্রেণি-পেশার মানুষের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না। কারণ, এদের কোনো সংগঠন নেই। বিষয়টি উপলব্ধি করে চিন্তা করেছি কৃষককে কীভাবে জাতীয় বাজেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা যায়। চ্যানেল আইতে ২০০৪ সালে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠান শুরুর পরের বছরেই এর একটি পরীক্ষামূলক কার্যক্রম হাতে নিই। ২০০৫ সালে জাতীয় বাজেটের আগে কৃষকের মাঠে গিয়ে যখন জানতে চাই এ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা আছে কি না, তখন বড়ই হতাশ হই। একজন কৃষকের কাছ থেকেও বাজেট সম্পর্কিত জানাবোঝার কোনো নমুনা পাইনি। তখনই মনে হলো এ বিষয়ে গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে আমার বা আমাদের করণীয় রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সাল থেকে শুরু হলো তৃণমূল পর্যায়ে কৃষকদের নিয়ে প্রাক্‌-বাজেট আলোচনা: কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট। সন্ধ্যার পর প্রত্যন্ত গ্রামের মাঠে আলো জ্বেলে কয়েক হাজার কৃষকের সমাবেশ।
সব পর্যায়ের কৃষক, খামারি ছাড়াও এ কার্যক্রমে স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার উপস্থিতি নিশ্চিত করারও ব্যবস্থা করি। আমন্ত্রণ জানাই সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, গবেষক ও বুদ্ধিজীবীদের। এর মধ্য দিয়ে গত এক যুগে কৃষি, কৃষক, গ্রামীণ অর্থনীতি ও পল্লিজীবনের ভালো-মন্দ, সমস্যা-সম্ভাবনা প্রতিটি বিষয়ের বার্ষিক সমীকরণ সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে। প্রতিবছরই বাজেট ঘোষণার প্রাক্কালে অর্থমন্ত্রীর কাছে কৃষকের দাবি ও চাহিদার আলোকে প্রণীত সুপারিশমালাও তুলে ধরা হচ্ছে। ভালো লাগে যখন দেখি এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় দেশের কৃষকদের মধ্যে অনেকখানি সচেতনতা এসেছে। একইভাবে, সরকারি নীতি পরিকল্পনায় এমন কিছু বিষয় স্থান পেয়েছে, যা কৃষকের পক্ষে সরকারের কাছে পৌঁছানো কঠিন ছিল।
গত অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের ৪৮টি স্থানে প্রায় তিন লাখ কৃষকের সঙ্গে প্রাক্‌-বাজেট আলোচনা করেছি। খুব বেশি ভেতরে যাব না। ২০০৫ সালে আমি কৃষি বাজেট কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা জরিপ করতে গিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের জিজ্ঞাসা করেছি, বাজেট কী জিনিস, এ সম্পর্কে কারও কোনো ধারণা আছে কি না। কেউ বলেছে, ‘আমরা ওই জিনিসটা কোনো দিন পাইছিও না খাইছিও না’ (পাইনি ও খাইনি)।’ কেউ বলেছে, ‘আমি বলতে পারি না, তয় আমার বাবা আছে, হেই কইতে পারবে।’ গ্রামের কোনো কোনো কৃষক মাথা চুলকে বলেছেন, কোনো দিন বাজেট নামের কোনো কিছুর নামই তাঁরা শোনেননি। পরের বছর ২০০৬ সালে যখন কৃষি বাজেট করতে গেলাম, কয়েক হাজার কৃষকের সমাবেশে মানিকগঞ্জের গড়পাড়া ইউনিয়ন পরিষদের মাঠে কৃষকদের ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, বাজেট সম্পর্কে ধারণা আছে কার কার হাত তুলুন। মাত্র তিনজন কৃষক হাত তুললেন। তাঁর মধ্যে একজনের কাছে জানতে চাইলাম। তিনি গোঁজামিল মিশিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন। বাকি দুজন কিছুই বলতে পারলেন না। এই ছিল পরিস্থিতি। ঠিক তার চার বছর পর ২০১০ সালে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে অনুষ্ঠিত ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠানে এক কৃষকের বক্তব্য শুনে শুধু আমরা নই, খোদ মন্ত্রীও অবাক হয়ে যান। মনে আছে, কৃষকের নাম ছানোয়ার হোসেন। তিনি মাইক্রোফোন চেয়ে নিয়ে হাতে থাকা সেদিনের একটি সংবাদপত্র উঁচিয়ে ধরলেন। বললেন, ‘আজকের পত্রিকায় আছে যে দেশের ৩০০ জন সংসদ সদস্য বিনা শুল্কে গাড়ি আমদানির সুযোগ পান। আর যে কৃষক দেশের মানুষের খাদ্য জোগায় তার কৃষিযন্ত্র আমদানিতে সে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় না। এ দেশে কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তন কীভাবে হবে?’ ঠিক ১২ বছর পেরিয়ে এসে এখন কৃষককে প্রশ্ন করলে শুধু বাজেট নয়, এর গভীরের অনেক পাওয়া না-পাওয়ার বিষয়ও স্পষ্ট করে বলতে শোনা যায়। সে সঙ্গে সরকারের বরাদ্দ ও পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে তাঁর নিজেরও এখন অনেক অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসা রয়েছে। একই সঙ্গে তৈরি হয়েছে মতামত দেওয়ার ক্ষমতা। আমি বিশ্বাস করি, এই ক্ষমতা গণমাধ্যমের। কৃষক তার ভেতরের শক্তি নিয়ে জেগে ওঠার ক্ষমতা তখন পেয়েছেন, যখন বারবার তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছে, জানতে চাওয়া হয়েছে, বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর মাথায় বহু জিজ্ঞাসা জমা হয়েছে। একদিন তিনি বলার ক্ষমতা অর্জন করেছেন।

