কেমন মেয়র চাই?

সিটি নির্বাচন
সিটি নির্বাচন

হেভিওয়েট মেয়র প্রার্থীদের অঙ্গীকারের ফিরিস্তি বিরক্তিকর ঠেকছে। চুয়াল্লিশ বছর বয়সী একটা দেশের মানুষকে এ রকম ন্যাকামি করে এখনো হালে পানি পাওয়া যায়। জিতলে হেন ও তেন করেঙ্গা। কে শুনতে চায় এসব? কথাটা বোধ হয় ঠিক হলো না। নিশ্চয়ই ফজিলত আছে, না হলে কি আর বলে! বহু মানুষ এখনো ভোটওয়ালাদের মুখ থেকে মিঠাকথা শুনতে চায়, দরদ চায়। সবচেয়ে বেশি চায় ভোটওয়ালাদের কথা শুনতে শুনতে স্বপ্ন বুনতে—বিশুদ্ধ পানি, ভালো রাস্তা, খোলা ফুটপাত, চালু পয়োনিষ্কাশন, বন্ধ-ঢাকনি ডাস্টবিন, সুলভ পরিবহন, চাই কি রোড ডিভাইডারে ফুলের বাগান! আরও কত কী যে! সিনেমা হলের অন্ধকারে বসে স্বপ্ন দেখতে আজকাল এক শ টাকা বেরিয়ে যায়। আর এখন কাণ্ডখানা কেমন? কত ওপরতলার মানুষটা শার্টের হাতাখানা গুটিয়ে বস্তিতে এসে স্বপ্ন দেখিয়ে যায়! ভাবা যায় না! দৌড়ের ওপরে থাকা প্রার্থীকে প্রাণভরে দোয়া করার অধিকারের কথাটাও হিসাবে রাখা চাই। ভাগ্য ভালো থাকলে টেলিভিশনে এক ঝলক দেখা যাওয়ার লাইফ-টাইম সুযোগটা? জনগণ নাগরিক না হয়ে উঠলে ভোটওয়ালারা তঁাদের লম্বা লম্বা কথাগুলো ঘাটে ও অঘাটে এভাবে বলে যেতে পারেন। ফিউচার টেন্সে যা বলা হচ্ছে, তা-ই কল্কে পেয়ে যাচ্ছে।
বলা হচ্ছে জিতলে অমুক-তমুক করব। কীভাবে করবেন? আপনার পলিসি প্রস্তুতি শুনি। ভোট করার চিন্তা কিংবা করবেন করবেন ভাব কিংবা চেষ্টা-চরিত্র তো ভোট ঘোষণার দিন থেকেই। খুব একটা সময় ছিলই না এবার। কিন্তু খুব একটা কমও নয়। তাহলে নগরবাসীর প্রধান প্রধান সমস্যা নিয়ে আপনার পলিসি-পর্যায়ের ভাবনা কী? বিষয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এগুলো নিয়ে ইতিমধ্যে দু-একবার কথা বলছেন? বলে থাকলে প্রমাণ আছে কিছু? লিখিত? নথিবদ্ধ? ধরা যাক, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা কিংবা ঢাকার মশা? নাকি এমন আশা করাটা পাগলের প্রলাপ শোনায়? কারণ, আপনি তো জেতার পরে সবকিছু করবেন! এখনই কেন পণ্ডশ্রম করবেন? গড় ভোটারদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান এসব প্রশ্ন করার জায়গায় আসেনি তাই বাঁচোয়া। তা না হলে যে প্রার্থীর যত বেশি অঙ্গীকার সে প্রার্থীর তত বেশি ভোট কাটা পড়ত, বেশি কথা বলার দায়ে। তালিকা লম্বা করলেই সব হয়? আমরা আর দশটা দেশে ইলেকশন দেখি না? এই তো বিলেতে এখন পার্লামেন্ট নির্বাচনের মৌসুম।
বড়-মাঝারি-ছোট, উদারনৈতিক-রক্ষণশীল, বামপন্থী-বর্ণবাদী কিংবা আঞ্চলিক যা-ই হোক না কেন, দলগুলো ও তাদের প্রার্থীরা কথা বলছেন পলিসি-পর্যায়ে। জিতলে রেলের ভাড়া কিংবা ইমিগ্র্যান্টের সংখ্যা কমিয়ে দেব বলেই ফাটিয়ে দেওয়ার উপায় নেই। বলতে হবে কীভাবে কমাবেন? কিসের বিনিময়ে কমাবেন? কারা কতটুকু লাভবান ও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন? প্রভাব কতটুকু হবে? এসব নিয়ে হিসাব-নিকাশসহ কথা বলতে হচ্ছে তাঁদের। আমাদের দেশে ভোটারের দিক থেকে এমন করে চাপ নেই বলে বেঁচে যাচ্ছেন প্রার্থীরা। কিন্তু সালটা ২০১৫। এমন করে প্রার্থীদের পার হতে দেওয়া উচিত নয়। মেয়র প্রার্থীরা অস্পষ্ট সব অঙ্গীকার দূরে রাখুন। কথা বলুক জিতলে ঠিকাদারবাজি, দলবাজির বিরুদ্ধে তাঁরা কেমন করে ব্যবস্থা নেবেন। দল-মহল্লার সন্ত্রাসীদের শায়েস্তা করতে পারবেন? ব্যবস্থা নেব, ব্যবস্থা নেেব শোনানোর দরকার নেই। কীভাবে ব্যবস্থাটা নেবেন শোনান দেখি ভোটারদের।
স্থানীয় সরকারের একটি বড় সৌন্দর্য হচ্ছে এটি রাজনৈতিক দলের বাইরের লোকদের জন্য শাসনক্ষমতায় অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের জন্য দল-ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। একটি রাজনৈতিক দল বলতে কী বোঝায়, একটি দল আসলে কিসের প্রতিনিধিত্ব করে, সে সম্পর্কে সৎ-স্বচ্ছ ধারণা না নিয়ে, যাঁরা কতিপয় রাজনীতিকের খারাপ কাজের জন্য বিরাজনীতিকরণের দিকে ইশারা করেন, তাঁরাও খারাপ কাজই করেন। সুতরাং দল-ব্যবস্থা নিয়ে উল্টোপাল্টা কোনো কথা নয়। কথা হচ্ছে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে দল-ব্যবস্থার বাইরে রেখে কাজ করতে দেওয়া নিয়ে। অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশে এ ব্যাপারে একধরনের মতৈক্য ছিল। দলভিত্তিক নির্বাচনের পক্ষে কথাবার্তা ছিল সামান্যই। গত বছরের উপজেলা নির্বাচনের সময় থেকে চিত্রটা পাল্টাচ্ছে। তখন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী দলভিত্তিক নির্বাচনের পক্ষে একাধিকবার কথা বলেন। বাস্তবে নির্বাচনটা দলভিত্তিক হচ্ছে এবং অনেক দেশেই এমন হয়ে থাকে, তাই বাংলাদেশেও হতে পারে। যত দূর মনে পড়ে এটুকুই ছিল যুক্তি, যা আমাদের তেমন একটা কনভিন্স করতে পারেনি। এবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কথা বলছেন দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে। মোটা দাগে বললে বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা বিষয়-বিশেষজ্ঞদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনতে পছন্দ করেন না। যদি করতেন তাহলে কেবল বাস্তবতা ও নানা দেশের কথা বলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে একেবারে আনুষ্ঠানিকভাবে দলভিত্তিক করার পথে জোরকদম হওয়ার আগে বিষয়-বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন; জনমত যাচাই করতেন, জনমত গঠনের কথা ভাবতেন। এসব কিছু হচ্ছে না। সামনেই হয়তো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা চলে আসবে।
যা-ই হোক। এবারও আনুষ্ঠানিক না হলেও নির্বাচনটা ঘোরতরভাবে দলভিত্তিকই হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী চাইছেন, বড় দল বিএনপির প্রধানও সুযোগটা নিচ্ছেন। মিডিয়াও দেখা যাচ্ছে একই রাস্তায়। যথারীতি বড় দল-ছোট দল, আওয়ামী লীগ-বিএনপি; দলের বিদ্রোহী প্রার্থী। নির্দলীয় প্রার্থীদের খবর মিডিয়াও রাখে না। কেন রাখে না কে বলবে? ‘ছোট’ দল বলে আরেকটা ব্যাপার আছে। মিডিয়ায় কর্মরত কাছের মানুষদেরও কখনো কখনো এমন করে বলতে শোনা যায়। আচ্ছা, যদি দলটা উন্নততর আদর্শের হয়, নেতা যদি মেরুদণ্ডসম্পন্ন হন, যদি সুবিধাবাজি-ক্ষমতাবাজি-টাকাবাজির খাতায় নামখানা না থাকে, তাহলে কথিত ছোট একটি দলকে বড় দল করে তোলায় মিডিয়া কিছুটা মেহনত করতে পারে না?
ছোট দল বলতে পারিবারিক দল বা ভুঁইফোড় সংগঠন বোঝানো হচ্ছে না। নির্দলীয় বলতে ডামি-প্রার্থী কিংবা মুফতে কিছু সুবিধা বাগানোর প্রার্থীর কথা বলা হচ্ছে না। বিনিয়োগের ধরন-ধারণের কারণে পুরোটা পারবে না; কিন্তু তাই বলে মিডিয়া একেবারেই পারবে না, এটা কোনো কথা হতে পারে না। ব্যক্তির মতো মিডিয়ারও সামাজিক দায়বোধ আছে। মিডিয়া কেবল গণতন্ত্রের নামে সারাক্ষণ গুণবিচারহীন সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে মানদণ্ড ধরে বসে থাকতে পারে না। হয়তো বলা হবে, লোকে কথিত ছোট দলগুলো বা নির্দলীয় প্রার্থীদের সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। কিন্তু এ যুক্তি দেখিয়ে দায়িত্ব শেষ করা যায় না। কেননা, মিডিয়া ব্যক্তির রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। হাতে এখনো কিছু সময় আছে; মিডিয়া কেবলই বড় দল-বড় দল না করে, ভালো প্রার্থী হলে কথিত ছোট ছোট দলের প্রার্থীদের, যোগ্য নির্দলীয় প্রার্থীদের যথাযোগ্য মর্যাদাসহকারে ভোটারদের সামনে তুলে ধরতে পারে। বাকিটা ভোটারের মর্জি।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।