কোণঠাসা এরদোয়ান টিকে থাকতে পারবেন তো?

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
ছবি: এএফপি


গত দুই যুগের বেশি সময়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান কখনোই এমন গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়েননি। সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপকে পাল্টাপাল্টি ব্যবহার করে উভয় অক্ষেই সজীবতা ধরে রেখেছিলেন এরদোয়ান। তবে সম্ভবত এই প্রথম পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বর্তমানে ঘরে-বাইরে কোণঠাসা এরদোয়ান। অভ্যন্তরীণভাবে একেপির জনসমর্থনে সীমাহীন ধস নেমেছে। আর বাইডেনের বিজয় নতুন করে সিরিয়া ও লিবিয়ায় বড় হাঙ্গামার আশঙ্কা বৃদ্ধি করেছে, যা সরাসরি তুরস্কের জাতীয় নিরাপত্তা এবং এরদোয়ানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িত। আসছে পরিস্থিতি এরদোয়ানের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। নিয়ন্ত্রণহীনতা রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দিতে পারে। অস্থিতিশীল হতে পারে তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্য।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বৈধতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণ করে। ২০০২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রায় পুরোটা এরদোয়ানের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল। যার দরুন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তুরস্কের অবস্থান মজবুত হয়েছিল। তবে ২০১৬ সালের ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এরদোয়ানের নিয়ন্ত্রণ ক্রমে জটিলতার সম্মুখীন হতে থাকে। এই পরিস্থিতিকে আরও বিপর্যস্ত করেছে প্রথমত রুগ্‌ণ অর্থনীতি, দ্বিতীয়ত একেপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল-পরবর্তী ভাঙন। একেপি থেকে পদত্যাগ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাভুতোগলু এবং সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী আলী বাবাজান নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। অভিযোগ উঠিয়েছেন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অর্থনৈতিক ব্যর্থতা সম্পর্কে। এসব গুরুতর অভিযোগ ভোটের জরিপে একেপিকে পিছিয়ে দিয়েছে। বর্তমানের প্রায় সব জরিপে একেপির ভোট ৪৬ থেকে প্রায় ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে।

এরদোয়ানবিরোধীরা আশা করছেন, একেপি ভেঙে গঠিত হওয়া নতুন দুই দল আগামী নির্বাচনে একেপির কমবেশি ৭ থেকে ১০ শতাংশ ভোট কাটবে। ভোটের এই নতুন হিসাব নিশ্চিতভাবেই বিরোধী জোটকে ক্ষমতায় আসীন করবে। দ্বিতীয়ত, দুর্বল অর্থনীতি। ২০ বছর ধরে এরদোয়ানের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি ছিল স্থিতিশীল অর্থনীতি। ধর্ম আর পুঁজিবাদকে মিশ্রণ করে নতুন এক পলিটিক্যাল অর্থনীতির জন্ম দিয়েছিলেন, যা ক্রমাগত এরদোয়ানের রাজনৈতিক অবস্থান সুসংহত করেছে। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকেই সৌদি-মার্কিন বলয়ের অব্যাহত ঘোষিত এবং অঘোষিত অবরোধ, সিরিয়া ও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রভাব এবং শেয়ারবাজার থেকে ইউরোপিয়ানদের বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার ঘটনা তুরস্কের অর্থনীতির প্রাণ সংহার করেছে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এরদোয়ানের অবস্থান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চিত্র থেকে ভিন্ন নয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এরদোয়ান সম্পূর্ণভাবে কোণঠাসা। আরব বিশ্বে মোহাম্মাদ বিন সালমান; ইসরায়েল, ভূমধ্যসাগর ও উত্তর আফ্রিকায় এমানুয়েল মাখোঁ; সামগ্রিকভাবে আসছে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে এস-৪০০, সিরিয়া, লিবিয়াসহ এরদোয়ানের তালিকায় রয়েছে দীর্ঘ ‘মীমাংসার অযোগ্য’ দ্বিপক্ষীয় সমস্যা। এসব সমস্যাকে এককভাবে সামনে এগিয়ে নেওয়ার মতো শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পাটাতন আঙ্কারার নেই।

সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যা এবং কাতার অবরোধ নিয়ে বিন সালমান ও সৌদি বলয় আঙ্কারার ওপর অঘোষিত অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। তুরস্কের পণ্য বয়কট, টিভি সিরিয়ালগুলো নিষিদ্ধের পাশাপাশি আরবদের তুরস্ক ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। মরক্কো, কুয়েত ও আমিরাতের বেশ কিছু কোম্পানি তুরস্ক ছেড়ে চীনের পথ ধরেছে। এদিকে ভূমধ্যসাগরের সমুদ্রসীমা এবং লিবিয়া নিয়ে মাখোঁ পুরো ইউরোপকে আঙ্কারার বিপক্ষে সংগঠিত করেছেন। সৌদি বলয় এবং মাখোঁর নেতৃত্বে যখন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় তুরস্কবিরোধী জোট গঠন হয়েছে, ঠিক তখনই ওয়াশিংটন থেকে অবরোধের খবর এসেছে। ক্ষমতা ছাড়ার ঠিক শেষ মুহূর্তে ওয়াশিংটনের ক্ষমতাবৃত্তের চাপে ট্রাম্প স্বল্প পরিসরে সিএএটিএসএ বিলের আওতায় আঙ্কারার ওপর অবরোধ আরোপ করেছেন।

বাইডেন এবং সৌদি বলয়ের স্রোতের বিপক্ষে ব্যক্তি এরদোয়ান হয়তো টিকে থাকতে পারবেন, কিন্তু সামগ্রিকভাবে একেপির ক্ষমতায় টিকে থাকা অসম্ভব হবে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে না। বৃহৎ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হবে। এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং মার্কিন-ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্রমাগত অবরোধ এরদোয়ানকে আরও বেশি মস্কোঘেঁষা করবে।

দুঃসংবাদের ভিড়ে আঙ্কারাকে একমাত্র সুসংবাদ দিয়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল। ভূমধ্যসাগরের সীমানাসংক্রান্ত বিবাদ নিয়ে মাখোঁর প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবরোধবিষয়ক সিদ্ধান্ত আগামী মার্চ পর্যন্ত জার্মানির ম্যার্কেল ঠেকিয়ে দিয়েছেন। ইউরোপের সামগ্রিক স্বার্থ এবং বাইডেন প্রশাসনের নীতিতে আস্থা রেখে ম্যার্কেল ধীরেসুস্থে এগোতে চান; মাখোঁর আসছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকেন্দ্রিক হিসাব থেকে নয়। ২০ জানুয়ারি বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণ করার পর যদি আঙ্কারা যেকোনো সমঝোতা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন অবরোধ ঠেকানো অসম্ভব হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্রমাগত অবরোধের সম্মুখীন এবং ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুঁজি করে প্রধান বিরোধী দলগুলো একজোট হয়েছে। মিলন হয়েছে ‘ইসলাম পন্থা’ এবং কামালবাদের মধ্যে। ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে আশু নির্বাচনের দাবি।
তবে এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে এরদোয়ানের রাজনৈতিক সুদিন প্রত্যক্ষভাবে নির্ভর করছে আসছে বাইডেন প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য নীতির ওপর। সচেতন পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে বাইডেন প্রশাসন চাইলেই কি এরদোয়ানকে সরে যেতে হবে! না, বিষয়টি এমন সরল নয়। বাইডেন এবং সৌদি বলয়ের স্রোতের বিপক্ষে ব্যক্তি এরদোয়ান হয়তো টিকে থাকতে পারবেন, কিন্তু সামগ্রিকভাবে একেপির ক্ষমতায় টিকে থাকা অসম্ভব হবে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে না। বৃহৎ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হবে। এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং মার্কিন-ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্রমাগত অবরোধ এরদোয়ানকে আরও বেশি মস্কোঘেঁষা করবে। ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য যা সুখকর হবে না।

ওয়াশিংটনের ক্ষমতাবৃত্ত, বাইডেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবরোধের বিপক্ষে আঙ্কারার কর্মপদ্ধতি এরদোয়ান জোরালো ঘোষণা করেছেন। ভাঙবেন কিন্তু মচকাবেন না। পশ্চিমের ঝড়ের বিপক্ষে নিঃসঙ্গ আঙ্কারা ও এরদোয়ান লড়াই করতে চান। বৃহৎ অর্থনৈতিক অবরোধ, অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা এবং সিরিয়া, লিবিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহারসহ প্রায় সম্ভাব্য সব পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত আঙ্কারা ও এরদোয়ান। এই লড়াইয়ে স্বল্প পরিসরে মস্কো, বেইজিং ও দোহাকে পাশে পাবেন এরদোয়ান। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সিসিদের ক্ষমতায় নিয়ে আসে। মার্কিনরা এক দশক ধরেই আঙ্কারায় নতুন একজন সিসির খোঁজে আছেন বলে বারবার বিভিন্ন সেমিনার, সংলাপ ও মিডিয়ায় ইঙ্গিত দিয়েছেন। মেয়াদের শেষ মুহূর্তে এস–৪০০ নিয়ে ট্রাম্পের আকস্মিক অবরোধ বারবার আঙ্কারায় সিসি-বিন সালমানের মতো পাশ্চাত্যপন্থী কামালবাদীদের আগমনের ইশারা দিচ্ছে।

রাহুল আনজুম মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক