খসড়া সম্প্রচার আইন ও কিছু সুপারিশ

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

জাতীয় সম্প্রচার আইনের (২০১৬) খসড়া প্রচার করা হয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয় খসড়া আইন সম্পর্কে আগ্রহী ব্যক্তিদের মতামত চেয়েছে। তার সূত্র ধরে এই লেখার অবতারণা। আমাদের বৈদ্যুতিন মাধ্যমের জন্য এ রকম একটি আইন প্রয়োজন ছিল। অনেকটা পরিকল্পনাহীনভাবে দেশে বৈদ্যুতিন মাধ্যম বিকশিত হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এই মাধ্যম এ দেশের গণমাধ্যমজগতে বিপ্লব সাধন করেছে। এত টিভি চ্যানেল, এত বিনিয়োগ, এত কর্মসংস্থান, এত শিল্পী, কলাকুশলী তৈরি, এত তথ্যপ্রবাহ বাংলাদেশের মতো দুর্বল গণতন্ত্রের দেশে এগুলো কম সাফল্য নয়। এর পুরো কৃতিত্ব বেসরকারি খাতের। সরকার শুধু তাদের লাইসেন্স দিয়েছে। সরকার নিজের হাতে দেশের একমাত্র টেরিস্ট্রিয়াল টিভি চ্যানেল রেখে দিয়ে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে একটা বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। সরকারের এই নীতির পরিবর্তন করতে হবে। নীতি হবে, যে বিনিয়োগ করতে পারবে ও লাইসেন্সের শর্ত পূরণ করতে পারবে, তাকেই টেরিস্ট্রিয়াল টিভির লাইসেন্স দেওয়া হবে। টেরিস্ট্রিয়াল টিভি দেশের সার্বভৌমত্ব বা নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। খসড়া আইনে এ প্রসঙ্গে কিছু নেই।
খসড়া আইনে ইতিবাচক বহু কিছু রয়েছে। তা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই। কী কী নেই ও কী কী পরিবর্তনযোগ্য তা এখানে আলোচনা করা যেতে পারে।
এই আইনের বড় দিক হলো, ‘জাতীয় সম্প্রচার কমিশন’ গঠন। এই কমিশন খুব শক্তিশালী হবে। অনেকটা সাংবিধানিক নানা সংস্থার মতো। কমিশনের গঠন প্রক্রিয়াও আইনে বলা হয়েছে। সাত সদস্যের মধ্যে শুধু একজন নারী কেন, দুই বা তিনজন নারী হতে দোষ কী! (অবশ্য উপযুক্ত হতে হবে) আইনে কমিশনকে প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা সেই ক্ষমতা ব্যবহার করতে আগ্রহী হবেন কি না। নাকি ক্ষমতা প্রয়োগের আগে ‘আমাদের লোক’ বা ‘তাহাদের লোক’-এর কথা ভাববেন? নির্বাচন কমিশনেও বহু বাছাই করে প্রধান ও অন্যদের নেওয়া হয়েছিল। আইনের দিক থেকে নির্বাচন কমিশনের চেয়ে স্বাধীন আর কোনো সংস্থা নেই। কিন্তু তাতে কী লাভ হয়েছে? দেশে কেমন নির্বাচন হচ্ছে মানুষ তা দেখছে। কাজেই এ ধরনের সম্প্রচার কমিশনের হাতে যে ক্ষমতাই থাকুক না কেন, সরকার কী চায়, সেটাই আসল কথা। সরকার কি তাদের সত্যিই স্বাধীনতা দিতে চায়? দেশের চলমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা কিন্তু আমাদের আশাবাদী করে না। তবু এখানে আশাবাদী হতে চাই।
এই আইনে ‘লাইসেন্সের শর্তাবলি’ অংশটি নিয়ে আলোচনা দরকার। লাইসেন্স প্রদানে কমিশনের একক কর্তৃত্ব থাকবে বলা হলেও এ ব্যাপারে আস্থা রাখা কষ্টকর। একজন অভিজ্ঞ আমলা আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বলেছেন, ‘আইনে বা সংবিধানে যত কথাই লেখা থাকুক না কেন বাস্তব অর্থে বাংলাদেশে একমাত্র সরকারই স্বাধীন। সরকার ছাড়া অন্য কারও প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা নেই।’ কথাটার মধ্যে অতিশয়োক্তি আছে বলে মনে হয় না। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড দেখেও এ কথার সত্যতা মেলে।
টিভি বা বেতার লাইসেন্স হস্তান্তরের বিধান আদৌ রাখা উচিত হবে কি না, তা কমিটিকে ভেবে দেখতে বলি। হস্তান্তর-প্রক্রিয়ার সঙ্গে দুর্নীতি ও রাজনীতি দুটোই জড়িত থাকে। গত পনেরো বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে কি তা ঠিক মনে হয় না? আমাদের প্রস্তাব হবে, লাইসেন্স পেয়েও যদি কেউ নির্দিষ্ট সময়ে টিভি চ্যানেল চালু করতে না পারেন, তাহলে তিনি আর্থিক দণ্ড দিয়ে লাইসেন্স সম্প্রচার কমিশনকে ফেরত দেবেন। (রাজউকের জমি পেয়ে যাঁরা বিক্রি করে দেন তাঁদের মতো আর্থিক দণ্ড) কমিশন উপযুক্ত ব্যক্তির হাতে সেই লাইসেন্স আবার দেবেন। এ রকম বিধান থাকলে টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স নিয়ে দুর্নীতি ও অপরাজনীতি বন্ধ হতে পারে। সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন একজন পেলে তিনি কি সেই ডিক্লারেশন অন্যজনের কাছে বিক্রি করতে পারেন? পারেন না। টিভির ক্ষেত্রেও এই নীতি প্রযোজ্য।
কারাদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিরা পাঁচ বছর পর্যন্ত লাইসেন্স পাবেন না। আজকাল নানা রাজনৈতিক কারণে কারাদণ্ডে অনেকে দণ্ডিত হচ্ছেন। সবাই জানেন, অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, রিমান্ড, বিচার, কারাদণ্ড সবই রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় হয়ে থাকে (সবার বিরুদ্ধে নয়)। সরকার বদল হলে ‘আসামিও’ বদল হয়ে যায়। ‘আদালত কর্তৃক দণ্ডিত’ শর্তটি (খুনের মামলা ছাড়া) বাংলাদেশে কোনো গুরুত্ব বহন করে কি? এই শর্তটি নিয়ে ভাবা দরকার। ঋণখেলাপি বা শেয়ারবাজার লুট করাও আজকাল নানা ব্যাখ্যা ও আইনের মারপ্যাঁচে জায়েজ হয়ে যায়। ব্যাংকের টাকা ঋণের নামে লুট করে অনেকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে সাধুবাবা হয়ে গেছেন। কাজেই এসব শর্ত রাজনৈতিক বিরোধীদের ঠেকানোর অস্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়।
কমিশন যদি রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়া উপযুক্ত ব্যক্তিকে লাইসেন্স দেয়, তাহলে বুঝতে হবে কমিশন প্রকৃতই স্বাধীন। লাইসেন্স বাতিল করারও অগাধ ক্ষমতা কমিশনের রয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাঁদের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করা যাবে না। কেন? এই বিধান পরিবর্তন করা উচিত। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের জবাবদিহির ঊর্ধ্বে রাখার এই প্রবণতা অগ্রহণযোগ্য। এর ফলে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা স্বৈরাচারী ও একনায়ক হয়ে উঠেছেন বা উঠতে পারেন। ক্ষমতাধর ব্যক্তি যেমন ক্ষমতা দেখাতে পারেন, তেমনি তাঁকে আইনের কাছেও নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, সব প্রতিষ্ঠানের আইনে তেমন বিধান থাকা জরুরি। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
কমিশন সম্প্রচারকারীদের জন্য ‘গাইডলাইন’ বা ‘কোড অব এথিকস’-এর যে কথা বলা হয়েছে তা রচনা করবেন কে? কমিশন অংশীজনদের সঙ্গে মিলে যৌথভাবে তা রচনা করলে ভালো হয়। কারণ, এই গাইডলাইন খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরে এই গাইডলাইন নিয়ে নানা ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা হতে পারে। সেই অপব্যাখ্যার ভিত্তিতে কমিশন নানা শাস্তিমূলক সিদ্ধান্তও নিতে পারে। কাজেই এই গাইডলাইন যতটা সম্ভব স্পষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়।
কমিশন সম্প্রচারকারীকে (চ্যানেল মালিক) দর্শক-শ্রোতার (ভোক্তার) অভিযোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু আমাদের সম্প্রচারকারীরা এতই অপেশাদার (ব্যতিক্রম ছাড়া) যে, তাঁরা তাঁদের অনুষ্ঠান সম্পর্কে দর্শক-শ্রোতার মতামত (ফিডব্যাক) জানতেও আগ্রহী নন। সে রকম কোনো ব্যবস্থা তাঁদের নেই। স্পনসর বা বিজ্ঞাপনদাতা খুশি কি না, সেটা জানতেই তাঁদের আগ্রহ। কাজেই ভোক্তার নালিশ জানার আগ্রহ তাঁদের থাকার কথা নয়; বরং কমিশনে একটা ‘অভিযোগ বিভাগ’ করা যেতে পারে। দেশের আট বিভাগে জেলা প্রশাসকের দপ্তরেও একটা ‘অভিযোগ কেন্দ্র’ করা যেতে পারে। সেখানে দর্শকেরা শুধু লিখিত অভিযোগ জমা দেবেন। কমিশন প্রতি মাসে সেগুলো পর্যালোচনা করে বিহিত করবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে কমিশন শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিতে পারে।
কমিশন প্রদত্ত আদেশ-নির্দেশ লঙ্ঘন করলে তাঁকে অনধিক তিন মাসের কারাদণ্ড, অথবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। এই কমিশন কি বিচারিক আদালতের ক্ষমতা রাখে? আদালতের বাইরে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান কি জেল-জরিমানা দিতে পারবে? এ ব্যাপারে সংবিধানের কিছু নির্দেশনা নিশ্চয় রয়েছে। একই তথ্য মন্ত্রণালয় ৪০ বছর ধরে ‘প্রেস কাউন্সিলকে কোনো দণ্ড দেওয়ার অধিকার দেয়নি, কারণ প্রেস কাউন্সিলের বিচারিক ক্ষমতা নেই বলে। অত্রএব, জেল-জরিমানার বদলে অন্য কোনো কঠিন শাস্তির কথা বিবেচনা করা উচিত।
সম্প্রচারকারী যদি সরকারের নীতি বা নির্দেশে ক্ষতিগ্রস্ত হন, তা কি এই কমিশন দেখবে? খসড়া আইনে এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। সরকারের নির্দেশ, সরকারের অর্থনৈতিক নিয়মনীতি, আয়কর, ভ্যাট ইত্যাদি দ্বারা চ্যানেল মালিক ক্ষতিগ্রস্ত ভাবলে তাঁরা যেন কমিশনের কাছে আবেদন করতে পারেন।
সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের বেতনকাঠামো, কর্মীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, চাকরির শর্তাবলি, চাকরি সুরক্ষার শর্তাবলি, পেনশন, গ্র্যাচুইটি, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ব্যাপারে সম্প্রচার আইনে ন্যূনতম কাঠামোর প্রস্তাব থাকা উচিত। সম্প্রচার কর্তৃপক্ষ তার কমে কোনো কিছু দিতে পারবে না। বেশি দেওয়ার স্বাধীনতা তার থাকবে।
‘সম্প্রচার আইন ২০১৬’-এর খসড়া নিয়ে এই আলোচনা সংক্ষিপ্ত ও অসম্পূর্ণ। আমরা মনে করি, এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও বিতর্ক হওয়া দরকার। কারণ, সম্প্রচারমাধ্যমের জন্য এটা একটা আইন হতে যাচ্ছে। আমাদের প্রস্তাব, টিভি চ্যানেলের মালিক সমিতি, বিভিন্ন সাংবাদিক ইউনিয়ন, টিভি-বেতারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পেশাজীবীদের ফোরাম, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ, বিভিন্ন প্রেসক্লাবের আলাদাভাবে এই খসড়া আইন নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক করা উচিত। আলোচনা শেষে তাদের লিখিত পর্যালোচনা ও সুপারিশ তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো উচিত। আলোচনার সারকথা সংবাদপত্রে ও টিভিতে প্রচার করলে ভালো হয়। প্রতিটি টিভি চ্যানেল এ বিষয়ে একাধিক টক শোর আয়োজন করতে পারে। তথ্য মন্ত্রণালয় মতামত দেওয়ার সময়সীমা ৩০ মে পর্যন্ত বাড়ালে ভালো হবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।