কয়লা দিয়ে দাঁত মেজেছেন

১. কয়লা দিয়ে কখনো দাঁত মেজেছেন?

২. লাইফবয় সাবান দিয়ে চুল ধুয়েছেন?

৩. মুখে তিব্বত স্নো, ট্যালকম পাউডার মেখেছেন?

৪. মাথার চুলে শর্ষের তেল দিয়েছেন?

৫. কলমের খাপ দিয়ে কান চুলকেছেন?

৬. টিউবওয়েলের তলায় বসে গোসল করেছেন (উঠতে গিয়ে মাথায় বাড়ি খেয়েছেন)?

৭. স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতা ল্যাম্পোর আলোয় গলিয়ে জোড়া দিয়েছেন?

৮. কলাপাতায় খেয়েছেন মাটিতে লাইন ধরে বসে?

৯. কালোবাজারির কাছ থেকে উচ্চ মূল্যে টিকিট কিনে সিনেমা দেখেছেন?

১০. মুচির কাছে ফুটবল নিয়ে গিয়ে ব্লাডারের লিক সেরেছেন?

১১. সুই গরম করে কান ফুটো করেছেন?

১২. টিউবওয়েলের মুখ হাতে চেপে ধরে নলে পানি জমলে মুখ লাগিয়ে পানি খেয়েছেন?

১৩. ইস্তিরি চুলায় রেখে গরম করেছেন বা ভেতরে কাঠকয়লা রেখে পাখা দিয়ে বাতাস করেছেন?

১৪. চুলার আগুনে বাঁশের চোঙ দিয়ে ফুঁ দিয়েছেন?

১৫. তালের আঁটি মাটিতে পুঁতে রেখে ভেতরের নরম শাঁস খেয়েছেন?

১৬. ল্যাম্পোর আগুন আর শর্ষের তেল দিয়ে নিজের কাজল নিজে বানিয়েছেন?

১৭. হাত-পা কেটে গেলে গাঁদা ফুলের পাতা কিংবা দূর্বা ঘাস পিষে লাগিয়েছেন?

১৮. রিকশার পাদানিতে বসেছেন?

১৯. সাইকেলের রডের ফাঁকে ডান পা ঢুকিয়ে বাঁ পা প্যাডেলের ওপর রেখে সিটের ওপরে ডান বগল রেখে বাঁ হাত হাতলে ধরে সাইকেল চালিয়েছেন।

ফেসবুকে আমার পেজে এই স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম দুই ভাগে। মোট ২৬ হাজার মন্তব্য পড়েছে। তাতে বুঝতে পারছি, আমাদের অনেকেরই শৈশব প্রায় একই রকম। আমরা যাত্রী একই তরণির।

আমি সেসব মন্তব্য থেকে একটা–দুটো এখানে তুলে ধরি।

ফায়েজুল ইসলাম লিখেছেন:

‘১১ নং বাদে সবগুলোই করেছি। এ ছাড়া লাল মাটির মার্বেল খেলা, বাতাবি লেবুর ফুটবল, কচুরিপানার ফুটবল, বাঁশের তৈরি রাইফেল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ খেলা, বাঁশের কাবারী দিয়ে তৈরি চাকা আর কঞ্চির ঠুকি দিয়ে তাকে চালিয়ে মাইলখানেক দৌড়ানো, এমনকি সেটি নিয়ে স্কুলে যাবার পথে কোনো জঙ্গলে লুকিয়ে রাখা আর সে খবর মাস্টার মশাইয়ের কানে যাওয়ায় আচ্ছা রকমের বেত্রাপ্যায়ন, স্কুলের ভাঙা জানালা দিয়ে পালিয়ে (’৭১ পরবর্তী) কারও গাছের কাঁচা আম পেড়ে খাওয়া এবং তৎপরবর্তী স্কুল ও বাড়ির উত্তম-মধ্যম, ইচ্ছে করে রাস্তার গভীর ধুলোর মধ্য দিয়ে হেঁটে হাঁটু পর্যন্ত ধুলো মাখানো ইত্যাদি আরও লম্বা স্মৃতির তালিকা...। শৈশবের স্মৃতিকে নাড়িয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।’

সত্যি, একটা কঞ্চি পেলেই সেটা হতো গাড়ি। মুখে গাড়ির স্টার্টের শব্দ করে দৌড় শুরু করে দিতাম। সুপুরির ডাল পড়লেই দৌড়ে সেটা কুড়িয়ে নিয়ে প্রথম কাজ হতো একজন তার চ্যাপ্টা অংশে বসে পড়া, আরেকজন পাতার অংশ ধরে টানা। এই ছিল আমাদের গাড়ি। আপনারা যাঁরা আমার লেখা নাল পিরান নাটক দেখেছেন, তাঁরা সেই দৃশ্যের নাট্যরূপ দেখে থাকবেন। আর দুটো পাটখড়ি (রংপুরে আমরা বলি সিন্টা) দিয়ে মাছের মতো একটা জিনিস বানাতাম, সেটাও গাড়ি হিসেবে বেশ চালানো যেত। নাল পিরান–এ সেই দৃশ্যও রেখেছি। বাতাবি লেবুর বাকল দিয়ে হেলমেট বানিয়েছি কত।

ফেসবুকের এসব মন্তব্য থেকেই আরও কত কত মজার মজার শৈশব স্মৃতি পাওয়া গেল। নরসুন্দরের হাঁটুতে মাথা রেখে পিঁড়িতে বসে চুল কাটা। ফুলের মধু চুষে খাওয়া। জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা। খালি পায়ে স্কুলে যাওয়া।

আমি জানি না, আজকালকার ছেলেমেয়েরা এসব কথার কোনো মানে আদৌ বুঝছে কি না। একটা ফোন করতে হলে পাড়ার একমাত্র ফোনওয়ালা বাড়িতে যেতে হতো। সেই ফোনে তালা দেওয়া থাকত। তারপরও এ কথা শোনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হতো যে ফোন নষ্ট। টেলিভিশন দেখার জন্য টেলিভিশনওয়ালার বাড়িতে রাতে ভিড় হতো। গ্রামে কোনো কোনো বাড়ির টেলিভিশন (সাদাকালো) উঠোনে এনে রাখা হতো। বিশেষ করে বাংলা সিনেমা বা বিশেষ কোনো খেলা থাকলে।

‘একটা রয়াল গুলি কিনতে পারিনি কখনো। লাঠি লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লশকরবাড়ির ছেলেরা।’ আমাদের প্রায় সবারই শৈশব ছিল এই রকমই। রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলাই ছিল বাহুল্যবর্জিত। আমাদেরটা কী রকম সাদামাটা ছিল, আজকালকার ছেলেমেয়েরা কল্পনাও করতে পারবে না। এক প্যান্ট এক শার্টে স্কুলজীবন কাটিয়ে দিয়েছি, এটা তো আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না।

কিন্তু আমাদের সবার জীবন এ রকমই ছিল। একটা তিন নম্বর ফুটবল জোগাড় করতে যে কত কষ্ট করতে হতো। সবাই চাঁদা দিতে পারত না। তারপর ব্লাডার লিক হলে যাও সাইকেল মেকানিকের দোকানে। চামড়া কেটে ভেতরের ব্লাডারে সলুশন লাগিয়ে সেটা মেরামতের চেষ্টা।

সেই বাংলাদেশ আজকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হচ্ছে। সবার হাতে মোবাইল ফোন। শুধু ফেসবুক ব্যবহারকারীই কয়েক কোটি। ভাবা যায়!

অভিনন্দন, বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে গৌরব করার মতো আসলেই আমাদের অনেক কিছু আছে।


আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক