ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্বকে সারাতে ধনী দেশগুলোর দায় বেশি

আগামী ৪ জুলাই স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র কোভিড-১৯ মহামারি থেকে ‘স্বাধীনতা লাভ উদ্‌যাপন’ করবে বলে আশা করছে। ওই সময়ের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্ক সবার কাছে এই রোগের ভ্যাকসিন পৌঁছে যাবে। কিন্তু এখনো বহু উন্নয়নশীল ও উদীয়মান বাজারের দেশ এই সংকট মোচন থেকে বহু দূরে আছে।

ইনস্টিটিউট ফর নিউ ইকোনমিক থিংকিংয়ের (আইএনইটি) কমিশন অন গ্লোবাল ইকোনমিক ট্রান্সফরমেশনের একটি প্রতিবেদনে আমরা দেখিয়েছি, সারা বিশ্বকে করোনামুক্ত করতে হলে প্রতিটি দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ‘স্বাধীনতা’ ঘোষণা করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আর সবার কাছে টিকা না পৌঁছানো পর্যন্ত সেটি অর্জন করা সম্ভব হবে না।

করোনাভাইরাস নিজে টিকে থাকার জন্য নিজেকে নিয়ত পরিবর্তন করে। যতক্ষণ এটি সারা বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, ততক্ষণ তা প্রত্যেক মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলে রেখেছে। এটি বিশ্ববাসীকে এতটাই ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে যে বিশ্বের প্রত্যেক লোকের কাছে যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিন, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) এবং থেরাপি যন্ত্রের সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব আইনের মারপ্যাঁচে বড় বড় ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন ও সুরক্ষা সরঞ্জাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখায় এখন পর্যন্ত তা সবার কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব আইন সংস্কারের জন্য অনেক আগে থেকেই দাবি উঠলেও তা ঝুলে আছে। বর্তমানে কোভিড-১৯ মহামারি সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে হলে অন্তত এ–সংক্রান্ত মেধাস্বত্বকে হয় স্থগিত, না হয় পুরোপুরি বিলুপ্ত করে দিতে হবে। অনেক দেশ, বিশেষ করে ভ্যাকসিনের মেধাস্বত্ব স্থগিত করার দাবি তুলেছে। তারা বলছে, মেধাস্বত্ব উঠিয়ে দেওয়া হলে তাদের দেশের ওষুধ কারখানায় স্থানীয়ভাবে ভ্যাকসিন উৎপাদন করা সম্ভব হবে। কিন্তু করপোরেট লবি এবং উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো এই দাবির বিরোধিতা করছে। ‘মহামারি জাতীয়তাবাদ’-এর উত্থান বৈশ্বিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টির মালিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সীমাবদ্ধতার নানা দিক উন্মোচন করে দিয়েছে।

উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনীতিকে আবার চাঙা করার জন্য প্রায় জোর করেই ক্ষতির মুখে পড়া ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে কাজে ফিরিয়ে আনছে। অনেক গরিব দেশ এখনো তাদের প্রণোদনা তহবিল সংগ্রহে চেষ্টা করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তার অর্থনীতির সহযোগিতায় জিডিপির ২৫ শতাংশ ব্যয় করেছে, সেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অতি অল্প পরিমাণ ব্যয় করতে পারছে।

বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা যে হিসাব করেছি, তাতে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতিকে চাঙা করতে মাথাপিছু ১৭ হাজার ডলার খরচ করেছে, যা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর চেয়ে ৮০০০ গুণ বেশি।

উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনীতিকে আবার চাঙা করার জন্য প্রায় জোর করেই ক্ষতির মুখে পড়া ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে কাজে ফিরিয়ে আনছে। অনেক গরিব দেশ এখনো তাদের প্রণোদনা তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তার অর্থনীতির সহযোগিতায় জিডিপির ২৫ শতাংশ ব্যয় করেছে, সেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অতি অল্প পরিমাণ ব্যয় করতে পারছে

নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তা প্রদর্শন না করে উন্নত দেশগুলো যদি তিনটি নীতি নিয়ে এগোয়, তাহলে বৈশ্বিক পুনরুদ্ধার অনেকখানি সহজ হয়ে যাবে। প্রথমত, এই দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) আগের চেয়ে বেশি অর্থ জমা করতে হবে এবং আইএমএফ যাতে সব সদস্যদেশের অনুমোদনের অপেক্ষা ছাড়াই দ্রুততার ভিত্তিতে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য বরাদ্দ দিতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, স্বল্পোন্নত দেশগুলো যাতে সহায়তা হিসেবে পাওয়া অর্থ যথাযথভাবে খরচ করতে পারে, সে জন্য আইএমএফকে বিশেষ নজরদারির ক্ষমতা দিতে হবে। তৃতীয়ত, যেসব স্বল্পোন্নত দেশ অতি দেনায় ডুবে আছে এবং দেনার কারণে কোভিড-১৯ মোকাবিলা ও বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে পারছে না, উন্নত দেশগুলোকে সম্মিলিতভাবে তাদের উদ্ধার করতে এগিয়ে আসতে হবে। মহামারির শুরুতে মনে করা হয়েছিল, ঋণের কিস্তির অর্থ পরিশোধ থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অব্যাহতি দিলেই তা যথেষ্ট হবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, অনেক দেশই আছে সম্পূরক ঋণ ছাড়া তারা চলতে পারবে না।

এই নীতিগুলো অনুসরণ করা হলে বৈশ্বিক বাজারে স্থিতিশীলতার হাওয়া বইতে শুরু করবে এবং একযোগে বিশ্বব্যাপী করোনা মোকাবিলার কাজ পরিচালনা করা সহজ হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট


মাইকেল স্পেন্সজোসেফ ই. স্টিগলিৎস—দুজনই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ এবং জ্যোতি ঘোষ ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস এমহার্স্টের অর্থনীতির অধ্যাপক