পরিবর্তনের ছাপ ওপরেও পড়ছে
এভাবেই কৃষকের জ্ঞান ও সচেতনতার প্রসার ঘটছে। কৃষিকাজে নিমগ্ন থেকে কৃষক ভুলেই ছিলেন দেশের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের সঙ্গে বোঝাপড়ার সুযোগ রয়েছে—অন্তত তার কাজের জায়গাটি নিয়ে। একসময় কৃষিকাজকে কৃষক তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত নিয়তি হিসেবে বিবেচনা করে গেছেন। এখন কৃষক অনেক বেশি উজ্জীবিত। তাঁরা এখন তাঁদের স্বার্থের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিরূপণ করতে সমর্থ হয়েছেন। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর।
অন্যদিকে, সরকারের মন্ত্রিপরিষদের প্রভাবশালী সদস্যরাও এ অনুষ্ঠানে উপস্থিতির সুবাদে দেশের কৃষি ও কৃষকের বর্তমান পরিস্থিতি, চাহিদা, প্রত্যাশা ও সম্ভাবনাগুলো সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এটি তাঁদের রাজনীতি ও সরকার পরিচালনার নানাবিধ কার্যক্রমের ভেতর এক বিশেষ প্রাপ্তি। বলা যেতে পারে মাঠপর্যায়ের সমীক্ষা। এটি তাঁরা যেকোনো সভা-সেমিনার, এমনকি সরকারের নীতিনির্ধারণী বৈঠকের আলোচনায় তুলতে পারছেন। এর মধ্য দিয়ে কৃষকের প্রত্যাশাগুলো, বক্তব্যগুলো কোনো না কোনোভাবে সরকারের কাছে ঠিকই পৌঁছে যাচ্ছে। সেসব বিষয়ে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছেন। আমরা এর বাস্তব প্রতিফলন দেখছি।
প্রথমত, কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট কার্যক্রমের শুরু থেকে অর্থাৎ ২০০৬ সাল থেকে আমাদের পর্যবেক্ষণ ছিল সরকারি খাদ্য সংগ্রহ অভিযানে সরাসরি কৃষকের অংশগ্রহণ নেই। অর্থাৎ কৃষক সরকারি খাদ্যগুদামে ধান বিক্রি করতে পারেন না। বরাবরই এর সুফলভোগী হন মিলমালিক। বিষয়গুলো বারবার সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়। মাননীয় অর্থমন্ত্রী, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ও বর্তমান খাদ্যমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদের বিভিন্ন সদস্যের বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয়। দীর্ঘদিনের অনিয়মের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেঙে এবার ঠিকই সম্ভব হয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল কেনা।
‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ কার্যক্রমের শুরু থেকে গুরুত্বপূর্ণ দাবি হিসেবে উত্থাপিত হয়ে আসছিল শস্যবিমা। বিশেষ করে দুর্যোগে ফসলহানির পর কৃষক যাতে ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেন, সে জন্য শস্যবিমা বাস্তবায়নের জন্য আমরা কৃষকের দাবির ভিত্তিতে সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করে আসছিলাম। পৃথিবীর উন্নত কৃষিপ্রধান দেশের অনুশীলনগুলো অনুসরণ করে এটা করা হয়। এর ভিত্তিতে সরকারি পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ২০১৩ সালে শুরু হয়েছে ‘আবহাওয়ার সূচকভিত্তিক শস্যবিমা প্রকল্প’। বাস্তবায়ন করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও সাধারণ বীমা করপোরেশন। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) তহবিলে পাইলট প্রকল্প হিসেবে দেশের তিনটি জেলাকে বেছে নেওয়া হয়েছে—রাজশাহী (খরাপ্রবণ), সিরাজগঞ্জ (বন্যাপ্রবণ) ও নোয়াখালী (ঘূর্ণিঝড়-প্রবণ) । এই প্রকল্পের আওতায় তিনটি জেলায় ২০টি স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশন গড়ে তোলা হয়েছে। ইতিমধ্যে ১২ হাজার কৃষককে এফজিডির মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পলিসি গ্রহণ করেছেন তিন জেলার ৬ হাজার ৭৭২ জন কৃষক। আগামী জুন মাসে এই পাইলট প্রকল্প শেষ হবে।

যাত্রা চলমান
