কেন হয় না ডাকসু নির্বাচন?

বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরামর্শক হিসেবে যশোরে গেছি স্থানীয় এনজিওগুলোর কাজ দেখতে। সেখানকার কিছু মানুষ হোটেলে এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। ঘটা করে পরিচয় করিয়ে দিলেন এলাকার একজন বড় ব্যবসায়ীকে। তিনি সমাজসেবী, ব্যবসায়ী, সফল একজন রাজনীতিকও। কিন্তু নিজে পরিচয় দেওয়ার সময় সবচেয়ে গর্ব নিয়ে জানালেন, ডাকসুর একজন নির্বাচিত ছাত্রনেতা ছিলেন তিনি। সে–ও হল পর্যায়ের।

ডাকসু এমনই এক গর্ব আর সম্মানের বিষয় ছিল তখন। সম্ভবত এখনো। ১৫-২০ বছর আগে ডাকসুর বড় নেতা ছিলেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর কিংবা খায়রুল কবির খোকনরা। আরও আগে ছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। এখনো কোনো আড্ডায় ডাকসুর প্রসঙ্গ এলে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন তাঁরা। এখনো একান্ত আড্ডায় মনে হয়, এত বছর পরও তাঁদের জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন বুঝি ডাকসুর নেতা হতে পারাটা।
ডাকসু ছিল এতটাই বড় কিছু। ডাকসুকে বলা হতো বাংলাদেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট। অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ছাত্র সংসদগুলোও ছিল একেকটা পার্লামেন্টের মতোই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতিচর্চায় শুধু নয়, দেশে শিক্ষা অধিকার থেকে শুরু করে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম বলিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর ছিল ডাকসুসহ এসব ছাত্র সংসদ।

২.
ডাকসুর আরেকটা বিশেষ গুরুত্ব ছিল বাংলাদেশে। ডাকসু ছিল নেতা নির্মাণের সূতিকাগার। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে নিজ যোগ্যতায় তৃণমূল থেকে ধাপে ধাপে রাজনীতিতে সফল হওয়ার সুযোগ থাকে। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে তা-ই ছিল, এভাবেই উত্থান হয়েছিল বঙ্গবন্ধু বা তাজউদ্দীনের। কিন্তু পরে আশির দশক থেকে উত্তরাধিকারের রাজনীতির দাপটে এই সুযোগ হয়ে পড়ে চরমভাবে সীমিত। তবে এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গণতান্ত্রিকভাবে নিজ যোগ্যতায় নেতা হওয়ার সবচেয়ে বড় সুযোগ ছিল ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন।
ডাকসু, চাকসু বা জাকসুর নেতারা তাই পরে ধাপে ধাপে হয়ে উঠতেন জাতীয় পর্যায়ের নেতা। ডাকসুসহ বিভিন্ন ছাত্র সংসদের
নির্বাচন না থাকার কারণে বহু বছর ধরে সেই সুযোগও বিলুপ্ত হয়েছে। এখন তাই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা মনোনীত হন দলপ্রধানের অঙ্গুলিহেলনে, বড়জোর মূল দলের অল্প কিছু বড় নেতার তদবিরে।
ডাকসু না থাকার কারণে ছাত্র নেতৃত্বের নির্মাতাও আর ছাত্রসমাজ তথা আমজনতার সন্তান নয়। ছাত্রনেতার নির্মাতা হয়ে পড়েছেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী গুটিকয়েক নেতানেত্রী। ফলে দেশ আর গণতন্ত্র রসাতলে গেলেও ছাত্রসমাজের জোরালো কণ্ঠস্বর শুনতে পাই না আমরা আর। নব্বই-পরবর্তী সময়ে ক্রমে ছাত্ররাজনীতির বড় একটি অংশ হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীনদের কুশাসন আর স্বেচ্ছাচারিতার সহযাত্রী কিংবা পাহারাদার।
ডাকসু না থাকার কুফল নিয়ে আরও হাজারো কথা বলা যায়। ডাকসু না থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সহাবস্থানের তাগিদ নেই, হলে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের দৌরাত্ম্যের সীমা নেই, শিক্ষকদের একাংশের অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে জোরালো কোনো নিয়ামক নেই। ডাকসু না থাকার
কারণে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আগের স্বতঃস্ফূর্ততা, গতিশীলতা
আর সৃজনশীলতা পর্যন্ত নেই। ডাকসু না
থাকার কারণে হল থেকে নিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্র পর্যন্ত ভিন্ন রাজনীতি করা ছাত্রের নিরাপত্তা
নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস উল্টো পথে চললে জবাবদিহির কেউ নেই, টিএসসির সব
রুম একদল দখল করে নিলে কারও কিছু
বলার নেই।
ডাকসু থাকলে এসব কি একদমই হতো না? হয়তো হতো কিছুটা, কিন্তু তা কোনোক্রমেই এখনকার মাত্রায় নয়। ডাকসু থাকার সময়ের ইতিহাস তা-ই বলে।
এ দেশের রাজনীতি আর সমাজবাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষ করে ডাকসুর প্রয়োজনীয়তার পক্ষে আরও বহু কিছু বলা যায়। কিন্তু ডাকসুর প্রয়োজন নেই এ কথা বলার মতো কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখনকার কিছু ছাত্রনেতা বালখিল্য দেখিয়ে বলেন বটে যে ডাকসুর কাজ আমরাই করে দিই। কিন্তু
তাঁদের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হল দখল থেকে শুরু করে নানা রকমের দৌরাত্ম্যের যেসব
সংবাদ আমরা নিয়মিতভাবে পত্রিকায় দেখি, তাতে বোঝা যায়, ডাকসুর অবর্তমানে কী নৈরাজ্য তাঁরা আসলে প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাঙ্গনে। একই অবস্থা বিরাজমান দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, সরকারি কলেজেও।
প্রশ্ন হচ্ছে, ডাকসু নির্বাচন নেই কেন তাহলে? কে বা কারা দুই দশক ধরে থামিয়ে রেখেছে ডাকসু নির্বাচন। কেন এই জরুরি বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর?

৩.
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে বিশদ একটি প্রতিবেদন করেছে প্রথম আলো দুই দিন আগে। তার প্রথম লাইন হচ্ছে, সবাই চায় ডাকসু নির্বাচন! এটি দৃশ্যত সঠিক একটি পর্যবেক্ষণ। জিজ্ঞেস করলে সবাই বলবে, আমরা চাই এই নির্বাচন। এমনকি যে ছাত্রলীগ দাবি করেছে ডাকসুর অবর্তমানে তারাই ছাত্রদের সমস্যার দেখভাল করছে, তারাও বলছে নির্বাচন চায় তারা। কিন্তু আসলে কি এটি সত্যি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার ধারণা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন সাধারণ ছাত্ররা ছাড়া আর কেউই চান না। সাধারণ ছাত্ররা ছাড়া যাঁরা চান, তাঁদেরও অনেকে এটি চান নানা শর্তে, নানা বিবেচনার ছক মিললে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ক্ষমতাসীন সরকারগুলো। ১৯৯০ সালের পর থেকে যে দুটি বড় দল দেশ শাসন করেছে, তারা খুব ভালো করেই জানে, নির্বাচিত ছাত্র সংসদগুলোর শক্তিমত্তা, জানে ঐতিহ্যগতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রশাসনবিরোধী ভূমিকার কথা। সুশাসন, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুটি দলই নানান ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে তাদের শাসনামলে। মূলত এ জন্যই তাদের আশঙ্কা থাকে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে ভোটটা যাবে বিরোধী ছাত্রসংগঠনের পক্ষে। অতীতে তা-ই হয়েছিল।
এ জন্যই সরকারগুলো চায় না ডাকসু বা অন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো হোক। বিরোধী ছাত্রসংগঠন নির্বাচিত নেতৃত্বে এলে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার জোর সম্ভাবনা থাকে। এমনকি তারা নির্বাচনে কম আসনে জিতলে বা একেবারে না জিতলেও নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে তাদের ক্যাম্পাসে সহাবস্থান করতে দিতে হয় সরকার বা তার ছাত্রসংগঠনকে। এই কারণে তারা
চায় না ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে। আবার নিজ ছাত্রসংগঠনের জেতার সম্ভাবনা থাকলেও ডাকসু নেতৃত্ব হয়ে উঠতে পারে সমান্তরাল একটি শক্তি, বিশেষ কোনো নেতার একাধিপত্য ক্ষুণ্ন হতে পারে তাতে। এই ঝুঁকি থেকেও ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয় না ক্ষমতাসীন সরকার, এমন নজির অতীতে দেখা গেছে।
ডাকসু নির্বাচন সরকার চায় না বলে চায় না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে বসানো হয় সরকারের বিশ্বস্ত বা অনুগত শিক্ষকদের। সরকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মতো এমন কোনো উদ্যোগ তাঁরা তাই গ্রহণ করেন না। জনমত বা অন্য কোনো চাপে পড়ে মাঝেমধ্যে লোকদেখানো কিছু কথাবার্তা বলেন। কিন্তু বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোর সহাবস্থান নিশ্চিত করে নির্বাচনের সত্যিকারের কোনো উদ্যোগ নেন না তাঁরা সাধারণত।
ডাকসু নির্বাচনে আগ্রহ থাকে না কখনো কখনো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের মূল নেতাদেরও। বয়স, ছাত্রত্ব কিংবা অন্য কোনো কারণে ডাকসু নির্বাচনে তাঁরা মনোনয়ন না পেলে দলের ওপর তাঁদের কর্তৃত্ব কমে যেতে পারে। নির্বাচিত ছাত্র সংসদের নেতা হয়ে আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেন তাঁর সংগঠনেরই অন্য নেতারা। এই আশঙ্কা থেকে মনোনয়ন পাওয়ার জোরালো নিশ্চয়তা না থাকলে ডাকসু বা অন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তেমন একটা আগ্রহী থাকেন না তাঁরা। অতিকেন্দ্রীভূত নেতৃত্ব কাঠামোতে নিচের সারির নেতাদেরও সাহস থাকে না এসব নির্বাচনের দাবি তোলার।
ডাকসু নির্বাচনে সাধারণত আগ্রহী থাকে প্রধান বিরোধী ছাত্রসংগঠন। আওয়ামী লীগের আমলে ছাত্রদল আর বিএনপির আমলে ছাত্রলীগ। কিন্তু তারা প্রথমে চায় সহাবস্থান ও নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। এর নিশ্চয়তা দিতে পারে না বা চায় না ক্ষমতাসীনদের অনুগত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে খুব একটা কিছু করার থাকে না তাদের। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে দাবি তুলে থাকে বাম ছাত্রসংগঠনগুলোও। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর বড় একটি অংশের লেজুড়বৃত্তি কিংবা বিভক্তির কারণে এদের শক্তিও কমেছে অনেকটা।
ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে নেই আসলে বেশি মানুষ। কয়েক দশক ধরে নির্বাচন না হওয়ার কারণে এখনকার তরুণসমাজের মধ্যে এটা নিয়ে খুব একটা সচেতনতাও নেই।

৪.
ডাকসু বা বিভিন্ন ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যর্থতা এ দেশে জবাবদিহিহীন রাজনীতির যে সংস্কৃতি ক্রমেই আরও শক্ত হয়ে উঠছে, তারই একটি প্রতিফলন। বিগত বছরগুলোতে নির্বাচন নামের প্রতিষ্ঠানটি যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়ছে, এ দেশে তাতে এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা আরও হ্রাস পেয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ডাকসু ও অন্যান্য নির্বাচনের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ব্যাপক ছাত্রসচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা হয়তো করা যেতে
পারে। দেশের বর্তমান বাস্তবতায় এটি করা হয়তো একমাত্র বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর পক্ষেই এখন সম্ভব।
কিন্তু সেই অঙ্গীকার, তাড়না ও দৃঢ়চিত্ত তাদেরও আছে কি?

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।