ক্ষমা যখন অযৌক্তিক ও অন্যায়

দণ্ডিত অপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়া নিয়ে সমাজে প্রশ্ন রয়েছে। ক্ষমতাশালী অপরাধীদের সরকার ক্ষমা করে দিলে আইনের শাসনের অস্তিত্ব নিয়েও সংশয় তৈরি হয়। এমন ঘটনা বাংলাদেশে আগে-পরে ঘটেছে। লক্ষ্মীপুরের আইনজীবী নুরুল ইসলামকে টুকরা টুকরা করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া খুনি পর্যন্ত পেয়েছে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা। অথচ ক্ষমা করার বিধানের উদ্দেশ্য এটি নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ বিধান রাখা হয়েছে ভুল বিচারে কেউ শাস্তি পেলে বা অত্যন্ত মানবিক কারণে ক্ষমা করার জন্য।

কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে এ ক্ষমতার উৎস হচ্ছে রয়্যাল প্রেরোগেটিভ অব মার্সি, যা প্রধানত মৃত্যুদণ্ডের বদলে কারাদণ্ড দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হতো। ব্রিটেনে বর্তমানে এটি প্রয়োগ করা হয় অত্যন্ত শক্তিশালী ও সর্বজনগ্রাহ্য কারণে। যেমন ২০২০ সালে এই ক্ষমা পেয়ে স্টিভেন গ্যালান্ট নির্ধারিত সময়ের ১০ মাস আগে প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ পান। অপরাধীদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে ছুরি নিয়ে উন্মত্তভাবে হামলা করা সন্ত্রাসীকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরাস্ত করেছিলেন গ্যালান্ট। তিনি যে একজন সংশোধিত মানুষ, এর একটি বড় প্রমাণ হিসেবে দেখা হয় তা। তঁার প্যারোল লাভ তাই প্রশংসিত হয়েছিল, এর মধ্যে রাজনীতির ছায়াও কেউ খোঁজেনি।

ক্ষমার বিধান কেন রাখা হয়েছে, তার একটি ইঙ্গিত আমরা ভারতের সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদে পাই। ভারতের রাষ্ট্রপতি কোনো অপরাধীর দণ্ড মার্জনা, হ্রাস, বিলম্বিত করতে পারেন, যদি তিনি ক) কোর্ট মার্শাল কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হন খ) যদি এমন বিষয়সম্পর্কিত আইন ভঙ্গের অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হন, যা কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাভুক্ত গ) যেখানে শাস্তিটি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। ভারতের রাজ্যগুলোতে এ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন গভর্নররা। তবে তাঁরা কোনো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ক্ষমা বা দণ্ড হ্রাস করতে পারেন না।

ভারতে এ ক্ষমতার প্রয়োগ হয় মন্ত্রিসভার পরামর্শক্রমে, বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। ভারতের অনুচ্ছেদ ৭২-এর তুলনায় বাংলাদেশের ৪৯ অনুচ্ছেদ সংক্ষিপ্ত। ৪৯ অনুচ্ছেদ ছাড়াও ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় অপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়ার বিধান রয়েছে। উভয় ক্ষমা প্রক্রিয়াতে সরকারের অন্তত দুটো (আইন ও স্বরাষ্ট্র) মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও এখানে মূল ক্ষমতাটি প্রধানমন্ত্রীর। ফৌজদারি কার্যবিধিতে ক্ষমা প্রদর্শনের আগে দণ্ডপ্রদানকারী আদালতের মতামত নেওয়ার বিধান রয়েছে। এটি পুরোপুরি বাধ্যতামূলক না হলেও ন্যায়বিচারের জন্য সহায়ক।

ভারত বা বাংলাদেশের আইনে যত অস্পষ্টতা থাকুক না কেন, ক্ষমা করার বিধানটি যে খেয়ালখুশিমতো প্রয়োগের বিষয় নয়, তা বারবার আদালতের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে।

ভারতে মারু রাম বনাম ইন্ডিয়া মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেন যে ক্ষমার ক্ষমতা কখনো স্বেচ্ছাচারমূলক এবং সাংবিধানিকতার মূল সূত্রকে অগ্রাহ্য করে হবে না। টাটা সেলুলার বনাম ইন্ডিয়া মামলায় বলা হয়, আদালত রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের ওপর আপিল আদালত হিসেবে কাজ করতে পারেন না, তবে কীভাবে ক্ষমার সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে, তা রিভিউ করে দেখতে পারেন। আদালত বিবেচনা করতে পারেন রাষ্ট্রপতি ক) তাঁর ক্ষমতার অতিরিক্ত কিছু করেছেন কি না খ) আইনের ভুল প্রয়োগ করেছেন কি না গ) ন্যাচারাল জাস্টিসের লঙ্ঘন করেছেন কি না ঘ) তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন কি না।

২০০৬ সালের এপুরু সুধাকর মামলায় অন্ধ্র প্রদেশের গভর্নর কর্তৃক একজন দণ্ডিত কংগ্রেস সদস্যের দণ্ড হ্রাসের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয় যে ক্ষমার আবেদন বিবেচনা করার সময় গভর্নরের কাছে প্রাসঙ্গিক সব তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি এবং গভর্নর ঠিকমতো তাঁর বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করতে পারেননি। কংগ্রেস সদস্য তাঁর আবেদনে রাজনৈতিক শত্রুতার শিকার হয়ে মামলায় শাস্তি পেয়েছেন এ অজুহাত দিয়েছিলেন। আদালত এ অজুহাত অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রাসঙ্গিক বলে রায় দেন। আদালত রায় দেন যে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আইনগত যুক্তিগ্রাহ্যতার (লিগ্যাল রিজনেবলনেস) বাইরে কিছু হতে পারে না।

৩.

ভারতে কোনো ব্যক্তিকে পলাতক থাকা অবস্থায় ক্ষমা করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে বাংলাদেশে এমন একটি সিদ্ধান্ত অতীতে আদালতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ২০১২ সালে সারওয়ার কামাল বনাম রাষ্ট্র মামলায় উচ্চ আদালত ১৯৯৩ সালের ১২ এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সারওয়ার কামালকে পলাতক অবস্থায় ক্ষমাকে এখতিয়ার-বহির্ভূত বলে রায় দেন (১৯৯৭ সালে দায়েরকৃত ক্রিমিনাল রিভিশন মামলা ৮০১)। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি এস এম জাকির হোসেন রায়ের ভিত্তি হিসেবে আপিলেট ডিভিশন কর্তৃক অন্তত ছয়টি মামলার উল্লেখ করেন, যেখানে বলা হয়েছে, পলাতক ব্যক্তিকে আইনগত প্রতিকার দেওয়া যায় না।

এই রায় প্রদানের আগে আদালত ক্ষমা পাওয়ার জন্য যেসব নোট ও দলিলপত্র সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে, তা জমা দিতে বলেন। কিন্তু আদালতের কাছে শুধু সারওয়ার কামালের স্ত্রীর একটি আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয়। সেখানে ‘রাজনৈতিক অন্যায় ষড়যন্ত্রের’ কারণে সারওয়ার কামাল ও তাঁর দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছিল বলে বলা হয়। তথ্য-প্রমাণ ছাড়া শুধু এমন আবেদনের ভিত্তিতে ক্ষমা প্রদর্শন ন্যায়বিচার হতে পারে না বলে আদালত অভিমত জানান।

মামলাটির রায়ে সরকারের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তত ছয়টি জিনিস অবশ্যই জমা দিতে হবে বলা হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মামলার এজাহার ও পুলিশ প্রতিবেদন, সাক্ষ্য, বিচারিক আদালত এবং আপিল আদালতের রায় থাকলে সেটি, মামলা বা আপিল চলাকালে দোষী ব্যক্তি জামিনে আছে, নাকি বন্দী আছে, নাকি পলাতক অবস্থায় আছে, সেই তথ্য, দণ্ডিত হওয়ার পর কত দিন জেলে আছে এবং মোট কত বছরের শাস্তি সে পেয়েছে, সে অন্য কোনো মামলায় অভিযুক্ত বা দণ্ডিত রয়েছে কি না। এসব বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে শুধু আবেদনকারীর আবেদনের ভিত্তিতে কাউকে ক্ষমা প্রদর্শন করলে তা সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ বা ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুসারে হবে না, বরং তা হবে পক্ষপাতদুষ্ট এবং ভ্রান্তিপূর্ণ।

আদালতের মন্তব্য ছিল এই যে যদি এসব তথ্য ও প্রমাণ রাষ্ট্রপতির এবং সরকারের কাছে পেশ করা হতো, তাহলে তারা সম্ভবত অন্য রকম সিদ্ধান্ত নিত। ‘কারণ এটি অনুমিত যে রাষ্ট্রপতি এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো এই আইনের বিষয়ে ভালো করে জানে যে জেনেশুনে একজন পলাতককে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ বা ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় ক্ষমা করা অবশ্যই স্বেচ্ছাচারমূলক, অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অযৌক্তিক এবং অসংগত এবং এভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করা আইনের শাসন পরিপন্থী এবং ক্ষমতার অপব্যবহার।’

আদালত রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সত্ত্বেও সারওয়ার কামালকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলেন এবং তিনি চাইলে আদালতের পর্যবেক্ষণ অনুসারে নতুন করে ক্ষমার আবেদন করতে পারবেন বলে রায় দেন। আদালত ৪০১ ধারার অধীনে কাউকে ক্ষমা করার ক্ষেত্রে কোনো মানদণ্ড বা গাইডলাইন নেই বলে সরকারকে তা তৈরি করতে বা প্রয়োজনে সিআরপিসি সংশোধন করতে বলেন। বিতর্ক, সমালোচনা ও ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে এটি দ্রুত সম্পন্ন করার তাগিদ দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তার বার্ষিক প্রতিবেদনে অনুরূপ পর্যবেক্ষণ প্রদান করে।

৪.

রাজনৈতিক শত্রুতার কথা বলে নিজের দলের ক্যাডারকে ক্ষমা প্রদর্শন বাংলাদেশে বিএনপির আমলে শুরু হয়। বর্তমান আমলে তা প্রকট আকার ধারণ করেছে। সম্প্রতি সেনাপ্রধানের দুই ভাই হারিছ ও আনিসকে ক্ষমার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে পলাতক অপরাধীকে ক্ষমা করা হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে।

রাজনৈতিক শত্রুতাবশত মিথ্যা মামলা হলে বিচারিক ও আপিল আদালতে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ আছে। নিজ দল ক্ষমতায় এলে মামলা প্রত্যাহারের সুযোগ আছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদনকালে কোনো তথ্যপ্রমাণ হাজির না করে ঠুনকো আবেদনের ভিত্তিতে ক্ষমা পাওয়া কোনোভাবে ন্যায়বিচার হতে পারে না।

পলাতক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ক্ষমা প্রদর্শন আরও ভয়ংকর একটি ব্যত্যয়। উচ্চ আদালতের বহু রায়ে সুস্পষ্টভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে পলাতক ব্যক্তি কোনো ধরনের প্রতিকার পেতে পারে না। সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুসারে এসব রায় বাস্তবায়নে সরকার সুপ্রিম কোর্টকে সহায়তা করতে বাধ্য। এটি না করে বরং তাদের ক্ষমা করে দিলে তা হবে আইন ও সুপ্রিম কোর্টের প্রতি পুরোপুরি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন।

সারওয়ার কামাল মামলায় আদালত তাই বলেছেন, আদালতের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে পলাতককে ক্ষমা প্রদর্শন করলে এমন একদিন আসবে যে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা নিশ্চিতভাবে ভেঙে পড়বে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এর থেকে খুব একটা দূরে আছি?

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক