কৌতূহলের কেন্দ্রে ভাসানচর

ভাসানচরের বয়স খুব বেশি নয়, ২০ থেকে ৩০ বছর। বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৪.৫ কিমি প্রস্থের এই চর জেগে ওঠে। ভাসানচর বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় নোয়াখালী জেলায় হাতিয়া উপজেলার অন্তর্গত চর ঈশ্বর ইউনিয়নে অবস্থিত। ভাসানচরের দূরত্ব সন্দ্বীপ উপজেলার পশ্চিম প্রান্ত থেকে ৫ কিমি এবং হাতিয়া সদর উপজেলা থেকে ২৫ কিমি। ২০১৭ সালের শেষের দিকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করলে তারা আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে আসে। ভাসানচরকে রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুতদের আবাসনের স্থান হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ‘আশ্রায়ণ-৩’ নামে একটি প্রকল্প বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গাদের আবাসনসহ জীবন-জীবিকার জন্য আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়।

ভাসানচরের যাত্রাপথ
একটি গবেষণা দল হিসেবে ভাসানচরে যাওয়ার জন্য নৌবাহিনীর জাহাজে করে গত মাসে (নভেম্বর) চট্টগ্রাম নেভি ক্লাব থেকে সকাল ১০টার দিকে আমরা যাত্রা শুরু করি। আমাদের ভাসানচরে পৌঁছাতে সময় লাগল প্রায় তিন ঘণ্টা। ভাসানচরে পা রাখতেই প্রথম চোখে পড়ল বড় সাইনবোর্ড, তাতে লেখা ‘ফরোয়ার্ড বেইস ভাসানচর—বাংলাদেশ নৌবাহিনী’। উল্লেখ্য, অন্যান্য চর, যেমন হাতিয়া, সন্দ্বীপ অথবা চেয়ারম্যানবাড়ির ঘাট থেকেও ভাসানচরে যাওয়ার সুযোগ-সুবিধা আছে।

ভাসানচরে যেভাবে পলিমাটি জমতে শুরু করেছে, তা ফসল উৎপাদনের জন্য উপযোগী। বিভিন্ন ধরনের ফলের চাষও হচ্ছে। চরের বড় জলাশয়ে চাষ হচ্ছে রুই, কাতলা, বোয়ালসহ বিভিন্ন মাছ।

সুযোগ-সুবিধা
চর এলাকা হলেও এখানে সবুজের কোনো কমতি নেই। আশপাশে গড়ে উঠেছে ম্যানগ্রোভ বন, জন্মেছে অনেক শ্বাসমূল। এই ম্যানগ্রোভ বন লবণাক্ত পানির সৃষ্টি হলেও ভাসানচরে সুপেয় পানির কোনো অভাব নেই। বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছে ৭৫০-৮০০ ফুট গভীর নলকূপ। প্রথম দেখাতে কেউ ধারণা করতে পারবে না যে এই চরে জীবন ধারণের সব সুবিধা পাওয়া যেতে পারে।

ভাসানচরে নামার সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ে বিস্তর সবুজ মাঠ, অনেক গাছপালা এবং মহিষের পাল। আশপাশে কোনো স্থানীয় মানুষ দেখা যায় না। পরে ‘আশ্রয়ণ ৩’-এর প্রকল্প পরিচালক কমোডর আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই চরে স্থানীয় মানুষের সংখ্যা কম। এখানে স্থানীয় মানুষেরা এসেছে হাতিয়া, সন্দ্বীপ ও নোয়াখালী থেকে ব্যবসায় ও পশুপালনের উদ্দেশ্যে।

তিনি আরও বলেন, ‘আশ্রয়ণ ৩’ প্রকল্পে দুই বছর ধরে দেশি-বিদেশি ৩২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখানে কাজ করছে। এই প্রকল্পে রয়েছে ১২০টি ক্লাস্টার হাউস। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসের অধীনে রয়েছে একটি সাইক্লোন শেল্টার। পরিবেশের কথা চিন্তা করে ক্লাস্টার হাউসে রান্নার জন্য রয়েছে বায়োগ্যাসের সুবিধা। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসের জন্য রয়েছে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা, তৈরি করা হয়েছে জলাশয় দৈনন্দিন কাজের জন্য। এ ছাড়া তৈরি করা হয়েছে চারটি মসজিদ, দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং রয়েছে শিশুদের জন্য অনানুষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা। চিকিৎসাসেবা দানের জন্য ২০ শয্যার ২টি হাসপাতাল ও ৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক।

দুর্যোগ মোকাবিলা ব্যবস্থা
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কথা মাথায় রেখে এই আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পের কাজ হাতে নেয় সরকার। প্রকল্পটিকে আশ্রয়ণ-৩ নামকরণের কারণ, পরবর্তী সময়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পর এই চর বাংলাদেশের ভূমিহীন মানুষের আবাসনের জন্য ব্যবহার করা হবে। বিভিন্ন খবরে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের কথা বলা হলেও অনেকেই এই প্রস্তাবকে ভালো দৃষ্টিতে গ্রহণ করেনি।

যেহেতু ভাসানচর একটি চর এলাকা, তাই রোহিঙ্গাদের চলাফেরার স্বাধীনতার, জীবিকা নির্বাহের তাগিদ নিয়ে শঙ্কা, ভয় ছাড়াও রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা। কিন্তু স্বচক্ষে দেখলে বোঝা যায় যে স্থানটি বসবাসের জন্য বেশ উপযোগী। দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য নেওয়া হয়েছে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। ১৭৬ বছরের ঘূর্ণিঝড় পর্যালোচনা করে প্রতিরোধব্যবস্থা হিসেবে ১২০টি ক্লাস্টারের প্রতিটিতে ১টি করে মোট ১২০টি পাঁচতলাবিশিষ্ট শেল্টার হাউস নির্মাণ করা হয়েছে।

নৌবাহিনীর তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় প্রতিটি শেল্টার হাউস এমনভাবে প্রস্তুত, যা ঘণ্টায় ২৬০ কিমি ঝোড়ো বাতাসের মধ্যেও টিকে থাকবে। বন্যা, জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলার জন্য চরের চারপাশ ঘিরে ৯ ফুট উঁচু পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে ১৯ ফুট পর্যন্ত উঁচু হবে বলে জানিয়েছেন নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা। বাঁধের ৫০০ মিটার দূরে পানিতে নির্মাণ করা হয়েছে শোর প্রোটেকশন, যাতে সমুদ্রের বড় ঢেউ থেকে চরকে রক্ষা করা যায়।

জীবনযাত্রা
ভাসানচরের স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে চরের জীবনযাত্রা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা গেল। চরের বড় মাঠে পাওয়া গেল কিছু রাখালকে। তাঁদের সবার মূল পেশা মহিষ পালন। তাঁদের মধ্যে একজন স্থানীয় রফিক (২৬) জানান, এখানে তাঁরা সবাই মহিষ পালন করেন। কিন্তু এই মহিষগুলো তাঁদের নয়, মালিকদের। ২০ হাজার টাকার মতো আয় হয় বছরে।

এ ছাড়া তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ লাউ, মরিচ ও অন্যান্য শাকসবজি চাষ করে ভালো ফল পেয়েছেন। তাঁরা আট মাসের বেশি সময় ধরে এখানে বসবাস করছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব এই চরে আছে কি না, জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, কোনো দুর্যোগের প্রভাব এই চরে দেখা যায়নি। এমনকি ঘূর্ণিঝড় আম্পানে কোনো ক্ষয়ক্ষতি ভাসানচরে হয়নি, এমনকি পানিও ওঠেনি।

এখানের স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মহিষের দুধ সন্দ্বীপ ও হাতিয়ার স্থানীয় বাজারে পাঠানো হয় ট্রলারযোগে। এই ট্রলারই অন্য দ্বীপ ও আশপাশের এলাকায় যাতায়াতের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রাখালদের জন্য ট্রলারভাড়া প্রয়োজন না হলেও অন্যদের জন্য ভাড়া ২০০ টাকা। তাঁরা এখানে বাংলাদেশ নৌবাহিনী কর্তৃক বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ পেয়ে থাকেন।

আরও কিছু স্থানীয় মানুষের দেখা পাওয়া গেল বাজারে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা কেউ এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা নন, জীবিকার তাগিদে ভাসানচরে এসেছেন। এখানে মূলত তাঁদের কারও শাকসবজি, মুদি ও খাবারের দোকান এবং সিলিন্ডারের দোকান আছে। তাঁদের মধ্যে একজন জাবেদ ইকবাল (৩৪)। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, বাজারে এখন কেনাবেচা কম, সবার আয় কম। তাঁরা এখন রোহিঙ্গাদের এখানে আসার জন্য অপেক্ষা করছেন, যাতে তাঁদের কেনাবেচা বাড়ে এবং ব্যবসায় সফলতা আসে।

স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখানে চুরি-ডাকাতির কোনো ঘটনা ঘটে না। বাজারে এক দোকানি মোহাম্মাদ আবদুল্লাহ (৩০) বললেন, তাঁদের দোকান কোনো সময় বন্ধ করে তালা দিয়ে যেতে হয় না। কারণ, এখানে চুরির কোনো ভয় নেই। এ ছাড়া নৌবাহিনীর সহায়তায় ভাসানচরে গড়ে উঠেছে খামার। এই খামারগুলোতে মহিষ, ভেড়া, কবুতর, মুরগি, খরগোশ ও টার্কি পালন করা হয়। বিশেষজ্ঞের মতে, ভাসানচরে যেভাবে পলিমাটি জমতে শুরু করেছে, তা ফসল উৎপাদনের জন্য উপযোগী। বিভিন্ন ধরনের ফলের চাষও হচ্ছে। চরের বড় জলাশয়ে চাষ হচ্ছে রুই, কাতলা, বোয়ালসহ বিভিন্ন মাছ।

ভাসানচর নিয়ে কৌতূহল ও মতামতের শেষ নেই। কারণ, এর পেছনে রয়েছে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার হস্তক্ষেপ। বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন মতামত হলেও প্রত্যক্ষ দর্শনে বলা যায় যে ভাসানচর বসবাসের জন্য উপযোগী।

কিন্তু যেহেতু রোহিঙ্গাদের আবাসনের প্রশ্ন আসছে, তাই এই প্রকল্প অন্য রূপ নিয়েছে, নজর রয়েছে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ভাসানচরে স্থানান্তর হলেও সবাই মানবাধিকার পাবে কি না, এটিও দেখার বিষয়। এ ছাড়া রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়। এই সব প্রতিকূলতা এড়িয়ে বাংলাদেশ সরকার কী কী পদক্ষেপ নেবে, এখন তা-ই দেখার জন্য পুরো বিশ্বের নজর এখন বাংলাদেশের দিকে।

ড. মো. রফিকুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক।