কেন ১৪ বছরের মেয়েকে বিয়ে করতে হবে?

টানা ৩৪ দিন এই ভয়াবহ শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করে মরে গেছে মেয়েটি। ১৪ বছরের শরীর নিতে পারেনি এই ধকল।
সংগৃহীত

২৭ অক্টোবর বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল সংবাদটি। টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ফুলকি পশ্চিমপাড়া গ্রামে দরিদ্র পরিবারের মেয়ে নূর নাহার নামের ১৪ বছরের মেয়েটি মারা গেছে। এ বছর নূর নাহার অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছিল। মেধাবী ছাত্রী হিসেবে স্কুলে তার বেশ সুনামও ছিল। হঠাৎ করে এই করোনার মধ্যেই গত ২০ সেপ্টেম্বর প্রবাসফেরত ৩৫ বছর বয়সী রাজীব খানের সঙ্গে বালিকা নূর নাহারকে বিয়ে দেওয়া হয়। অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হওয়ায় শারীরিক সম্পর্কের কারণে লাগাতার নূর নাহারের রক্তক্ষরণ হয়। টানা ৩৪ দিন এই ভয়াবহ শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করে মরে গেছে মেয়েটি। ১৪ বছরের শরীর নিতে পারেনি এই ধকল।

এই ধরনের হৃদয় হাহাকার করা খবর বাংলাদেশে এই প্রথম নয়। দুই সপ্তাহ আগে উত্তরবঙ্গের চারটি জেলার আটটি উপজেলায় গবেষণাকাজ করতে গিয়ে সেটাই দেখছি। নূর নাহারের মতো অনেক মেয়ের সঙ্গেই সেখানে কথা হয়েছে, যাদের বয়স এখন ১৬–১৭। তাদের বিয়েও হয়েছে দু–তিন বছর আগে। তাদেরও বিয়ের পর অনেক রক্ষক্ষরণ হয়েছে। তবে তাদের ভাগ্য হয়তো কিছুটা ভালো, তারা বেঁচে আছে এখনো।
বাল্যবিবাহের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।

বাল্যবিবাহের নানা ধরনের কুফলের বিরুদ্ধে সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা ধরনের সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চলমান থাকলেও খুব কমই ঠেকানো যাচ্ছে বাল্যবিবাহ। করোনাকালে বৃদ্ধি পেয়েছে বাল্যবিবাহ। যদিও করোনার প্রথম দিকেই সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছিল, ‘বিশ্বের ৪০ লাখ কন্যাশিশুকে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে ফেলেছে করোনা মহামারি...গত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ হতে পারে’। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, এ দেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়। আর ২২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগেই।

বদলেছে বিয়ের স্থান ও সময়

করোনকালে অনেকটাই বেড়েছে বাল্যবিবাহ। তবে পাল্টেছে বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার স্থান, সময়, ধরন ও অনুঘটকেরা। এ সময় মানুষের চলাচল সীমিত হওয়ায় প্রশাসনসহ অন্যান্য বেসরকারি সংগঠনের নজরদারি অপেক্ষাকৃত কম।
প্রশাসন ও অন্যান্যদের চোখকে ফাঁকি দিতে এখন খুব কম বিয়েই মেয়ের অভিভাবকদের বাড়িতে সম্পন্ন হচ্ছে। নেটজ বাংলাদেশের গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, করোনার প্রথম তিন মাসে ৪৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ মেয়ের অভিভাবকদের বাড়িতে হয়েছে। তবে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ এবং পাড়াপ্রতিবেশীদের নজর এড়াতে এখন বিয়ে হচ্ছে অন্য এলাকা/গ্রামে কিংবা অন্য জেলায় আত্মীয়ের বাড়িতে। অনেক ক্ষেত্রে এই বিয়ের কথা বর-কনের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে যাঁরা সচেতন, তাঁদের জানানো হচ্ছে না। আবার কোথাও কোথাও ‘সুন্নতে খৎনা’ অথবা ‘আকিকা’ অনুষ্ঠানের ব্যানারে হচ্ছে বাল্যবিবাহ। সবই হচ্ছে কঠিন গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে।
বেশির ভাগ বিয়ে হচ্ছে রাত ১০টার পর। দিনেরবেলায় বিয়ে হলে লোক জানাজানি বেশি হয়। সেটি এড়াতেই রাতের শেষ প্রহরকেই বেছে নেওয়া হচ্ছে বিয়ে পড়ানোর সময় হিসেবে।

কাজির বদলে মৌলভি
এখন শুধু কলেমা পড়িয়ে মৌলভি ডেকে বেশির ভাগ বাল্যবিবাহ সম্পন্ন হচ্ছে। সেখানে কোনো রেজিস্ট্রেশন হয় না বা কাজি দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করা হয় না। ১৮ বছরের প্রমাণ হিসেবে বয়স সনদ চেক করে বিয়ে পড়ানোর কথা কাজির। এর আগে ‘আঠারো বছরের ভুয়া সনদ’ দিয়ে বিয়ে পড়ানো হতো। তবে বয়স সনদ দিয়ে কিছুটা কড়াকড়ি হওয়াতে মৌলভিই হয়ে পড়ছে এ ক্ষেত্রে আস্থাবান। তাই মৌলভি ডেকে বা তাঁর বাড়িতে গিয়েও বিয়ে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বিয়ে থাকছে রেজিস্ট্রিবিহীন। ফলে তালাকের ক্ষেত্রে আইনি বাধ্যবাধকতার সুযোগ মিলছে না। হিন্দুদের ক্ষেত্রেও পুরোহিতের বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে।

শ্বশুরবাড়ি আসা–যাওয়া করতেই ১৮ হয়ে যাবে...
এ বিষয়ে যখন ঘটকদের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন যে কথাগুলো সবচেয়ে বেশি শুনতে পেয়েছি সেগুলো হলো, ‘ছোট কই শরীর খারাপ তো হইছে’, ‘বয়স না হলেও গায়ে-গতরে তো বড় হইছে’, এখন বিয়ে না হইলে দায়িত্ব কী আপনে নিবেন?’, ‘বেশি বয়স হলে যৌতুক বেশি দিতে হবে,’ আর ‘এখন বয়স ১৫ হলে অসুবিধা কী? শ্বশুরবাড়ি যেতে–আসতে ১৮ হয়ে যাবে?’।
কেন বেড়েছে এই হার?
করোনা মহামারি দারিদ্র্যের সংখ্যা বাড়িয়েছে। ফলে বাংলাদেশে অনেক কন্যাশিশু স্কুল থেকে বিদায় নিয়েছে ইতিমধ্যেই। কেউ কাজে লেগেছে পরিবারের তাগিদে, নয়তো বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছে। স্কুল বন্ধ থাকা, দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়াসহ করোনা সম্পর্কিত নানা কারণ বাল্যবিবাহের ঝুঁকির মুখে পড়েছে বিপুলসংখ্যক কন্যাশিশু। স্কুল বন্ধ থাকলেই তাদের বাল্যবিবাহের ঝুঁকি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। লকডাউনের সুযোগে অনেক পরিবার যেমন তাদের মেয়েশিশুদের বাল্যবিয়ে দিচ্ছে এবং এটি গোপন করারও সুযোগ পাচ্ছে। কখনো কখনো স্কুলগুলো মেয়েদের রক্ষা করে বলেই মতপ্রকাশ করেছেন প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা।

করণীয় আসলেই আছে কী?

গিয়েছিলাম আমরা নওগাঁ জেলার সাঁপাহার উপজেলার একটি ইউনিয়নে। উদ্দেশ্য ছিল একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলা। গিয়ে দেখি তিনি সালিস করছেন। এটিও একটি বিয়েজনিত সালিস। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছি। মেয়েটির বয়স ১২। দুবছর আগে তার বিয়ে হয়েছে। তখন সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। মেয়েটি জানায়, বিয়ে হওয়ার ছয় মাস পর তার প্রথম মাসিক হয়। সে যে গ্রামে থাকে সেখানে বিশ্বাস করা হয় মেয়েদের প্রথম মাসিক শ্বশুরবাড়িতে হলে সেই মেয়ে ‘লক্ষ্মী’ হবে। তাই মেয়েকে লক্ষ্মী প্রমাণের চেষ্টা চলে। সেই সালিসে মেয়েটি জানায়, শ্বশুরবাড়িতে তাকে ভাত খেতে দেয় না। শাশুড়িও উপস্থিত ছিলেন সালিসে। বললেন, মেয়েটি কথা শোনে না। কাজকর্মের ফরমাশ দিলে দৌড়ে ঘরের বাইরে চলে যায়, রাস্তাঘাটে ঘোরাঘুরি করে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেয়েটির বাবা–মাকে বোঝাচ্ছিলেন, মেয়েটিকে শ্বশুরবাড়িতে ফেরত পাঠাতে।

বাস্তবতা যখন এই পর্যায়ে তখন আসলেই কী সম্ভব হবে বাল্যবিবাহ ঠেকানো? এই পর্যন্ত যা ঠেকানো হয়েছে তা আদতে খুবই কম। এক জায়গায় ঠেকালেই যে সেই বিয়ে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়, ১০–১৫ দিন পর আবার অন্য জায়গায় গিয়ে সেই বিয়ে হচ্ছে।
জানা গেছে, বাল্যবিবাহের শাস্তি হিসেবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অর্থদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আইনিভাবে কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও সেটির চর্চা খুবই কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেয়ের পরিবারকেই শাস্তি দেওয়া হচ্ছে এবং সচেতন করা হচ্ছে। কিন্তু ছেলের পরিবার, ঘটক, মৌলভি, কাজি তাঁদের শাস্তি হচ্ছে খুবই কম।
আর যেখানে রাজীবের মতো ৩৫ বছরের ছেলেরা ১৪ বছরের মেয়ে খোঁজেন, সেখানে আসলেই কি বন্ধ হবে এই বাল্যবিবাহ?


জোবাইদা নাসরীন শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]