এ বছর ১৩ বারের মতো অনুষ্ঠিত হলো তৃণমূল পর্যায়ে প্রাক্‌-বাজেট আলোচনা ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’। দেশের ছয়টি স্থানে যথাক্রমে রাজশাহীর পবা, নোয়াখালীর সুবর্ণচর, চাঁদপুরের হাইমচর, ঝালকাঠি সদর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও রাজবাড়ী সদরে আয়োজিত প্রাক্‌-বাজেট আলোচনায় উল্লিখিত জেলাগুলো ছাড়াও সংলগ্ন আরও একাধিক জেলার ২০ হাজার কৃষক ও খামারি অংশ নেন। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের মধ্যে ঝালকাঠিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, রাজবাড়ীতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ও অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক, রাজশাহীর পবায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, চাঁদপুরে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া আলোচনায় উল্লিখিত জেলাগুলোর জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে কৃষিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক অংশ নেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মুখ্য বাজেট প্রণেতা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সপ্তমবারের মতো ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ কার্যক্রমে উপস্থিত ছিলেন। তিনি নিজে ঝালকাঠির বাওকাঠির আয়োজনে উপস্থিত থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন, কৃষক এখন নেই নেই, চাই চাইয়ের মতো একেবারে দিশাহীন সংকটের আবর্তে নেই। তাঁরা এখন কিছু সংকট উতরে উঠেছেন। আরও সামনে যাওয়ার জন্য সরকারের জোরালো নীতি সমর্থন প্রত্যাশা করেন।

কৃষকের গুচ্ছ গুচ্ছ দাবি
আমরা দেখেছি, বিদ্যুৎ নিয়ে এবার কৃষকের না পাওয়ার আর্তি কম। ছয়টি স্থানে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কৃষক বিদ্যুৎ প্রাপ্তিতে অসন্তুষ্ট নয়। কিন্তু ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র থেকে কৃষিসুবিধা পাওয়ার প্রশ্নে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ কৃষক পিছিয়ে আছেন। বেশির ভাগই সরকারের এ উদ্যোগ সম্পর্কে তেমন একটা অবগত নন। কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে যাওয়া বীজের মান নিয়ে যথেষ্ট অভিযোগ রয়েছে কৃষকের। প্রকাশ্য একটি জরিপের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৬০ ভাগ কৃষকই বীজ নিয়ে অভিযোগ করেছেন। কৃষিঋণ নিয়ে অপ্রাপ্তি ও হয়রানির অভিযোগ রয়েই গেছে। কৃষির উপখাত হিসেবে পোলট্রি খাতে এক দিনের বাচ্চার অনিয়ন্ত্রিত মূল্যের কারণে এবারও এই খাত ধসের শিকার। পোলট্রি ও মৎস্য খামারিরা খাদ্য উপকরণ আমদানিতে সরকারের দেওয়া রেয়াত সুবিধা পাচ্ছেন না। এই সুবিধা ভোগ করছেন খাদ্য কারখানার মালিক। খামারিদের দাবি, ভর্তুকি সুবিধা সরাসরি খামারিদের দেওয়া হোক। দাবি এসেছে খাল ও নদী খনন, কৃষিপণ্যের বাজারব্যবস্থা উন্নয়ন, সার ও কীটনাশকের মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা, কৃষিযন্ত্রের ওপর ৩০ ভাগ ভর্তুকিসহ নানা বিষয়। সেই সঙ্গে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষির প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আমাদের মাঝারি ও ক্ষুদ্র কৃষককে অধিকার সচেতন করার দরকার রয়েছে। কৃষকের জন্য অবসরকালীন পেনশন সুবিধার দাবিও এসেছে এবার।
কৃষকের এসব দাবি, চাহিদা ও প্রত্যাশা মিলিয়েই ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের পক্ষ থেকে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কাছে ৪৫ দফা সুপারিশমালা দিয়েছি ১৩ মে। সেখানে সুস্পষ্টভাবে কৃষকের উন্নয়ন, চাহিদা ও চিন্তাপ্রবণতাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। যাতে সরকার ও নীতিনির্ধারক স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন জাতীয় বাজেটের কোন কোন ক্ষেত্রে কৃষকের জন্য জোরালো নীতিসমর্থন দরকার। সেখানে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন। আশার কথা হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী এবার সরকারিভাবে কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল কেনার কার্যক্রমটি শতভাগ সুষ্ঠু করার জন্য সর্বোচ্চ উদ্যোগের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন এ অনুষ্ঠানে। সেই সঙ্গে শস্যবিমা কার্যক্রমটির স্থায়ী রূপ দেওয়ার প্রশ্নেও একমত হয়েছেন তিনি।

.
.

হাওরের ডাক
হাওরে এবার অকালবন্যার পর সরেজমিনে ঘুরে আসার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞের সঙ্গে মতবিনিময় করে বারবারই মনে হয়েছে, হাওর নিয়ে আবার আরও কার্যকর ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এই প্রশ্নে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে দেশের ধান উৎপাদনের অন্যতম ক্ষেত্র সাতটি জেলার হাওরাঞ্চলের প্রায় ৭৫ ভাগ বোরো ধান এবার তলিয়ে গেছে পাহাড়ি ঢল আর বৃষ্টিতে সৃষ্ট অকালবন্যায়। বেসরকারি হিসেবে ধান, মাছ, সবজি ও হাঁস মিলিয়ে ক্ষতি প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার। দেশের খাদ্যশস্য ও মাছ উৎপাদনের প্রশ্নে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো হাওর। দেশের খাদ্যশস্যের ২৮ ভাগ এবং মাছের প্রায় ৫ ভাগ আসে হাওর থেকে। এবার এসবের ৯০ ভাগ থেকে বঞ্চিত হলো দেশ। এর দীর্ঘমেয়াদি অনেক ক্ষতিও রয়েছে। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে হাওরাঞ্চলে ফসলহানি বাড়ছে। গত ৬০ বছরে এবার সবচেয়ে বেশি ফসলহানি ঘটেছে হাওর অঞ্চলে। হাওরের দ্বিতীয় ফসল মাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে হাওরে এ ধরনের দুর্যোগের প্রবণতা বাড়ছে। এই বিবেচনায় হাওরের জন্য স্থায়ী পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে হাওরের নদীগুলোর খনন করা প্রয়োজন। সে সঙ্গে হাওরের জলাশয়গুলোর ইজারা স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছ থেকে নিয়ে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের দেওয়া উচিত। প্রতিবছর বাঁধ দেওয়া, প্রভাবশালী মহলের পুকুর খননসহ নানা কারণে হাওরগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওরের প্রাকৃতিক অবস্থা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কার্যকর উদ্যোগ হিসেবে বিশেষ বরাদ্দ প্রয়োজন। অন্যদিকে হাওরের উপযোগী ফসল জলজ খাদ্যশস্য উৎপাদন, প্রাকৃতিক ও বন্য জলজ ধানের (জিজানিয়া জাত) সঙ্গে দেশীয় জাতগুলোর সংমিশ্রণে কার্যকর গবেষণা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে হাওরের উপযোগী ফসল উৎপাদনের জন্য বিশেষ গবেষণা ও বরাদ্দ দরকার। হাওর উন্নয়ন অধিদপ্তর নামে সরকারের একটি অধিদপ্তর চালু হয়েছে। এ জন্য আঞ্চলিক দপ্তরও গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু ওই দপ্তরে কোনোই কার্যক্রম নেই। ওই দপ্তর চালুর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সঙ্গে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

প্রান্তমুখী উন্নয়ন
গত কয়েক বছরের মতোই কৃষি নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে এই প্রাক্‌-বাজেট আলোচনায় একটি বিষয় খুব স্পষ্টভাবে উঠে আসছে। তা হলো সরকারি উন্নয়ন পদক্ষেপ সম্পর্কে কৃষক তথা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সচেতনতা খুবই কম। দেশের ৪ হাজার ৫৪৭টি ইউনিয়ন পরিষদে, ৩২১টি পৌরসভায় ও সিটি করপোরেশনের ৪০৭টি ওয়ার্ডে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। সব জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ই-সেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ই-সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী, আইনি সহায়তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, আইনের প্রয়োগসহ বেশির ভাগ সরকারি সেবাই সব পর্যায়ের জনগণের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থাপিত ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে পণ্যের উৎপাদন ও বিপণনসংক্রান্ত তথ্যের সুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সরকার বিপুল অর্থ ব্যয় করে এই তথ্যসুবিধার অবকাঠামো তৈরি করলেও লক্ষ করেছি, স্থানভেদে প্রান্তিক পর্যায়ে মাত্র ৩ শতাংশ কৃষকও এই সেবা সম্পর্কে অবগত নন। সরকারি সহায়তা সম্পর্কে কৃষক তথা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ধারণা বাড়ছে না। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, প্রান্তিক জনগণের ভেতর সচেতনতা বাড়ানোর ব্যাপারে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
আগামী দিনের কৃষিতে উদ্যোক্তার সঙ্গে কৃষকের অংশীদারত্বের ব্যাপারে শক্ত নীতিমালা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো যখন সর্বাধুনিক ও উচ্চ মানের যান্ত্রিক কৃষিতে পৌঁছে গেছে, সেখানে আমাদের অবস্থান অনেক পিছিয়ে। কৃষিকে শতভাগ প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য ভর্তুকি ও সহায়তা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। উন্নত বিশ্বের প্রবণতা অনুযায়ী আধুনিক কৃষির হিসেবে কৃষিজমিতেই বিনিয়োগকারীদের গ্রিনহাউস তৈরি হবে। কৃষকের জমির মূল্য বিবেচনায় উদ্যোক্তার পাশাপাশি এখানে বিনিয়োগকারী হিসেবে কৃষককে যুক্ত রাখার ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা তৈরির প্রয়োজন রয়েছে। তা না হলে কৃষকের নিজের জমিতেই শ্রমিক হয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা থাকবে। ইতিমধ্যেই বড় উদ্যোক্তাদের কিনে নেওয়া কৃষিজমিতে কৃষকের শ্রমিক হয়ে পড়ার নজিরও বিগত সময়গুলোতে আমরা দেখেছি।

ন্যায্য দাম কৃষক কীভাবে পাবেন?
দেশের কৃষকের ফল ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার স্বার্থে কৃষিপণ্যের উৎপাদন মৌসুমে আমদানি নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি আমদানি শুল্ক বাড়ানো দরকার। কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় এবার প্রথমবারের মতো ভারতের মালদা থেকে আম আমদানি নিরুৎসাহিত করার জন্য সরকার শুল্ক ১০ শতাংশের স্থলে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। দেশের উৎপাদিত আমের বাণিজ্যে কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণের এ সিদ্ধান্তের জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। একইভাবে শাকসবজি, মাছ, আদা, রসুন, পেঁয়াজসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রেও এ কাজটি করা দরকার। তাহলে দেশের কৃষকের কিছুটা হলেও ন্যায্যমূল্য পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
পো​লট্রি ও মাছের খাদ্যের আমদানি করা উপকরণের ওপর থেকে শুল্ক কর তুলে শূন্য করা হচ্ছে। এর ফলে খোলাবাজারে মাছ ও মুরগির খাদ্যের দাম কমার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। সুফল পাচ্ছে খাদ্য উৎপাদন কারখানার মালিকপক্ষ। কার্যত তারা খাদ্যের দাম কমাচ্ছে না। যার ফলে খামারিরা সুফল পাচ্ছেন না।
বিষয়গুলো অর্থমন্ত্রী নিবিড়ভাবে শুনেছেন। এটিও কৃষি বাজেট কার্যক্রমের অন্যতম এক সাফল্য বলে আমি মনে করি। কৃষকের পক্ষে তাঁর দাবি ও চাহিদার ফর্দ নিয়ে সরকারের কাছে পৌঁছানোর মতো অবকাঠামো নেই। এই কাজটিই আমরা করতে চেয়েছি। এর মধ্য দিয়ে কৃষক ও খামারিদের প্রত্যাশা পূরণের যে ধারাবাহিকতা সূচিত হয়েছে, তা এক বড় প্রাপ্তি বলে বিশ্বাস করি। এবারও দেশের বড় একটি অংশের কৃষক তাকিয়ে আছেন ১ জুনের দিকে। অর্থমন্ত্রীর ঘোষিত বাজেটের সঙ্গে তাঁরাও মিলিয়ে নেবেন এক বছরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণ।