কোভিড কি মুক্ত বাণিজ্যকে দূরে ঠেলে দেবে

যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত চীনকে ঠেকাতে কিছুদিন আগে কোয়াড বা অনানুষ্ঠানিক কৌশলগত ফোরাম গঠন করেছে। তার পরপরই ভূ-অর্থনীতিতে বড় আরেকটি ঘটনা ঘটে গেল। যে চীনকে ঠেকাতে অস্ট্রেলিয়া অন্যদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, সেই চীনের নেতৃত্বেই বিশ্বের বৃহত্তম আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে (রিজিওনাল কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ বা আরসিইপি) অস্ট্রেলিয়া স্বাক্ষর করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধের আমলের আদর্শকেন্দ্রিক ভূরাজনীতি ও অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে এল।

অস্ট্রেলিয়া ও চীন—এ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গভীর হলেও সম্প্রতি তাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত তেতে উঠেছে। ২০১৯ সালেও দেশ দুটির মধ্যে ১৫৮ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, অন্যান্য দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সাধারণত বাণিজ্য উদ্বৃত্ত থাকে চীনের অনুকূলে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম। অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। শুধু তা-ই নয়, গত বছর অস্ট্রেলিয়ার ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ রপ্তানির গন্তব্য ছিল চীন। আবার অস্ট্রেলিয়া সবচেয়ে বেশি আমদানিও করে চীন থেকে। চীনই তার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। কিন্তু ভূরাজনীতির সমীকরণে সেই সম্পর্কে কিছুটা হলেও ভাটা পড়বে বলা যায়। অন্যদিকে চীন ভারতেরও বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার, যদিও তাদের মধ্যকার ঐতিহাসিক বিবাদ এখন ভূরাজনৈতিক বিবাদে রূপ নিচ্ছে।

তবে মুক্ত বাণিজ্য এখনো এক অলীক স্বপ্নের মতো। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল পর্যায়ে মুক্ত বাণিজ্য করেনি বা বাজার খুলে দেয়নি। উন্নতির একটি পর্যায়ে যাওয়ার পরই তারা সেটা করেছে। অর্থাৎ জাতিগত স্বার্থই সবকিছুর আগে। যা দরকার তা হলো বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থা দুর্বল রাষ্ট্রের অনুকূলে নিয়ে আসা। বৈশ্বিক বাণিজ্য নিয়ে আলোচনার বদলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ বাণিজ্য চুক্তি ও ব্লকগুলোকে টপকে ‘ভাগ করো ও দখল করো’ নীতি গ্রহণ করেছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, যেখানে বৈশ্বিক পরিসরে মুক্ত বাণিজ্যের জগৎ সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল, সেখানে এক বিসদৃশ ও নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য জগৎ সৃষ্টি হলো। প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরের উভয় পারের অধিকাংশ বাণিজ্যই এখন এই চুক্তির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে, যেমন আরসিইপি। বলা হবে, এটি মুক্ত বাণিজ্য। কিন্তু পণ্যের জটিল উৎসবিধি নিয়ে হাজার হাজার পাতা লেখা হবে, যেটা দক্ষতার মৌলিক নীতি ও পণ্যের অবাধ প্রবাহের বিরোধী। যেখানে ভূরাজনীতিই অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূল কথা হয়ে দাঁড়াবে।

ভূরাজনীতিতে যে রূপান্তর হয়েছে, তার পেছনে কাজ করেছে চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা। গরিব দেশগুলোকে বিনা শর্তে ঋণ দিয়ে নিজের কাছে টেনেছে তারা। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের ঋণ পেতে যেখানে নানা শর্ত পূরণ করতে হয়, সেখানে চীনা ঋণ অনেকটাই সহজে পাওয়া যায়। তবে চীন সিঙ্গেল কোম্পানি বিডিংয়ে বিশ্বাসী। অর্থাৎ তাদের কাছ থেকে ঋণ নিলে তাদের দেশের নির্দিষ্ট কোম্পানির কাছ থেকেই সব কাঁচামাল কিনতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় তারা আফ্রিকায় অনেক বড় বড় প্রকল্প করেছে। ফলে আফ্রিকার অনেক দেশ এখন দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে এসেছে। চীন এভাবে টাকা ছড়িয়ে নিজের অবস্থান শক্ত করেছে। ভূ-অর্থনীতি মূলত তাদের হাত ধরেই এসেছে। অর্থাৎ রাজনীতি নয়, অর্থনীতি দ্বারা পরিচালিত হওয়া।

অস্ট্রেলিয়ার এভাবে একই সঙ্গে কোয়াড ও আরসিইপিতে যোগ দেওয়া সেই রাজনীতিরই বহিঃপ্রকাশ। প্রয়োগবাদী রাজনীতি বলা যায় একে। বাংলাদেশ একই সঙ্গে ভারত ও চীনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। এ দেশের বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণে চীন বিনিয়োগ করছে। তাই স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশ চীনবিরোধী ভূকৌশলগত পরিকল্পনায় যোগ দেয়নি। তবে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকলেও বাণিজ্য সম্পর্ক খুব খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আরসিইপি সেই সম্ভাবনা আরও নস্যাৎ করবে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক যতই খারাপ হোক, তাদের বাণিজ্য সম্পর্কে বিশেষ প্রভাব পড়বে না বলেই মনে হচ্ছে, যদিও ভারত আরও স্বনির্ভর হতে চীনের বিনিয়োগ ঠেকানোর নানা চেষ্টা করছে।

প্রয়োগবাদী এই রাজনীতির সঙ্গে আরেকটি দৃশ্যমান ব্যাপার হচ্ছে সুরক্ষাবাদী অর্থনীতি। মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ সে কারণেই। এমনকি এই দুটি শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ এখনো নিজেদের বাণিজ্য নানাভাবে সুরক্ষিত করছে। যুক্তরাষ্ট্র সুতাসহ কৃষিজাত পণ্য থেকে ভর্তুকি তুলে নিতে রাজি নয়। বিশ্ব বাণিজ্যে ভারসাম্য আনার জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ‘দোহা ডেভেলপমেন্ট রাউন্ড’ শীর্ষক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বহু বছর উদ্দেশ্যহীন আলোচনার পর সেটা ভেস্তে গেছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ভণ্ডামির কারণেই তা ঘটেছে।

মুক্ত বাণিজ্য আগে থেকেই ছিল অধরা হরিণের মতো, কোভিডের ধাক্কায় তা আরও দূরে চলে যাবে। কয়েক বছর ধরে চলা সুরক্ষাবাদী অর্থনীতি কোভিডের ধাক্কায় স্বাভাবিকভাবেই আরও শক্তি পাবে। এটা যে শুধু রাজনৈতিক কারণে হবে তা নয়, কোভিডের চূড়ান্ত সময়ে যে সরবরাহ ঘাটতি দেখা গিয়েছিল, তাতে অনেক দেশই প্রয়োজনীয় উপকরণ তৈরিতে মনোযোগী হচ্ছে। ফলে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নতুন রূপ পাবে। যাঁরা বিশ্ব অর্থনীতির অঙ্গীভূতকরণের কথা বলেন, তাঁদের ঘাড়ে বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা সংস্কারের বিশেষ দায়িত্ব বর্তেছে। বিশ্বব্যবস্থায় দুর্বলেরা যদি শুধু শাস্তিই পায়, তাহলে তারা আগ্রহী হবে না। আর প্রয়োগবাদী রাজনীতি বা অর্থনীতির যে ধারা তৈরি হয়েছে, তাতে সবাই নিজের রাস্তা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করবে। সবকিছু শেষমেশ নির্ভর করবে মানুষের ইচ্ছার ওপর। তবে ভূরাজনীতি ও অর্থনীতিতে নতুন অনেক পরিবর্তন আগামী দিনগুলোতে দেখা যাবে।

প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক