ক্ষমা করে দিয়ো 'বঙ্গ বাহাদুর'

বঙ্গ বাহাদুরকে নিয়ে আর কাউকে ভাবতে হবে না। আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৬টায় জামালপুরের সরিষাবাড়ীর কয়ড়া গ্রামের মাঠে মারা গেছে হাতিটি। ছবি: শফিকুল ইসলাম
বঙ্গ বাহাদুরকে নিয়ে আর কাউকে ভাবতে হবে না। আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৬টায় জামালপুরের সরিষাবাড়ীর কয়ড়া গ্রামের মাঠে মারা গেছে হাতিটি। ছবি: শফিকুল ইসলাম

কিছুক্ষণ আগে কথা হলো প্রথম আলোর সরিষাবাড়ী প্রতিনিধি শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। প্রথম আলো অনলাইনে আজ সকালে প্রকাশিত তাঁর পাঠানো সংবাদেই জানতে পারি সেই হাতিটি স্থানীয় মানুষদের কাঁদিয়ে মারা গেছে। তারপরও তাঁকে জিজ্ঞেস করি, হাতিটি মারা যাওয়ায় গ্রামের মানুষের প্রতিক্রিয়া কী? ‘হাতিটি আমাদের কোনো ক্ষতি করেনি, বন বিভাগের লোকজন এসে হাতিটাকে মেরে ফেলল।’ স্থানীয় লোকজন শফিককে এভাবেই বলেছেন কথাগুলো। সাধারণ মানুষের সাধারণ আবেগতাড়িত প্রতিক্রিয়া এ রকমই। কিন্তু কথাটা কি মিথ্যা?

ভারতের আসাম থেকে বন্যার পানিতে ব্রহ্মপুত্র নদ বেয়ে কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গত ২৮ জুন আসে এই হাতিটি। নদীপথ ধরে ধরে এরপর ২৭ জুলাই হাতিটি ঢোকে জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলায়। সরিষাবাড়ীতে আসার পরই এই হাতিটিকে বশে আনার সরকারি উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। ভারতীয় বিশেষজ্ঞ দল এসেছিল, তারা অপারগতা প্রকাশ করে ফিরে যায়। এরপরের চেষ্টা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগগুলোর।


সরিষাবাড়ীতে আমার নিজের বাড়ি। প্রতিদিনই খোঁজ নিচ্ছিলাম হাতিটির গতিবিধির। ৯ আগস্ট চলে যাই সরিষাবাড়ীতে। বিকেলে পৌঁছে শফিকুল ইসলামের কাছে জানতে পারি সেদিনের হাতি উদ্ধার অভিযান শেষ। কিছুই করা যায়নি। ভাটারা ইউনিয়নের ফুলবাড়িয়া গ্রামে যখন পৌঁছালাম, তখন বন বিভাগের লোকজন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ফিরে আসছেন। তারপরও নদীর পাড়ে গেলাম। এলাকার মানুষজন জানালেন দূরের চরে চলে গেছে হাতিটি। উদ্ধার অভিযান নিয়ে তাঁরা সন্তুষ্ট নন। তাঁদের মতে, যে যন্ত্রপাতি বা প্রস্তুতি নিয়ে উদ্ধারকারী দল ​এসেছে, তা এই হাতি ধরার জন্য যথেষ্ট নয়। পরের দিন সকালেই আবার অভিযান শুরু হবে।


১০ আগস্ট সকাল সকাল প্রস্তুতি নিলাম। বেলা ১১টার দিকে জানা গেল হাতি ধরার অভিযান আজও স্থগিত করা হয়েছে। ট্র্যাংকুলাইজার বন্দুক দিয়ে চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগের চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু সিরিঞ্জের সুই হাতির চামড়ায় বিঁধতে পারেনি। সারাটা দিন পড়ে ছিল কিন্তু অভিযানের আর চেষ্টাই হয়নি। স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে যাই কামরাবাদ ইউনিয়নের ধারাবর্ষা গ্রামে। নৌকা নিয়ে ঝিনাই নদ ধরে আমরা যাই পারপাড়া গ্রামে। নৌকা থেকেই দেখলাম হাতিটি কলাগাছ চিবোচ্ছে। গ্রামের মানুষ দূর থেকেই দেখছে। এরপর হাতিটি নেমে যায় নদীতে। তার দ্রুতগতির সাঁতারও দেখি। ওপারের ফুলবাড়িয়া গ্রামে নদীর তীরে অনেক মানুষ দাঁড়ানো। সাঁতরে হাতি নিমেষেই পৌঁছে যায় তীরের কাছাকাছি। তারপর তীর ধরে হাঁটা। ভঙ্গিটা ছিল রাজকীয়, তবে তার মধ্যে অসহায়ত্বও দেখা যায়।

অনেকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, যখন হাতিটি ডাঙায় থাকে, তখন ওকে ধরে ফেলা যায়। কিন্তু যাঁরা তাকে ধরতে এসেছেন, তাঁরা ‘ভয়’ পান।


ঢাকা ফিরে এসে পরের দিনই অর্থাৎ ১১ আগস্ট খবর পাই হাতিটিকে বাগে আনা গেছে। ততক্ষণে হাতিটি স্থান বদলে কামরাবাদ ইউনিয়নের কয়ড়া গ্রামে। বাগে আনার ব্যাপারেও মুখ্য ভূমিকা সাধারণ মানুষের। বন্দুক দিয়ে হাতির শরীরে প্রবেশ করানো হয় চেতনানাশক ওষুধ। এর বেশ কিছুক্ষণ পর হাতিটি পাশের এক ডোবায় নেমে পড়ে এবং জ্ঞান হারায়। তখন ভেটেরিনারি সার্জন কয়ড়া গ্রামের মানুষদের ডাকেন হাতিটিকে উদ্ধার করার জন্য। সাহসী সাবেক এক ইউপি সদস্য মকুল মিয়া ডুব দিয়ে হাতির পায়ে রশি বেঁধে দেন। তারপর কয়েক শ মানুষ হাতিটিকে টেনে ডাঙায় তোলে। গাছের সঙ্গে শিকল আর রশি দিয়ে উদ্ধারকারীরা হাতিটিকে বেঁধে ফেলেন। ততক্ষণে এর নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গ বাহাদুর’।


১১ আগস্ট রাতে হাতির চেতনা ফিরে আসে কিন্তু দাঁড়ায় না। বঙ্গ বাহাদুরের জীবন সংশয়ের আশঙ্কার শুরুটা তখন থেকেই। পরদিন ভোরে হাতিটি উঠে দাঁড়ায়। এরপর শিকল-রশি ইত্যাদির বাঁধন ছিঁড়ে হাতিটি আবার মুক্ত হয়ে ডোবায় নেমে পড়ে। স্বাভাবিক প্রশ্ন, কেমন করে বাঁধা হলো যে হাতিটি সে বাঁধন ছিঁড়তে পারল? আবার বাগে আনার পালা। আবার চেতনানাশকের প্রয়োগ। পরে আবার বাগে আসে বঙ্গ বাহাদুর। কয়েকবার চেতনানাশকের প্রয়োগে ঝিমের মধ্যে থাকতে থাকে হাতিটি। তার পায়ে শিকল আর ডান্ডাবেড়ি পরানোর সময়ে বন বিভাগের এক কর্মীও আহত হন। ১৫ আগস্ট শিকল-টেকল নিয়ে হাতিটি বারবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে আর বারবার পড়ে যায়। গতকাল ১৫ আগস্ট সারা দিন কাদাময় খেতে খোলা আকাশের নিচে পড়ে ছিল বঙ্গ বাহাদুর। খাওয়াদাওয়াও হয়নি। জানলাম, কাল দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত ১২টার মতো স্যালাইন দেওয়া হয়েছিল তাকে। কিন্তু আজ ভোরে একেবারেই নিথর হয়ে যায় বঙ্গ বাহাদুর।


হাতি উদ্ধারের পুরো প্রক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে, এ ধরনের বন্য প্রাণীকে বাগে আনা বা তাকে বাঁচানোর মতো দক্ষতা আমাদের নেই। সরিষাবাড়ী এমন একটা অঞ্চল, যার আশপাশে কোনো বন নেই। মুক্ত বুনো হাতি আসার ঘটনাও এই প্রথম। ঘরবাড়ি, খেতখামারের কিছু ক্ষতিও করেছে হাতিটি, কিন্তু মানুষ তা আন্তরিকভাবে অবলা প্রাণীর প্রতি মমত্ববোধ থেকে মেনে নিয়েছে। তাই তো আজ সেখানকার বাতাসে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কয়েকজনকে ফোন করে জানলাম কয়ড়া গ্রামটি এখন শোকের গ্রামে পরিণত হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, উদ্ধারকারীদের কাজে অবহেলা ও অদক্ষতার ছাপ ছিল। আর তা তো বোঝাই যায়। বঙ্গ বাহাদুর জুন মাসে ঢোকে বাংলাদেশে। তারও এক মাস পরে শুরু হয় অভিযান। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পরও উদ্যোগ নিতে যথেষ্টই দেরি হয়েছে। আর বাগে আনার পর যা হলো তা তো এক কথায় অদক্ষতার প্রকাশই।

বিশেষায়িত কাজে কিংবা জরুরি প্রয়োজনে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বা ওষুধের অপ্রতুলতা—এসব আমাদের আর কত দিন শুনতে হবে? তাই বঙ্গ বাহাদুর, তুমি ক্ষমা করে দিয়ো আমাদের।

পল্লব মোহাইমেন: সাংবাদিক ও লেখক