কৌটিল্যের শাস্ত্র ও বাংলাদেশের রাজকোষ সুরক্ষা

সাধারণত ভালো কাজগুলো বিধি বা শাস্ত্র অনুযায়ী হয়ে থাকে। নিয়ম-নীতির বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করতে গেলে সেটা ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য পীড়ন, পীড়া কিংবা ব্যাধিতে পর্যবসিত হতে বাধ্য। শুভকাজের পাশাপাশি দমন, রোধ-প্রতিরোধ কিংবা প্রতিষেধকের ক্ষেত্রেও শাস্ত্রনীতি প্রযোজ্য। রাষ্ট্রের দুর্নীতি, অনিয়ম, চুরি দমনেও শাস্ত্র নির্দেশিত পদ্ধতির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

সম্প্রতি দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তৎপরতা লক্ষণীয়। শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার আগে সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, বেতন-ভাতা বেড়েছে, এরপরও দুর্নীতি কেন?

দুদকের তৎপরতা ও প্রধানমন্ত্রীর কথায় যে বার্তা পাওয়া যায়, তাতে ধরে নেওয়া যায় সরকার এখন দুর্নীতি-অনিয়মে জর্জরিত রাষ্ট্রের ভগ্ন স্বাস্থ্য উদ্ধারে মনোযোগী। প্রশ্ন হলো, এই অভিযানে শাস্ত্রীয় পদ্ধতির প্রয়োগ কতখানি হবে?

গত এক দশকে বাংলাদেশে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে, এর উত্তর খুঁজতে গেলে বলতে হবে, কাজটি খুবই দুরূহ। বরং দুর্নীতি, অনিয়ম, রাষ্ট্রের অর্থ চুরি-লুটপাটের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এর মধ্যে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চলে যায় ফিলিপাইনে। বাকি ২ কোটি ডলার যায় শ্রীলঙ্কায়।

২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংক হোটেল রূপসী বাংলা শাখা (বর্তমানের হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল) থেকে কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে হল-মার্ক নামের একটি অখ্যাত প্রতিষ্ঠান ব্যাংকটির ২ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। জালিয়াতির আরেকটি বড় শিকার বেসিক ব্যাংক। ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত মাত্র ১১ মাসে নজিরবিহীন অনিয়মের মাধ্যমে এই ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে বিভিন্নজনকে দিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় একই সময়ে বিসমিল্লাহ গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণের নামে ১ হাজার ১৭৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এম এইচ গোল্ডেন জুট মিলসহ আটটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেয় ৮৫৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। নিয়মনীতি না মেনে এক গ্রাহককেই মাত্র ৬ বছরে জনতা ব্যাংক দিয়েছে ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা। আছে ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির কথাও।

২০১৬ সালের ২৪ জুন প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তার আগের ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার, টাকার অঙ্কে যা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। মালয়েশিয়ার ‘মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে টাকা পাঠিয়েছেন ৩ হাজারের বেশি ব্যক্তি।

এত এত অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট, তাহলে শাস্ত্র কী করছে। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে চাণক্য, ওরফে কৌটিল্য ওরফে বিষ্ণুগুপ্ত নামের এক ভারতীয় দার্শনিক ‘অর্থশাস্ত্র’ নামের একখানা গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। রচনাটি বাস্তবে রাজনীতিবিজ্ঞান সম্পর্কিত হলেও ইতিহাসে ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ নামে বেশি পরিচিত।

ভারতে মৌর্য শাসনের শুরু করেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। সেই রাজার প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষাগুরু ছিলেন কৌটিল্য। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সেই সময় কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে যা লিখে গেছেন, তা আজকের রাজনীতি, কূটনীতি, প্রশাসন ব্যবস্থাপনা, সমাজনীতি ও অর্থনীতিতে সমানভাবে প্রযোজ্য।

কৌটিল্য তাঁর শাস্ত্রে লিখেছেন, ‘সকল উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করে অর্থের ওপর। সে জন্য সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে খাজাঞ্চিখানার দিকে। তহবিল আত্মসাতের ২৪টি পদ্ধতি আছে। জিহ্বার ডগায় বিষ রেখে যেমন মধুর স্বাদ আস্বাদন সম্ভব নয়, তেমনি একজন লোক রাজকর্মচারী হয়ে রাজার রাজস্বের সামান্য পরিমাণ না খেয়ে বসে থাকবেন, এটা অবিশ্বাস্য। জলের নিচের মাছের গতিবিধি যেমন লক্ষ করা সম্ভব নয়, তেমনি রাজকর্মচারীর তহবিল আত্মসাৎ করাও পর্যবেক্ষণ করা অসম্ভব। আকাশের অতি উঁচুতে পাখির ওড়াউড়ি দেখা সম্ভব, কিন্তু রাজকর্মচারীর সকল কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া অসম্ভব।’

কৌটিল্য সেই আমলেই অর্থ আত্মাসাৎকারী মুদ্রারাক্ষস কিংবা রাজার রাজকোষ তছরুপকারী রাজকর্মচারীদের শনাক্ত করার জন্য গোয়েন্দা নিয়োগের কথা তাঁর শাস্ত্রে লিখে গেছেন। আর মুদ্রারাক্ষসদের পাকড়াও করতে গোয়েন্দা হিসেবে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন বিশেষ নারীদের।

পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, অর্থনীতি ও দুর্নীতির সঙ্গে শাস্ত্রের সম্পর্ক কোথায়। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের অর্থ ক্ষেত্রে যা কিছু ঘটেছে, তা কৌটিল্যের শাস্ত্রের বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় না ঘটিয়েই ঘটেছে। হল-মার্কের জালিয়াতি সম্পর্কে তদন্ত করে ২০১২ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের দুর্বল তদারকির কারণে হল-মার্ক জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। জালিয়াতির প্রক্রিয়া গ্রাহক তানভীর মাহমুদ (হল-মার্কের পরিচালক) কর্তৃক উদ্ভাবিত ছিল না, ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখার ব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমান কর্তৃক উদ্ভাবিত। তাঁর সঙ্গে জড়িত ছিলেন অন্য কর্মকর্তারা। তদন্ত কমিটি আরও বলেছিল, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী পেনশন অ্যাকাউন্টের কাজ ছাড়াও হোটেল রূপসী বাংলার কোনো অনুষ্ঠানে গেলে এ কে এম আজিজের অনুরোধে ব্যাংকের শাখাতে গিয়েছেন। তাঁর পদমর্যাদা অনুযায়ী ওই শাখায় ঘন ঘন যাতায়াত মানানসই নয়। শাখা ব্যবস্থাপক উপদেষ্টার ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়েছিলেন।

সংসদীয় ওই তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন বর্তমানের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। আর সংসদীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন বর্তমানের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সংসদীয় কমিটি শেষ পর্যন্ত ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেনি।

দুদকের তদন্তে বেসিক ব্যাংকের টাকা জালিয়াতিতেও ওই ব্যাংকের ২৭ কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ সদস্যদের দায়ের কথা বলা হয়েছিল। বিসমিল্লাহ গ্রুপের অর্থ জালিয়াতির ঘটনাতেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর একাধিক কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয়টি তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। জনতা ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের ঘটনাতেও ব্যাংকের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগ আছে।

কৌটিল্যের শাস্ত্র মোতাবেক আলোচিত সব দুর্নীতিতে সরকারি কর্মকর্তাদের নাম উঠে এসেছে। সাধারণ অর্থসংক্রান্ত দুর্নীতিতে সম্পদশালী হয় কিছু ব্যক্তি। সম্পদ হারায় রাষ্ট্র তথা জনগণ। সোনালী, বেসিক ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের জালিয়াতির ঘটনায় নিশ্চিতভাবে দেশের কেউ না কেউ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশে ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা। এই ঘটনা সরাসরি দেশের বাইরে ও ফিলিপাইনের কিছু চোরাকারবারি ও ক্যাসিনো ব্যবসায়ীদের সম্পদশালী করেছে। গত জানুয়ারিতে দেশটির আদালত অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগে স্থানীয় রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতোকে ৩২ থেকে ৫৬ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন। অথচ বাংলাদেশে কারও টিকিটিও স্পর্শ করা যায়নি।

শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমি জানি, দুর্নীতি নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে অস্বস্তি রয়েছে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত লোকজনকে নিজেদের শোধরানোর আহ্বান জানাচ্ছি। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হবে। আমরা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি নির্মূল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।’

এখানে বলা আবশ্যক, এ যুগের দুর্নীতিবাজরা সব ধরনের দুর্নীতিতেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে থাকে। সুতরাং সরকারও দুর্নীতির দমনে প্রযুক্তির ব্যবহার করবে, এটা খুবই সহজ হিসাব। কিন্তু তারও আগে ভাবতে হবে, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের প্রারম্ভিক প্রয়োগপদ্ধতি নিয়ে। সেখানে ব্যর্থ হলে রাজকোষের সুরক্ষায় প্রযুক্তির প্রয়োগ কোনো কাজে আসবে না। সতর্ক থাকতে হবে রাজকর্মচারী ও রাজকোষ সম্পর্কে। মনে রাখতে হবে, রাজকর্মচারী সুযোগ পেলেই খাজাঞ্চিখানার কিঞ্চিৎ সম্পদ নিজের পকেটে পুরে নেবে।

হারুন আল রশীদ: সাংবাদিক