কেমন হওয়া দরকার রূপপুরের চুল্লি?

বর্তমান সরকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালের ২ নভেম্বর রাশিয়ার সঙ্গে একটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির অধীনে রুশ ফেডারেশন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকায় প্রতিটি আনুমানিক এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ভিভিইআর টাইপের পরমাণুচুল্লি ডিজাইন, নির্মাণ, স্থাপন, জ্বালানি সরবরাহ, ব্যয়িত জ্বালানি দণ্ড ফেরত, জনবল প্রশিক্ষণ, চালন ও রক্ষণাবেক্ষণে সহযোগিতা করবে। চুল্লি স্থাপনের লক্ষ্যে প্রকল্প সাইট-সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় সমীক্ষা, পরিবেশের ওপর প্রতিক্রিয়া নিরূপণ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রণয়ন, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, কেন্দ্রের অভ্যন্তরে বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণ, বিদ্যুৎ সঞ্চালনব্যবস্থা, অন্য সব ধরনের যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও স্থাপন রাশিয়া করবে। বাংলাদেশ জমিটুকু দিয়ে প্রকল্পের কাজ তদারকির মাধ্যমে রাশিয়ার কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র বুঝে নেবে।
রাশিয়ার ডিজাইন করা পরমাণুচুল্লির নাম হচ্ছে ভিভিইআর, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উচ্চ চাপযুক্ত পানির রিঅ্যাক্টর অর্থাৎ (পিডব্লিউআর) -এর অনুরূপ। প্রচলিত অন্য তিন ধরনের প্রযুক্তিবিশিষ্ট রিঅ্যাক্টরের নাম হচ্ছে ফুটন্ত পানির রিঅ্যাক্টর (বিডব্লিউআর), ভারী পানির রিঅ্যাক্টর (পিএইচডব্লিউআর) ও দ্রুতগতিসম্পন্ন নিউট্রন-সমেত রিঅ্যাক্টর (ব্রিডার)। এ চার ধরনের প্রযুক্তির মধ্যে পিডব্লিউআর অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বিধায় এর সংখ্যা শতকরা প্রায় ৭৩ ভাগ। বর্তমানে পৃথিবীতে চালু আছে এমন ৪৩৮টি পরমাণুচুল্লির মধ্যে জেনারেশন-২ মডেলের পরমাণুচুল্লির সংখ্যা ৪০০-এর অধিক। এসব রিঅ্যাক্টর ডিজাইন করা হয় ১৯৫০-৬০ সালের দিকে এবং ১৯৭০ সাল থেকে নির্মাণ শুরু হয়। বাকিগুলো আধুনিক প্রযুক্তি ও অধিকতর নিরাপত্তাবিশিষ্ট জেনারেশন-৩ মডেলের রিঅ্যাক্টর নামে খ্যাত।
রাশিয়া ১৯৫৪ সালে অবনিক্স শহরে বিশ্বে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আরএমবিকে (যা বিডব্লিউআর প্রযুক্তির অনুরূপ) পরমাণুচুল্লি স্থাপন করে। একসময় এ ধরনের প্রযুক্তির ২৬টি চুল্লি চালু থাকলেও ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর তা
থেকে শিক্ষা নিয়ে এর সঙ্গে উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়। বর্তমানে এ ধরনের শুধু ১১টি রিঅ্যাক্টর চালু রয়েছে। অপরদিকে বিশ্বে পরমাণু প্রযুক্তিতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ১৯৬৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত রাশিয়া আরবিএমকে থেকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ পিডব্লিউআর ধরনের ভিভিইআর ৪৪০ জেনারেশন ২ মডেলের পরমাণুচুল্লি নির্মাণ করে। রাশিয়াসহ চেকোস্লোভাকিয়া, ইউক্রেন, ফিনল্যান্ড, স্লোভাকিয়ায় বর্তমানে ২৩টি ভিভিইআর-৪৪০ মডেলের পরমাণুচুল্লি চালু রয়েছে। ভিভিইআর-৪৪০ মডেলের পরমাণুচুল্লির ডিজাইন শুধু রাশিয়ার রেগুলেটরি সংস্থা কর্তৃক পরীক্ষিত ও স্বীকৃত।
রাশিয়া ছাড়া পরমাণুচুল্লি মূলত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, চীন, জাপান ও কোরিয়া তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রের থ্রি-মাইল আইল্যান্ড (১৯৭৯), রাশিয়ার চেরনোবিল (১৯৮৬) এবং জাপানের ফুকুশিমায় (২০১১) দুর্ঘটনায় পতিত পরমাণুচুল্লিগুলো হচ্ছে জেনারেশন-২ মডেলের। জেনারেশন-২ মডেলের পরমাণুচুল্লিতে রয়েছে একক কনটেইনমেন্ট স্ট্রাকচার, সনাতন টাইপের প্রত্যক্ষ নিরাপত্তাবেষ্টনী, প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা যেকোনো ধরনের যান্ত্রিক ও মানুষের ভুলের কারণে রিঅ্যাক্টর বিপর্যয়ের আশঙ্কা বেশি। তা ছাড়া, এ ধরনের চুল্লিগুলোর অন্যান্য সীমাবদ্ধতার মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় কোর বিপর্যয় ঠেকানোর স্বল্পতম সময় (৩০ মিনিট), কম মাত্রায় ভূমিকম্প প্রতিরোধক্ষমতা, দুর্বল সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধক, প্ল্যান্টের স্বল্প আয়ুষ্কাল (২৫ থেকে ৩০ বছর), অধিক নির্মাণ সময় ও পারমাণবিক বর্জ্য উৎপাদনক্ষম ইত্যাদি।
এসব কারণে জেনারেশন–২ ভিভিইআর ৪৪০ মডেলের চুল্লিকে আধুনিকায়ন করে উন্নত গ্রেডের ভিভিইআর-১০০০ মডেলের পরমাণুচুল্লির ডিজাইন শুরু হয় ১৯৭০-এর দিকে এবং নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৯৩ সাল থেকে। তারপর থেকে ক্রমান্বয়ে এর উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের কাজ চলতে থাকে। এ ধরনের ডিজাইন করা পরমাণুচুল্লিগুলোকে জেনারেশন-৩ মডেলের চুল্লি বলা হয়, যাতে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। পৃথিবীতে রাশিয়ার ডিজাইন করা জেনারেশন-৩ ভিভিইআর-১০০০ মডেলের ৩২টি পরমাণুচুল্লি চালু রয়েছে এবং বেশ কিছু নির্মাণাধীন রয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে রুশ ফেডারেশনের পারমাণবিক সহযোগিতায় প্রথমবারের মতো ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের কুদানকুলামে জেনারেশন-৩ ভিভিইআর-১০০০ মডেলের পরমাণুচুল্লি নির্মাণের সময় জনপ্রতিরোধ, নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ২০০৭ সালে চুল্লিটি চালু হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালে শেষ হয়।
যেকোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও সন্ত্রাসী আক্রমণ থেকে পরমাণুচুল্লিকে আরও বেশি নিরাপদে রাখতে জেনারেশন-৩ ভিভিইআর-১০০০ মডেলের চুল্লিগুলোকে আরও শক্তিশালী ও উন্নতকরণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে। ফলে কোনো কারণে কোর বিপর্যয় ঘটলে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টাব্যাপী কোর বিপর্যয় থেকে চুল্লিকে রক্ষা করা যাবে। এ ছাড়া এ ধরনের পরমাণুচুল্লির দ্রুত নির্মাণ, স্বল্প জায়গায় অধিক বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম, স্বল্পতম রক্ষণাবেক্ষণ সময়, অধিক মাত্রায় ভূমিকম্প প্রতিরোধক্ষমতা (০.৩৫g) আয়ুষ্কাল ৬০ বছর, অধিক প্ল্যান্ট ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টর, বর্জ্য উৎপাদনে নিম্নমুখী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ ধরনের ডিজাইন করা মডেলের পরমাণুচুল্লিগুলোকে বলা হয় জেনারেশন-৩+ ভিভিইআর-১২০০, যা ইভল্যুশনারি রিঅ্যাক্টর নামে খ্যাত। এগুলোর ডিজাইন ২০০০ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ২০০৬ সালে। এ ধরনের ডিজাইন করা দুটি চুল্লি ২০১৬ সালের মধ্যে রাশিয়ায় চালু হওয়ার কথা রয়েছে। জেনারেশন-৩+ ভিভিইআর-১২০০ মডেলের চুল্লিগুলোর ডিজাইন রাশিয়ার পারমাণবিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন ছাড়াও ইইউআর দ্বারা স্বীকৃত। প্রযুক্তি থেমে নেই, জেনারেশন-৩+ ভিভিইআর-১২০০ মডেলের চুল্লি, যা শিগগির চালুর অপেক্ষাধীন ও নির্মাণাধীন রয়েছে, তার থেকে আরও উন্নত এবং ফুকুশিমার দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও নিরাপদ করতে ভিভিইআর টিওআই (T-Typical, O-Optimized, I-Informatized) মডেলের পরমাণুচুল্লি রাশিয়া ২০০৯ সালে ডিজাইন শুরু করে শেষ করে ২০১২ সালে।
ভিভিইআর টিওআই মডেলের পরমাণুচুল্লি ভিভিইআর-১২০০ মডেল থেকে অনেক উন্নত। এগুলো দুর্ঘটনার সময় বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ৭২ ঘণ্টাব্যাপী কোর বিপর্যয় থেকে চুল্লিকে রক্ষা, অধিক মাত্রায় ভূমিকম্প প্রতিরোধক্ষমতা, দ্রুততম সময়ে চুল্লির নির্মাণ, স্বল্পতম জায়গায় অধিক বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম, স্বল্পতম রক্ষণাবেক্ষণ সময়, অধিক প্ল্যান্ট ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টর, কম মাত্রায় বর্জ্য উৎপাদন, জ্বালানিসাশ্রয়ী, প্রচলিত ফুয়েল ছাড়াও মিক্সড অক্সাইড ফুয়েল ব্যবহারযোগ্য, যা ভিভিইআর-১২০০ মডেলে নেই। এ ধরনের চুল্লি রাশিয়া নিজ দেশে এবং তুরস্কে ২০১৬ সালে নির্মাণ করতে যাচ্ছে। কাজেই আমাদের উচিত হবে ভারতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অধিক নিরাপত্তা ও দক্ষতাবিশিষ্ট পরমাণুচুল্লি রূপপুরে বসানো। এমনিতেই রূপপুর হচ্ছে একটি ঘনবসতিপূর্ণ জায়গা এবং মাটির ধরনও নরম প্রকৃতির বিধায় সুস্থিত করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। প্রাথমিক ব্যয় একটু বেশি হলেও দেশের ভবিষ্যতের নিরাপত্তা, প্রযুক্তি হস্তান্তর, দক্ষ চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি সাশ্রয়ী ইত্যাদির কথা বিবেচনায় এনে রূপপুরের জন্য আধুনিক মডেলের পরমাণুচুল্লি নির্বাচন করা সমীচীন হবে।
এ ক্ষেত্রে শুধু সাশ্রয়ী বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে এবং কিছু কিছু সিস্টেমকে মডিফাইড করে উন্নত ভার্সন দাবি করে চুল্লি নির্মাণ করলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। পারমাণবিক প্রযুক্তি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। কাজেই তড়িঘড়ি না করে কারিগরি বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পরমাণু প্রযুক্তি সম্পর্কে যাদের সম্যক জ্ঞান রয়েছে, তাদের দিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে উপযুক্ত মানের চুল্লি নির্বাচন করা হবে যৌক্তিক।
ড. মো. শফিকুল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও লেখক: পরমাণু শক্তির জানা অজানা বই।
[email protected]