কোভিড-১৯ ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি উন্নত গণতন্ত্রবিশিষ্ট ধনী দেশ ইতিমধ্যেই তাদের অর্ধেকের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে টিকা দিতে সক্ষম হয়েছে এবং তার সুবাদে সেসব দেশে সংক্রমণ ও সংক্রমণজনিত মৃত্যুর হার নাটকীয়ভাবে কমেছে। অন্যদিকে ভারত, ব্রাজিল ও আফ্রিকার কিছু অংশে টিকাদানের হার কম এবং মৃত্যু ও সংক্রমণের হার অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে।

দ্য ইকোনমিস্ট-এর হিসাবমতে, এই মহামারিতে সারা পৃথিবীতে মারা যাওয়া মানুষের প্রকৃত সংখ্যা এক কোটির মতো। অর্থাৎ, আনুষ্ঠানিকভাবে যত মানুষ মরার ঘোষণা আসছে, প্রকৃত সংখ্যা তার তিন গুণের বেশি।

এই নিদারুণ পরিসংখ্যান দেখার পর ধনী দেশগুলোর নেতাদের কি নিজের দেশের নাগরিকদের টিকা দেওয়া শেষ হওয়ার আগেই অন্য দেশগুলোতে টিকা রপ্তানি করা এবং বিদেশিদের টিকা পাওয়া নিশ্চিত করতে সহায়তা দেওয়া উচিত হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘আগে আমেরিকার স্বার্থ’ স্লোগান দিয়ে মার্কিন নাগরিকদের মন জয় করতে চেয়েছিলেন, তখন তাঁর সমর্থকেরা এটিকে গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ় অবস্থান নিয়ে ট্রাম্প ভুল করেননি। কিন্তু আমি আমার ডু মোরালস ম্যাটার? শীর্ষক বইয়ে বলেছিলাম, জাতীয় নেতারা জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা কীভাবে নির্ধারণ করছেন, সেটিই বড় প্রশ্ন। ট্রাম্পের মতো সংকীর্ণ সংজ্ঞায় একটি ভূখণ্ডের মানুষের স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থ হিসেবে চিহ্নিত করা এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আরও বৃহৎ পরিসরের সংজ্ঞার মধ্যে বড় ধরনের নৈতিক তফাত আছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের গৃহীত মার্শাল প্ল্যানের কথা ধরুন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্রদের যুদ্ধ বাবদ নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু ট্রুম্যান ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের ২ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ইউরোপের সহায়তায় উৎসর্গ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেই সহায়তার কারণে ইউরোপিয়ান দেশগুলো নিজেদের অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করতে পেরেছিল। এটি ইউরোপের জন্য যেমন উপকার বয়ে এনেছিল, তেমনি এর কারণে পশ্চিম ইউরোপকে কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রণে যাওয়া থেকে ঠেকিয়েছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থে বিরাট অবদান রেখেছিল। মার্শাল প্ল্যানের আদলে আজকের দিনে দরিদ্র দেশগুলোকে টিকা সরবরাহ করলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষিত হতে পারে।

প্রথমত, আমেরিকানদের মেডিকেল স্বার্থেই এটি করা জরুরি। মনে রাখা দরকার, মানুষ মারার ক্ষেত্রে ভাইরাস কোনো ব্যক্তির জাতীয়তার পরিচয় ভেদাভেদ করে না। ভাইরাস এমন মানবদেহের খোঁজ করে, যে দেহে তারা বংশ বিস্তার করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভাইরাস যত বেশি সময় পাবে, তত মানুষের দেহে তা ছড়ায় এবং নতুন নতুন ধরনে নিজেদের বদলে ফেলে। দ্রুত সব মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় না আনতে পারলে ভাইরাসটির এমন সব ধরন তৈরি হবে, যা ঠেকাতে বর্তমান ভ্যাকসিন অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। সেটি হলে আমাদের আবার ভ্যাকসিনের নতুন সংস্করণ উদ্ভাবন করতে হবে।

ভ্যাকসিনকে সর্বজনীন করার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ নিহিত থাকার দ্বিতীয় কারণটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক মূল্যবোধকে সংহত রাখা। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা যেহেতু গণতন্ত্রে এবং মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করে, সেহেতু দেশের বাইরের মানুষ মহামারিতে মারা যাবে এবং যুক্তরাষ্ট্র শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে—এই নীতি তারা গ্রহণ করতে পারে না।

তৃতীয়ত, এই টিকা সহায়তা যুক্তরাষ্ট্রের সফট পাওয়ারকে আরও টেকসই করবে।

আশার কথা হলো, বাইডেন প্রশাসন ছয় কোটি অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি ফাইজার, মডার্না এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের দুই কোটি টিকা ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া গরিব দেশের টিকা কার্যক্রমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তহবিলে চার শ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এই ধারা অব্যাহত রেখে যুক্তরাষ্ট্র যদি তার সাবেক মার্শাল প্ল্যানের মতো কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে একটি বৈশ্বিক সহায়তা পরিকল্পনা করে, তাহলেই মূলত তার জাতীয় স্বার্থ সবচেয়ে বেশি সংরক্ষিত হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জোসেফ এস. নাই হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক