কয়েকটি 'সম্ভ্রান্ত' দুঃখ

মাথার ওপরে চৈত্র মাসের দুপুরবেলার সূর্য। গনগনে তাপ ঘুলিয়ে উঠছে তীব্র দাহ নিয়ে। আলমগীর একটু পরপর খাঁচার ভেতর থেকে থুতু ফেলছে ডানে–বাঁয়ে। এই খাঁচাটা সিএনজি অটোরিকশার নিরাপত্তা খাঁচা।
আলমগীর সিএনজির চালক। আমি যাত্রী। আমার দুপাশেও খাঁচার লোহার জাল। রাজধানী শহর ঢাকায় মন্ত্রিপাড়া বলে পরিচিত মিন্টো রোডে অনড় এক জ্যামে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে থাকতে আলমগীরের নাম–ঠিকানা জেনে নিই শুরুতেই। বৈষয়িক জীবনযাপনের প্রসঙ্গে যেতেই আলমগীর ঝলসে ওঠে বিদ্রূপে। ‘শুনেন ভাই, উন্নয়ন কারে কয়, এইডা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাইতাছি। গেল দুই দিন দৌড়াইছি স্মার্ট কার্ডের পিছনে। সিএনজির জমা তুলবার পারি নাই। দুইডা বাচ্চা স্কুলে পড়তাছে। মাইয়াডা ক্লাস এইট আর পোলায় ক্লাস ফোর। আগের বছর ভর্তির সুময় নিছিলো চার হাজার আট শ। এইবার দশ হাজার পাঁচ শ। স্কুলে গিয়া কইলাম, আমরা গরিব মানুষ। কষ্ট কইরা পোলা–মাইয়াগো পড়াইতেছি। কয়ডা ট্যাকা কম নেন। কয় যে, সব ট্যাকা দিলে ভর্তি, না হইলে নাই। কেমতে ট্যাকা বাড়লো, কিল্লাইগা বাড়লো, কুনো জবাব নাই। বউ কইলো, যেমতে পারো ট্যাকা আনো। পোলা–মাইয়ারে শিক্ষিত করুম। আমগো জীবন যেন হ্যাগো না হয়।’
একটানা কথা বলে এইবার থামে আলমগীর। জ্যাম এখনো অনড়। উবু হয়ে নিচ থেকে জলের বোতল তোলে। জল খেয়ে বিড়বিড় করে বলে, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে একবার যাইতে পারতাম যদি, তাইলে তেনারে জিগাইতাম, গরিব গো উন্নয়ন কবে অইবো, কবে?’
আলমগীরকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পাই না আমি।
৩০ মার্চ গণমাধ্যমের বরাতে আমরা জানলাম, আসন্ন বাজেটে (২০১৭-১৮) সরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি বাড়ানো হবে পাঁচ গুণ। এই ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এক দিন আগে এনজিও কর্মীদের সঙ্গে প্রাক্–বাজেট আলোচনায় তিনি বলেছেন, ‘আজ আমি মিডিয়ার সামনে বলতে চাই, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (সরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ স্নাতক পর্যায়ে) ফি পাঁচ গুণ করা হবে, দেখি কী হয়’ (ইত্তেফাক, ৩০ মার্চ)। সিএনজিচালক আলমগীরের মতো মানুষেরা দৈনিক পত্রিকা পাঠ অথবা টেলিভিশনের সংবাদ শোনা ও দেখার সময় পায় কি না, জানি না। অর্থমন্ত্রীর এমন ‘দেখি কী হয়’ উচ্চারণে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আরও উৎসাহিত হবে বলেই অনুমিত হচ্ছে। আলমগীর তার সন্তানদের পড়াচ্ছে রাজধানী ঢাকার দনিয়া আদর্শ স্কুলে। সেটা আপাদমস্তক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এদের জবাবদিহি আরও কম।
বাংলামোটরের পূর্ব পাশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে একটি অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং শেষ করে বাসায় ফেরার জন্য রিকশা খুঁজছিলাম। রাত হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত একজন রিকশাচালক এগিয়ে এল। রাস্তার আলো–আঁধারিতে তার নবীন মুখ হাসছিল। যেকোনো দিকেই সে যেতে রাজি। ভাড়া দরদাম ছাড়াই রিকশায় উঠে মনে হলো, ভুল করলাম। কারণ, চালকের চালিয়ে নেওয়ার গতি–প্রকৃতি স্বাভাবিক লাগছিল না। গলিপথে অহেতুক স্পিডব্রেকারের সামনে আচমকা ঝাঁকুনি, মূল পথ থেকে প্রায় ছিটকে যেতে যেতে সামলে নেওয়া দেখে ভাবছিলাম, পান্থপথের গন্তব্যে নেমে তাকে বুঝিয়ে বলব, রিকশা চালানোটা ভালো করে শিখতে, কারণ এই শহরটা বড়ই নির্মম। দক্ষতা ছাড়া এখানে টেকা যায় না। বাটপারিতেও না। সুস্থভাবেও না।
রিকশা থামলে তার মুখোমুখি হতেই চমকে উঠি। তরুণ এই চালকটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত! এতক্ষণ চালিয়ে এসেছে বাঁ হাত আর বাঁ পা দিয়ে। ডান হাতটি গাছ থেকে ঝুলে পড়া মরা ডালের মতো শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। লুঙ্গির কারণে পা’টা প্রায় সবটুকুই আড়ালে। আমার বুকটা হু হু করে ওঠে। আমার বাবা ছয় বছর এমন অবস্থায় ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। ভাষাহীন আমি অনেক কথা নিয়ে তাকিয়ে থাকি।
তরুণটি বলে ওঠে, ‘অর্ধাঙ্গ রোগ ভাই।’ হ্যাঁ, গ্রামদেশে এমনই নাম অসুখটার। বলি, ‘কত দিনের অসুখ তোমার?’ হাসিমুখে বলে, ‘ছোটবেলা থাকি।’ কথায়, উচ্চারণে উত্তরবঙ্গের টান। কোথায় বাড়ি? ভাবতে থাকি; রংপুরে? গাইবান্ধা? জিজ্ঞেস করতেই উত্তর ‘গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ।’
আহা, আমার নাড়িপেঁাতা শহর গাইবান্ধা। ‘চিকিৎসা করো নাই?’ প্রশ্ন শুনে মলিন হাসে সে। ‘কবিরাজ দেখাছিলো বাপ–মা। বাপ মরি যাওয়ার পর আর কিছু হয় নাই। গরিব মানুষ না হামরা?’ আমি আর অসুস্থতা সম্পর্কিত কোনো কথা খুঁজে পাই না। ‘কী নাম তোমার?’ নাম বলে সে, ‘হোসেন মিয়া।’ ‘কোনো কাম তো মোক কেউ দেয় না। বাড়িত মা, বউ, ছোলপোল।’ আমি বিস্মিত হই। বিয়েও করেছে সে! বাচ্চাকাচ্চাও আছে? কী কাণ্ড! ‘কয় ছেলে–মেয়ে তোমার?’ রোষ মেশানো প্রশ্ন করি। নিজের এই অবস্থা, তার মধ্যে আবার সন্তান!
অমলিন হাসি উত্তর করে, ‘চাইরটা বেটা ভাই। বউ একটা বেটি চায় খালি। পরে মুই থামি গেছি। কপালত নাই তো কি করা।’ আমি ভাড়া মিটিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিই। হোসেন মিয়া হাসিমুখে আমার বাড়ির ঠিকানা খোঁজে। আমি তারই অঞ্চলের জেনে এবার সে প্রগল্ভ হয়ে ওঠে। ‘দুনিয়াত কেউ কারও দুঃখ বোঝে না ভাই। আপনার সাথত কথা কয়া খুশি হছি। ওই যে, গানত কয় না, “কারে জানাবো মনের দুঃখ গো”...দুঃখের কথা শোনার কাঁয়ও নাই। গান হলো জ্ঞান, বুঝছেন ভাই। এগ্লা গানত জ্ঞানের কথা আছে। আর কতকগুলো গান আছে না? জিগি জিগি শব্দ বেশি। বিল্ডিং কাঁপি উঠে। ওগ্লা কোনো গান হলো? কোনো জ্ঞান আছে ওগ্লাত?’ আমি হোসেন মিয়ার হাতে তার পাওনা টাকা গুঁজে দিয়ে সেদিন একরকম পালিয়ে এসেছিলাম। নিজের অজ্ঞানতা প্রকাশ পাওয়ার ভয়েই অনেকটা।
আমাদের চারপাশে আজকাল ‘সম্ভ্রান্ত’ শব্দটি খুব শুনি। জাতীয় নেতাদের জন্মদিনে, আলো ঝলমল বিশেষ অনুষ্ঠানের বিশিষ্ট অতিথিদের পরিচয় প্রদানে ‘সম্ভ্রান্ত’ শব্দটি উদ্বাহু নৃত্য করে। সীমান্তে কাঁটাতার দেওয়া আছে বন্ধুত্বের নামে, বন্ধুদেশের রাইফেলের ‘সম্ভ্রান্ত’ গুলি এসে লাগে স্বদেশের চাষির বুকে। এত পাহারা, তবু সীমান্তপ্রহরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে স্বদেশে ঢোকে ‘সম্ভ্রান্ত’ মাদক, আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা চাইতে আমাদের ‘সম্ভ্রান্ত’ লজ্জায় বাধে। কেবল, আলমগীর, হোসেন মিয়ার দুঃখগুলো এই দেশে এখন আর ‘সম্ভ্রান্ত দুঃখ’ হয় না।
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
[email protected]