ক্ষমা চাইতে বা নাকে খত দিতে হবে কেন?

ডিসেম্বর যেমন আমাদের বিজয়ের মাস, তেমনি গণতন্ত্রেরও মাস। ৪৬ বছর আগে পাকিস্তানিদের পরাস্ত করে আমরা বিজয় লাভ করেছি। আর ২৭ বছর আগে স্বৈরাচারকে তাড়িয়ে আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি। এখন যদি সেই স্বৈরাচার গণতন্ত্রকে সবক দেয়, আস্ফালন দেখায়, নিজের শাসনামলকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে তাহলে বুঝতে হবে পরবর্তী ২৭ বছর যাঁরা দেশ শাসন করেছেন, তাঁদের কোথাও না কোথাও ভুল আছে। গণতন্ত্র ও সুশাসনের ঘাটতি আছে। স্বৈরাচারের আমলের মতোই যদি গণতান্ত্রিক শাসকেরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দমন-পীড়ন চালায়, তাহলে স্বৈরাচারের সঙ্গে আর তাদের ফারাক কোথায়?

শুধু মুখের কথায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে পৃথিবীতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রই এক নম্বর আসনটি দখল করে নিত। কেননা গণতন্ত্র, নির্বাচন ও গণমাধ্যম নিয়ে বছরজুড়ে এত বাক্যবর্ষণ আর কোনো দেশের নেতা-নেত্রীরা করেন বলেন জানা নেই। তবে সাম্প্রতিক কালে আরেকজন নেতা গণমাধ্যম নিয়ে হরদম কথা বলে যাচ্ছেন—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমাদের নেতা-নেত্রীরা একটি সহজ কথা বুঝতে চান না যে গণতন্ত্র মানে প্রত্যহ জনসভায় সভা-সেমিনারে বক্তৃতা দেওয়া নয়। গণতন্ত্র মানে কে কার চেয়ে কাকে বেশি বাক্যবাণে জর্জরিত করে দলীয় কর্মীদের বাহবা নিতে পারেন, সেই প্রতিযোগিতাও নয়। গণতন্ত্র হলো নিরন্তর অনুশীলন ও চর্চার বিষয়। আপনি অন্যকে যে বিষয়ে নসিহত করবেন, সেগুলো নিজেকেও মেনে চলতে হবে। গণতন্ত্র কখনো আওয়ামী লীগের জন্য এক রকম, বিএনপির জন্য আরেক রকম কিংবা অন্যান্য দলের জন্য ভিন্ন রকম হতে পারে না।

৪৬ বছর আগে যে বাংলাদেশ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে, তারও মূলকথা ছিল গণতন্ত্র। পাকিস্তানের শাসকেরা গণতন্ত্র মানেনি বলেই পাকিস্তান ভেঙেছে। কিন্তু সেই স্বৈরতান্ত্রিক পাকিস্তানি কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার পরও বাংলাদেশ গণতন্ত্রের জন্য বারবার রক্তাক্ত হয়েছে, আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, বহু তরুণের জীবন নষ্ট হয়েছে। আগুনে পুড়ে কিংবা গুলি খেয়েও অনেক মানুষকে মরতে হয়েছে, যাদের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। নতুন করে প্রাণহানি আর সংঘাতের ঘটনা দেশবাসী দেখতে চায় না। দেখতে চায় সব দলের অংশগ্রহণে একটি ভালো নির্বাচন।

২.
বাংলাদেশে নির্বাচনী হাওয়ার জন্য নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার প্রয়োজন পড়ে না। সারা বছর, বলতে গেলে সরকারের মেয়াদজুড়েই একধরনের নির্বাচনী প্রচার চলতে থাকে।

১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আমরা এ রকম মহড়াই দেখে অভ্যস্ত ছিলাম। নির্বাচনে বিজয়ী পক্ষ সবকিছু দখলে নিতে চায়; পরাজিত পক্ষ নির্বাচনের পরদিন থেকে মাঠ গরম করে, পরের মেয়াদের নিজেদের দখলদারি বজায় রাখবে বলে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্যা ফয়সালা জাতীয় সংসদে হয়নি, হয়েছে রাজপথে। কিন্তু ২০১৪ সালের পর সেই দৃশ্য অনেকটা পাল্টে গেছে। এখন আর রাজনীতিতে বিরোধী পক্ষ বলে কিছু নেই। প্রশাসন, জাতীয় সংসদ, জনসভার মাঠ, শিক্ষাঙ্গন, খাল–জলাশয়, হাটবাজার—সর্বত্র ক্ষমতাসীনদের একক আধিপত্য। এতে ন্যুব্জ, দুর্বল ও সদা দৌড়ের ওপর থাকা বিরোধী দলের তেমন ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই।

এই পর্যবেক্ষণে আওয়ামী লীগের বিজ্ঞ নেতারা ক্ষুব্ধ হতে পারেন, কিন্তু একটু ঘরের দিকে তাকালে এ কথার অকাট্য প্রমাণ হাতেনাতে পাবেন। এই যে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ
বনাম আওয়ামী লীগ, যুবলীগ বনাম যুবলীগ, ছাত্রলীগ বনাম ছাত্রলীগ মারামারি-হানাহানি হচ্ছে, তা অনেকটাই কমে যেত বিরোধী দল মাঠে থাকলে। কিছুটা হলেও দলের নেতা–কর্মীদের মধ্যে শক্তি প্রদর্শনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ হতো। এখন তো ‘আমরা সবাই রাজা’।

বছরখানেক আগে যে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হলো, সেই নির্বাচনে প্রাণহানির খতিয়ানটা নিলেই বোঝা যাবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দলীয় আদর্শ ও গণতান্ত্রিক নীতি-মূল্যবোধের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের হাঙ্গামায় বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীর লোকজন কিংবা বিদ্রোহী প্রার্থীর অনুগতদের ওপর মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকেরা সর্বশক্তি দিয়ে ঝঁাপিয়ে পড়েছেন। একে কেউ কেউ শত ফুল ফোটার সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। তবে এই ধারা চলতে থাকলে শুধু ফুলের গাছ নয়, বাগানও সাবাড় হয়ে যাবে।

আরেকটি উদাহরণ হলো শিক্ষাঙ্গন। রাজনীতির মাঠে বিএনপি বা ২০-দলীয় জোট মাঝেমধ্যে শক্তি প্রদর্শনের মহড়া দিলেও শিক্ষাঙ্গন ছিল সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির একেবারেই অভয়ারণ্য। ক্যাম্পাসে বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলো কার্যত নিষিদ্ধ ছিল। সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনটি একতরফা দৌরাত্ম্য চালিয়েছে, এখনো চালাচ্ছে। কয়েক দিন আগে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের এক নিহত নেতার মা সন্তান হত্যার বিচারের দাবিতে অনশন করেছিলেন। সেই সন্তানকে বিএনপি-জামায়াত বা ছাত্রশিবিরের কেউ হত্যা করেনি। তিনি নিহত হয়েছেন ছাত্রলীগেরই প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মীদের হাতে। এরপরও ছাত্রসংসদ নির্বাচন করার বা দেওয়ার সাহস পাচ্ছে না ক্ষমতাসীনেরা। ডাকসুসহ বিভিন্ন ছাত্রসংসদ নির্বাচনের দাবিতে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো নম্র স্বরে আন্দোলন করলেও ছাত্রলীগের নেতারা নিশ্চুপ। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। আর প্রশাসন তাকিয়ে আছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দিকে। সরকার হয়তো তখনই ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেবে, যখন দেখবে তাদের সমর্থক সংগঠনটির জয় নিশ্চিত। এভাবে গণতন্ত্র বিকশিত হয় না।

৩.
আওয়ামী লীগ নেতারা প্রায় প্রতিদিনই বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে আসার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছেন, নির্বাচনে এলে তাদের কী কী সুবিধা হবে, না এলে কী কী অসুবিধা হবে এ সম্পর্কে নিয়মিত জ্ঞান দিয়ে চলেছেন। ভাবটা এমন যে বিএনপিকে উদ্ধারের দায়িত্ব একমাত্র আওয়ামী লীগের। আবার বিএনপির নেতারাও নির্বাচন নিয়ে নানামুখী কথা বলে যাচ্ছেন। কখনো বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে যাবে, ২০১৪ সালের মতো আরেকটি নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না। কখনো বলছেন, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না।

এসব বাহাসের মধ্যে জনগণ নতুন দুটি শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে (আগেও একাধিকবার বলা হয়েছে) নাকে খত দেওয়া এবং ক্ষমা চাওয়া কিংবা ক্ষমা করা। এক পক্ষ বলছে নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে আসতে হবে। আরেক পক্ষ বলছে ক্ষমা চাইতে হবে। ক্ষমা চাওয়ানো কিংবা নাকে খত দেওয়ানো গণতন্ত্রের ভাষা হতে পারে না।

এসব দেখে সত্যিই বলা কঠিন, নির্বাচনটি কেমন হবে। সংবিধান অনুযায়ী পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু কীভাবে? নির্বাচন করার মালিক তো আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নয়। নির্বাচন করার মালিক জনগণ। হ্যাঁ, আওয়ামী লীগ, বিএনপি যদি নিজেদের জনগণের প্রতিনিধি মনে করে, তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। নিজ নিজ কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে ভোট চাইবে। জনগণই ঠিক করবে কাকে তারা বেছে নেবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো জনগণ সেই সুযোগ পাবে কি না। ভোটের সঙ্গে নাকে খত দেওয়া আ ক্ষমা চাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা খুবই জনপ্রিয় ও বিজ্ঞ নেতা-নেত্রী। দল ও সরকার পরিচালনায় তাঁদের আছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। গণতন্ত্রের জন্য, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তাঁরা মাঠে–ময়দানে আন্দোলন করেছেন। আন্দোলন করতে গিয়ে অন্তরীণ হয়েছেন, জেল খেটেছেন। তারপরও একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন দিতে পারেন না, এটি ভাবতেও কষ্ট হয়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজপথে নামতে হবে, আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপিকেও মাঠ গরম করতে হবে, এই রাজনীতি শেষ হওয়া দরকার।

এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, কোনো বিষয়েই আওয়ামী লীগ, বিএনপি একমত হতে পারে না। এক পক্ষ বলে সংবিধানে যা আছে তাই মানতে হবে। আরেক পক্ষ দাবি করে, সহায়ক সরকার গঠন করতে হবে। এক পক্ষ চায় ইভিএম হোক, আরেক পক্ষ তা নাকচ করে দেয়। এক পক্ষ বলে নির্বাচনে সেনাবাহিনী থাকবে। আরেক পক্ষ বলে, সেনাবাহিনী থাকবে না।

আসলে নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি যে ভোটার, তাদের কথা রাজনৈতিক দলগুলো বেমালুম ভুলে যায়। এ কারণে তারা ভোটারদের মন জয় করার কথা ভাবে না। নিজে কী কী ভালো কাজ করেছেন, সে কথা না বলে প্রতিপক্ষকে গালমন্দ করেন। আবার সেই গালমন্দের ভাষাও কখনো কখনো শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। নেতানেত্রীদের এসব কথাবার্তা থেকে নতুন প্রজন্ম কী শিখবে, কী বুঝবে? যত পারুন নিজের ঢোল পেটান। অন্যের সমালোচনা করুন। কিন্তু শালীনতার মাত্রা ছাড়াবেন না।

নির্বাচনের এক বছর আগে থাকতেই ‘নির্বাচনী যুদ্ধ’ বেশ জমে উঠলেও জনগণের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে ভয়টা কাটছে না। তারা ক্ষমা চাওয়ানোর কিংবা নাকে খত দেওয়ানোর নির্বাচন চায় না। তারা চায় এমন একটি নির্বাচন, যাতে সব দল অংশ নেবে, ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবে এবং বাড়িতেও নিরাপদ থাকবে। কারও আক্রমণের শিকার হবে না। সেই নিশ্চয়তা কোনো দল দেয়নি। তারা জনগণকে আশ্বস্ত করার বদলে অন্যের গীবত গেয়ে বেড়াচ্ছে।

এমনকি নির্বাচন কমিশনের কাজেকর্মেও মানুষ ভরসা করতে পারছে, সে কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]