বন বিভাগের ওয়েবসাইটে বন আইন ২০১৯ (খসড়া) নামে আইনের খসড়া দেওয়া হয়েছে। এ খসড়া করার সময় বন-সংশ্লিষ্ট মানুষ, বনের বাসিন্দা, পরিবেশকর্মী, গবেষক বা বন-সংশ্লিষ্ট অন্যদের সঙ্গে আলোচনা বা এ নিয়ে কোনো সভা হয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কয়েকটি ধারা সংযোজন ছাড়া খসড়া বন আইনটির সঙ্গে বন আইন ১৯২৭-এর কোনো তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়নি। যদিও কিছু ধারা বর্তমানে তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে।
বন আইন প্রণয়ন বা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রথমে যে বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন সেটি হলো, এই আইন পরিবর্তন বা সংশোধনের উদ্দেশ্য কী? এর উদ্দেশ্য কি দেশের অবশিষ্ট বন যা আছে তা সংরক্ষণ করা, নাকি বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়ানো, নাকি উভয়ই। সে ক্ষেত্রে আইনের ধারা এবং উপধারা স্পষ্টকরণ এবং বিশদ ব্যাখ্যার সঙ্গে আইনটি রাষ্ট্রের জন্য কী ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে, তা তুলে ধরা এর লক্ষ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। নতুবা এ ক্ষেত্রে নতুন বন আইন ১৯২৭ সালের বন আইনের অনুবাদ বা পুনর্মুদ্রণেরই নামান্তর হবে।
২.
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রণীত ১৯২৭ সালের বন আইনের উদ্দেশ্য ছিল বনের বাণিজ্যিক ব্যবহার এবং রাজস্ব আদায়। জাহাজ নির্মাণ, ভারী শিল্প এবং খামার ব্যবস্থাপনার জন্য নিজ দেশে বনের বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরুর মাধ্যমে বন উজাড়ের ক্ষেত্রে ১৮৬০ সাল নাগাদ ব্রিটিশরা বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থান দখলকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর ধারাবাহিকতায় তারা হাত বাড়ায় এ উপমহাদেশের ‘ভার্জিন’ সমৃদ্ধ বনের দিকে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বনজ সম্পদের বাণিজ্যিকীকরণ এবং রাজস্ব লাভ। বন, প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস বা প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার বিষয়গুলো তাদের বিবেচ্য ছিল না।
আইনের ৩০ ধারা অনুসরণে যে উদ্দেশ্যে সামাজিক বনায়ন বিধিমালা করা হয়েছিল, সেটির ফলাফল আশাব্যঞ্জক নয়। আশির দশকে সামাজিক বনায়নের ভুল ও অপরিকল্পিত বাস্তবায়ন বা প্রয়োগের কারণে দেশের ‘শালবন’ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। স্থানীয় দরিদ্র, ভূমিহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকজনের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এর বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও বাস্তবে অনেক স্থানে প্রভাবশালীদের চাপ বা অন্য কারণে দূরবর্তী শহরাঞ্চলের ব্যবসায়ী, সচ্ছল গৃহস্থ, জনপ্রতিনিধি, তাঁদের পরিবারের লোকজন এমনকি শিশুসন্তানদের অংশগ্রহণকারী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির কারণে প্রকল্পের কাজ প্রাথমিক দলিল করা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে অথবা মেয়াদ পূর্তির আগেই সেখানে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
শিল্পোন্নত দেশ জাপানের ভূখণ্ডের ৭০ ভাগ এবং আমাদের মতোই বিপুল জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়ার ৫০ ভাগ ভূখণ্ড বনে আচ্ছাদিত। সঠিক, বাস্তব ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও তার সঠিক প্রয়োগ হলে শিল্প বা জনসংখ্যা বন সংরক্ষণে বড় বাধা নয়।
আইনের ৪৪ ধারায় করাতকল বিষয়ে বলা থাকলেও বাস্তবে দেখা যায়, আইনের ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নিকট বা ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থাসম্পন্ন স্থানে করাতকল স্থাপন হয়েছে এবং জব্দ বা সিলগালাকৃত করাতকল পুনরায় পূর্ণোদ্যমে চালু করা হয়েছে। অথচ প্রাকৃতিক গাছকে ব্যবহার উপযোগী করার কোনো মাধ্যম না থাকলে সে গাছ ব্যক্তি বা সংঘবদ্ধ যে-ই হোক না কেন, চুরির কোনো কারণ বা সুযোগ থাকে না। করাতকল বনের জন্য একটা বড় সমস্যা অথচ বাস্তবমুখী বিধি প্রণয়ন ও কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে অবৈধ গাছ চেরাই বন্ধ করার মাধ্যমে সহজে গাছপালা চুরি রোধ করে বনের ক্ষতি রোধ করা যায়।
খসড়া আইনের ৭৮ ধারায় বন অফিসারের ক্ষমতার পরিধির বিষয়ে যেভাবে বলা আছে, সেটি ভবিষ্যতে আইনি চ্যালেঞ্জে পড়ার পাশাপাশি, সাংবিধানিক অধিকারগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হাওয়ার অবকাশ আছে। অন্যদিকে বন আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অসুস্থ, শয্যাশায়ী, পঙ্গু বা মৃত ব্যক্তির নামে বিভিন্ন সময়ে মামলার কারণে বন মামলাগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন সৃষ্টি করা হয়েছে। আইনের ভুল বা অপপ্রয়োগের পাশাপাশি নানা সীমাবদ্ধতা ও অন্যান্য উপাদানের কারণে সব বন অফিসারের পক্ষে সব সময় আইনের সঠিক প্রয়োগ সম্ভব হয় না।
শিল্পোন্নত দেশ জাপানের ভূখণ্ডের ৭০ ভাগ এবং আমাদের মতোই বিপুল জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়ার ৫০ ভাগ ভূখণ্ড বনে আচ্ছাদিত। সঠিক, বাস্তব ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও তার সঠিক প্রয়োগ হলে শিল্প বা জনসংখ্যা বন সংরক্ষণে বড় বাধা নয়। বাস্তবমুখী ও সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়ে বন বিভাগ ছাড়াও কীভাবে অন্যান্য বিভাগ বা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে বন সংরক্ষণ ও দেশের উপযোগী বনভূমি প্রসারণ করা যায়, সে-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন।
৩.
দেশ বিভাগের আগে আসাম ফরেস্ট অ্যাক্ট দ্বারা পরিচালিত সিলেট বন বিভাগের জন্য আলাদা বিধিবিধান ছিল। বন বিভাগের রেকর্ড অনুযায়ী দেখা যায়, ১৯০৬ সাল থেকে বনবাসী ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর প্রথাগত পিতৃপুরুষের বনভূমি ‘সংরক্ষিত বন’ হিসেবে ঘোষণা এবং দখলে নেওয়া বনভূমিতে ‘ভিলেজ ফরেস্ট’ বা গ্রামীণ বন স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট ১৮৭৮ এবং আসাম ফরেস্ট রেগুলেশন ১৮৯১-এর ধারা অনুযায়ী, প্রশাসিত সিলেট বন বিভাগ তথা আসাম প্রদেশ বন বিভাগের সংরক্ষিত বনের পরিমাণ ১৮৭৮ সালে ১ হাজার ৯৮৩ বর্গমাইল থেকে ১৯৩৮ সালে এসে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৫১৪ বর্গমাইলে। বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষিত বনের আয়তন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ‘ভিলেজ ফরেস্ট’-এর সংখ্যা বেড়ে যায়। ১৯১১ সালে কয়েকটি বনবাসী ক্ষুদ্র জাতি এলাকা ‘ভিলেজ ফরেস্ট’ হিসেবে ঘোষিত হলেও ১৯৩৭ সালে তা বেড়ে কয়েক গুণে এসে দাঁড়ায়।
বনবাসীদের বয়োজ্যেষ্ঠরা বলে থাকেন, সমতলভূমির বাসিন্দারা ভূমি জরিপ বা রেকর্ড প্রক্রিয়া শুরুর মাধ্যমে ভূমির মালিকানা বা দলিলাদি লাভ করা শুরু করে, আর বনবাসীদের ক্ষেত্রে ঘটে উল্টোটা। বন বিভাগ সৃষ্টি তথা বন আইন প্রণয়নের শুরুর মাধ্যমে বনবাসীরা তাদের ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত পুরুষানুক্রমে ভূমি হারাতে থাকে এবং তাদের নিজেদের ভূমিতে হয়ে পড়ে অবাঞ্ছিত।
খসড়া আইনের ৯৩ ধারায় বনের ওপর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও অধিকার রক্ষার বিষয়ে বলা হয়েছে। এ ধারাটির পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা প্রয়োজন বন সংরক্ষণে তথা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে। বস্তুত এটা স্পষ্টত দৃশ্যমান প্রকৃত সুস্থ ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর প্রাকৃতিক বন অতি যত্নে লালিত ও সংরক্ষিত অবস্থায় অবশিষ্ট রয়েছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী-অধ্যুষিত অঞ্চল বা এলাকায় এবং সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। প্রকৃতির পূজারি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বহু মানুষ এখনো বড় বড় বৃক্ষকে উপাসনা করা ছাড়াও সেটাকে তাদের দেব-দেবীর আবাসস্থল বলে মনে করে এবং গাছ কাটা তাদের কাছে ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ কাজ। বনই তাদের ধ্যান ও উপাসনাস্থল এবং তারা বনের মধ্যেই মানবকুলের পাশাপাশি বনের গাছপালা, পশুপাখি ও ধরিত্রীর কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করে।
এশিয়ার অনেক উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ অথবা পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ এখনো বনের জন্য যুগোপযোগী ও কল্যাণকর বন আইন বা নীতিমালা সংশোধনের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বনবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার প্রদান ও সংরক্ষণে ভারত ফরেস্ট অ্যাক্ট ২০০৬-এর মাধ্যমে বনভূমির ওপর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার নিশ্চিত করেছে। তাদের বন বিভাগ, বন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এবং নীতিনির্ধারকেরা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, বনভূমির ওপর বনবাসী জাতিসত্তাগুলোর অধিকার প্রদানের মাধ্যমে বনভূমি সংরক্ষণ নিশ্চিত করা সম্ভব। খসড়া আইনের ২৯ ধারা এবং ৯৬ ধারার আলোকে এবং অনুসরণে বনে বসবাসকারী সংখ্যালঘু জাতিগুলোর অধিকার ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য বিশদ ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিধি প্রণয়ন করা কঠিন কোনো বিষয় নয়।
আদিকাল থেকে তাদের প্রথা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রথাগত জ্ঞান ও জীবনযাপন প্রণালি দ্বারা বনের সবচেয়ে উত্তম রক্ষক হিসেবে যে ভূমিকা ও অবদান রেখে চলেছে, সেগুলোর আলোকে ও বিবেচনায় নিয়ে নীতিমালা করা হলে সেটা মানুষের জন্য, দেশের জন্য সার্বিক মঙ্গল বয়ে আনবে। দেশের প্রাকৃতিক বন ও বনভূমি রক্ষা ও সংরক্ষণের স্বার্থে দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই সেটি করতে হবে।
পিডিশন প্রধান বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরামের সভাপতি