কোরবানির ঈদ ও বন্যার্তদের গরুর ন্যায্যমূল্য

বন্যার্তরা শুধু নিজেরা না, গবাদি পশু নিয়েও পড়েছেন বিপাকে
ছবি: প্রথম আলো

সামনে পবিত্র ঈদুল আজহা। মূলত এই ঈদ মাথায় রেখে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খামারি ও প্রান্তিক কৃষকেরা গবাদিপশু, বিশেষ করে গরু পালন করে থাকেন। সিলেট, ময়মনসিংহ ও উত্তরবঙ্গের বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে এ মুহূর্তে মানুষের পাশাপাশি কষ্টে আছে পশুগুলো। বন্যার পানি স্বাভাবিক উচ্চতা থেকে নেমে যাওয়ার পরও নিম্নাঞ্চল থেকে তা নামতে বেশ সময় লাগবে। আবার বর্ষার কারণে দক্ষিণাঞ্চলের চরসহ এসব স্থানের জমি আদৌ পশুখাদ্য জন্মানোর মতো উপযুক্ত হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

ঈদুল আজহায় কৃষকেরা তাঁদের প্রিয় পশুটিকে উপযুক্ত দামে বিক্রি করতে চাইবেন। তাই সরকারের উচিত হবে একটি কেন্দ্রীয় কাঠামো তৈরি করে এসব স্থানের কৃষকদের গবাদিপশু উপযুক্ত দামে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করা। নচেৎ দালাল, অসাধু মৌসুমি ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিগ্রস্ত করপোরেটরা কৃষকদের ঠকাবে।

বন্যাকবলিত সিলেট অঞ্চলে গবাদিপশু নিয়ে কতটা বিপাকে আছেন কৃষক ও খামারিরা, তা জানতে সুনামগঞ্জকেন্দ্রিক একটি ফেসবুক পেজে পোস্ট দেওয়া হয়। সেখানে বেলাল হোসাইন নামের এক খামারি গরু বিক্রির আকুতি জানিয়ে মন্তব্য করেন। বেলাল হোসাইনের বাড়ি সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার বীরগাঁও গ্রামে। সেখানে তাঁরা কয়েকজন মিলে কোরবানিতে বিক্রির জন্য ১৮টি ষাঁড় লালন করছেন। কিন্তু বন্যায় খামার ভেসে যাওয়ায় ও বর্তমানে খাদ্যাভাবে ষাঁড় পালনে খুব কষ্ট হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে শনিবার (২৫ জুন) গরুগুলো স্থানীয় জাউয়া বাজারে তোলা হবে। পরে মুঠোফোনে কথা হয় বেলাল হোসাইনের সঙ্গে, তিনি জানালেন দু-একজন দালাল বা ক্রেতা এলেও গরুর দাম অনেক কম বলছেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি জানিয়েছেন, ৫০ হাজার টাকার গরু সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকা দাম বলা হচ্ছে। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, তাঁর বাড়ির দুই থেকে আড়াই কিলোমিটারের মধ্যে এমন আরও ২০টির মতো খামার রয়েছে। পাশাপাশি কৃষকদের ঘরেও দু-চারটি করে গরু আছে। কিন্তু সবার অবস্থায়ই খারাপ। দাম অত্যন্ত কম বলায় পারতপক্ষে কেউই গরু বিক্রি করছেন না। বন্যায় ভেসে যেতে থাকা খড়কুটো জোগাড় করেই বেশির ভাগ মানুষ তাঁদের গবাদিপশুগুলো সড়ক ও সেতুর ওপর বাঁচিয়ে রেখেছেন।

বন্যার পানি দু-চার দিনের মধ্যে নেমে গেলেও, বিশেষ করে সিলেট বিভাগের মানুষ এখনই ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না। যার একটি প্রভাব পড়বে সিলেট বিভাগের পশুর অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদার ওপরও। কারণ, এবারের ঈদে সেখানকার ভোক্তাদের সংখ্যা কমে আসবে।

একই তথ্য জানা গেল সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কলেজশিক্ষক মইনূর রহমানের কাছ থেকে। ২০টি গরু নিয়ে তাঁর একটি খামার রয়েছে। তিনিও এখনো বিপাকে পড়েছেন প্রাণীগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে। এ নিয়ে কথা হয় প্রথম আলোর সিলেটের নিজস্ব প্রতিবেদক সুমনকুমার দাশ ও সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার প্রতিবেদক অমিত কান্তি দেবের সঙ্গে। ঈদ উপলক্ষে কোরবানির গরুর দাম কেমন হবে, এখনই তাঁরা তা আন্দাজ করতে পারছেন না। কারণ, এখন মানুষ নিজের জীবন নিয়েই ব্যস্ত। তবে একটি পক্ষ যে কম দামে গরু কেনার পাঁয়তারা করছে, তা ইতিমধ্যে তাঁরা লক্ষ করছেন।

বন্যার পানি দু-চার দিনের মধ্যে নেমে গেলেও, বিশেষ করে সিলেট বিভাগের মানুষ এখনই ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না। যার একটি প্রভাব পড়বে সিলেট বিভাগের পশুর অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদার ওপরও। কারণ, এবারের ঈদে সেখানকার ভোক্তাদের সংখ্যা কমে আসবে। এ নিয়ে কথা হয় প্রথম আলোর বাণিজ্য বিভাগের নিজস্ব প্রতিবেদক ফয়জুল্লাহ ওয়াসিফ ও বাসসের নিজস্ব প্রতিবেদক সৈয়দ এলতেফাত হোসাইনের সঙ্গে। তাঁরা দুজনই সিলেটের মানুষ। এর মধ্যে এলতেফাতের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায়। তাঁরা জানালেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অনেকেই এবার কোরবানি দিতে পারবেন না। আবার অনেকে আগের তুলনায় কোরবানি দেওয়ার পরিসর কমিয়ে ফেলবেন। অর্থাৎ হয়তো যিনি একটি গরু দিয়ে কোরবানি দিতেন, তিনি এবার শরিকি কোরবানি দেবেন বা ছাগল কোরবানি দেবেন।

আরও পড়ুন

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় বলছে, সিলেট জেলায় গরুর সংখ্যা ১২ লাখ, মহিষ ৬০ থেকে ৭০ হাজার, ছাগল ২ লাখ, ভেড়া ৬০ থেকে ৬৫ হাজার। সুনামগঞ্জে গবাদিপশুর সংখ্যা ২০ লাখের মতো। বৃহস্পতিবার (২৩ জুন) রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জানিয়েছেন, এ বছর দেশে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর সংখ্যা ১ কোটি ২১ লাখ। গত বছরের তুলনায় এই সংখ্যা প্রায় ২ লাখ বেশি। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশে মোট ৯০ লাখ ৯৩ হাজার গবাদিপশু কোরবানি হয়েছিল। এবারও চাহিদার চেয়ে বেশি পশু আছে বলে জানানো হয়। তাহলে স্পষ্ট যে চলমান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কারণে উদ্বৃত্ত পশুর সংখ্যা আরও বেশি হবে। ফলে এর প্রভাব পড়তে পারে দামের ওপর (তবে ভোক্তার ক্ষেত্রে তা হওয়ার সম্ভাবনা নেই, ভোগ করবেন মধ্যস্বত্বভোগীরা)। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন বন্যাকবলিত এলাকার প্রান্তিক কৃষকেরা। আর এই প্রান্তিক মানুষের সংখ্যা কেমন, তা একটু তথ্যের দিকে নজর দিলেই আন্দাজ করা সম্ভব। কারণ, চলমান বন্যায় সিলেট বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যায়।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) মতো প্রতিষ্ঠাগুলো বলছে, বন্যার দুর্যোগ থেকে দীর্ঘমেয়াদি বাঁচতে হলে প্রাকৃতিক জলাশয়-জলাভূমি রক্ষা করতে হবে। বিগত দশকগুলোতে হাওরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উন্নয়নকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বন্যাসহ অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলার প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার উপাদান নষ্ট করে বিপদ ডেকে আনা হয়েছে। নদীতে ড্রেজিং প্রকল্প কতটুকু কাজে আসছে, তার কোনো বিশ্লেষণ ও তদারকি নেই। বর্ষা শুরু হতে না হতে কয়েক দফা বন্যার দেখা পেলাম আমরা। সামনে আরও বন্যার হওয়ার আশঙ্কা আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী বছরগুলোতেও নিয়মিতভাবে এ ধরনের বন্যা দেখা দিতে পারে।

ভারতের আসাম, মেঘালয়, চেরাপুঞ্জির যে রেকর্ড বৃষ্টিকে চলতি বন্যার জন্য প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে, তা কি এমনি এমনি হচ্ছে? গবেষকেরা তা বলছেন না। পাহাড়ের বন উজাড় করা হচ্ছে। বৃষ্টি দ্রুত মাটি হয়ে নদীর পথ ধরছে। ফলে সরু পথে গরু আটকে যাওয়ার মতো অবস্থা হচ্ছে। একই অবস্থা কিন্তু আমাদের পার্বত্য অঞ্চলেও। তাই পরের ঘরের কথা চিন্তা না করে নিজের ঘরের দিকে আগে সতর্ক হতে হবে।

  • মো. ছানাউল্লাহ প্রথম আলোর সহসম্পাদক