খাদ্যশস্য আমদানি ও রপ্তানি-রহস্য

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

যেসব বালকের এখনো গোঁফ গজায়নি বা যেসব বালিকা এখনো ওড়না ধরেনি, তারাও এখন খবরের কাগজ পড়ে, টিভির সংবাদ তো দেখেই। তাদের আক্কেল-বুদ্ধি ও বিচার-বিবেচনা বঙ্গীয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের চেয়ে কিছুমাত্র কম, তা শুধু বেকুব ছাড়া আর কারও মনে করার কারণ নেই। তাদের যদি বলা হয়, লোকটি নুলো ডুবিয়ে ভরপেট খাওয়ার পর ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করছে, তা মানসিক প্রতিবন্ধী ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করবে না। প্রতিদিন এসব বালক-বালিকা স্বচক্ষে কাগজে পড়ছে এবং নিজের কানে শুনছে, বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ শুধু নয়, তার গোলায় খাদ্যশস্য উপচে পড়ছে বলে তা থেকে বস্তা বস্তা বিদেশে রপ্তানি করছে। এবং একই দিনে ওই সব কিশোর-কিশোরী এমন প্রতিবেদনেও চোখ বুলাচ্ছে যে বাংলাদেশের বন্দরে লাখ লাখ টন গম ও প্রচুর পোকা নিয়ে বিদেশি জাহাজ নোঙর ফেলেছে। গম খালাসের আগেই আন্তর্জাতিক মানের কিছু পোকা পানিতে সাঁতার কেটে বাংলার উপকূলীয় ভূখণ্ডে ঢুকে গেছে। বাংলার মাটিতে এখন বিদেশি এটিএম জালিয়াতকারী, বিদেশি হ্যাকার, বিদেশি চোরাকারবারি এবং বিদেশি পোকার অবাধ বিচরণ। বাঙালি অতিথিপরায়ণ জাতি বলে সুখ্যাতি আছে। সে অতিথি হোক কোনো মানবসন্তান অথবা কোনো গম বা চালের পোকা।
যদি বলা হয়, বাংলাদেশ ধান ও চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ, সে কথা শতভাগ সত্য। যদি বলা হয়, বাংলাদেশ খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, সেটা ডাহা মিথ্যা। খাদ্যশস্য বলতে শুধু চাল বোঝায় না। আটা বা গম বাংলাদেশের দুটি প্রধান খাদ্যশস্যের একটি। মানুষ জানতে চাইবে, বাংলাদেশ গমে স্বয়ংসম্পূর্ণ কি না? উত্তর যদি হ্যাঁ-বাচক হয়, তাহলে প্রশ্ন হবে, গম (পোকাসমেত হোক বা পচা হোক বা ভুসিসমেত নিম্নমানের হোক) আমদানির প্রয়োজন হয় কেন? আরও প্রশ্ন করা যেতে পারে, বাংলাদেশ ডালে এবং ভোজ্যতেলে স্বয়ংসম্পূর্ণ কি না? উত্তর যদি না-বাচক হয় তাহলে সম্পূরক প্রশ্ন হবে, তিল-সরষে ও ডাল-জাতীয় শস্য খাদ্যশস্য কি না? বাংলাদেশ খেসারি ডালে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও হতে পারে। কারণ, ওই ডাল এখন আর মানুষ খেতে চায় না। মসুর, ছোলা, মুগ, মটর এবং মাষকলাই ডালে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ কি না? যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে ওই ডাল বিদেশ থেকে আমদানির প্রয়োজন হয় কেন? আমাদের প্রয়োজনের শতকরা কত ভাগ ডাল-জাতীয় শস্য আমদানি করতে হয়? ছোলা ছাড়া ইফতারি হয় না। ছোলা খাদ্যশস্য। ছোলা কেন আমদানি করতে হয়? বাংলাদেশে এখন ঘোড়া প্রায় বিলুপ্তির পথে। স্থলে যাতায়াতের জন্য মোটরগাড়িতে ভরে গেছে দেশ। ঘোড়াও নেই, ঘোড়ার গাড়িও নেই, ছোলারও বিশেষ প্রয়োজন নেই। তাহলে আমদানি কেন?
ঘরে ঘরে আজকাল সয়াবিন তেল। প্রয়োজনের সবটা সয়াবিন তেল বাংলাদেশেই উৎপন্ন কি না? চিরকাল বাঙালি সরষের তেল খেয়েছে। সরষের তেলে আমরা কেন স্বয়ংসম্পূর্ণ নই? তিলের তেলও গরিব মানুষ একসময় খেত। ছোটবেলায় বাড়িতে দেখেছি কৃষ্ণ তিল ও সাদা তিল। সব খেতে যদি সারা বছর নানা জাতের ধানই চাষ হবে, অন্য খাদ্যশস্য ফলানো হবে কোথায়? আগে প্রচুর কুসুম ফুলের চাষ হতো। খুবই ভালো তৈলবীজ। এখন কুসুম চাষ হয় কী পরিমাণ জমিতে? সূর্যমুখী বীজ ভোজ্যতেলের ভালো উৎস। সেটাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে অসুবিধা কোথায়? তিসি ও রেড়ির তেলের নাম এখন খুব কম মানুষই জানে। এসবই তো ছিল বাঙালির খাদ্য।
স্বাধীনতার আগে ষাটের দশকে চিনিতে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম। সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে কিছু চিনি ভারতেও চোরাচালান হতো। আজ বৈধভাবে ব্রাজিল প্রভৃতি দেশ থেকে এবং অবৈধভাবে ভারত থেকে চিনি আসে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ একটি আখ উৎপাদনকারী দেশ। আমাদের চিনিতে মিষ্টতা বেশি। এখনো বহু চিনিকলের গুদামে পড়ে আছে চিনি। চোরাইপথে আমদানি হচ্ছে দেদার। জনগণ কাকে দোষ দেবে, নিজেদের কপালে চপেটাঘাত করা ছাড়া!
কৃষিজাত পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রশ্ন যদি আসে তাহলে বলা যায়, তামাকেই বরং স্বয়ংসম্পূর্ণ। ভার্জিনিয়া, মতিহারী প্রভৃতি জাতের তামাকের উৎপাদন আমাদের ভালোই। সব নেশাজাতীয় দ্রব্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। গাঁজা, আফিম প্রভৃতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠিনি এ জন্য যে ওগুলোর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। আমদানিকারকদের সংখ্যাও বাড়ছে। তবে গাঁজার ব্যবহার আরও বেশি বাড়লে গাঁজাখুরি কথাও বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে।
কোনো দেশ খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ না হলেই সরকারকে দোষ দেওয়া যায় না। সিঙ্গাপুর চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সে জন্য সিঙ্গাপুরের সরকারকে আসামি করা যাবে না। মিয়ানমার উদ্বৃত্ত চালের দেশ। সে জন্য সে দেশের সরকারের কোনো বাহাদুরি নেই। বাহাদুরি দিতে হলে সে দেশের ভূমি ও কৃষকদের দিতে হয়। অন্য সব খাদ্যশস্য উৎপাদন বাদ দিয়ে সারা বছর সব জমিতে শুধু ধান চাষ করলে দুনিয়ার যেকোনো দেশ ধানে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ হবে।
কোনো দেশ কোনো পণ্যের রপ্তানিকারক হলেই গৌরবের কিছু নেই। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কোনো কোনো দরিদ্র দেশ হীরা ও স্বর্ণ রপ্তানি করে। তাতে তাদের বগল বাজানোর কিছু নেই, কোনো দেশ কোনো পণ্যে আমদানিনির্ভর হলেই অগৌরবের কিছু নেই। সবই নির্ভর করে অবস্থা ও পরিস্থিতির ওপর।
আমাদের শুধু খাদ্যশস্য ধান নয়, অর্থকরী ফসল পাটও বেশি ফলানো প্রয়োজন। পাট পাট করে আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধিকার আন্দোলন করেছি। সেই পাটের এবং পাটকলের এত দুর্দশা কেন? চাল রপ্তানির চেয়ে পাট রপ্তানি বেশি উপকারী। বেশি বেশি পাটকল স্থাপন প্রয়োজন। পাটের ওপর নির্ভর করছে কোটি কোটি পাটচাষি, পাট ব্যবসায়ী, পাটকল মালিক-শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা। সুতরাং অর্থনীতির স্বার্থে, পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনে পাটকে অবহেলা করা যাবে না।
শুধু চাল চিবিয়ে বা সেদ্ধ করে খেয়ে মানুষ বাঁচে না। মানুষকে আরও অনেক কিছু খেয়ে বাঁচতে হয়। রুটি বানানোর জন্য গম চাই, ছাতু খাওয়ার যব চাই, শুধু ডাল-ভাত খেতে গেলেও ডাল চাই, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ চাই। কোরবানির ঈদের আগেই যে শুধু মানুষ থলে নিয়ে হরিণের মতো বাজারে পেঁয়াজ, রসুন, আদার জন্য ছোটাছুটি করে তা-ই নয়, সারা বছরই এখন আমদানি করা পেঁয়াজ খায় চড়া দামে। দেশ খাদ্যে স্বাবলম্বী বলে প্রতিদিন যাঁরা আত্মপ্রসাদ লাভ করছেন, ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা’ বলতে তাঁরা কী বোঝেন, আমাদের বোধগম্য নয়।
শুনেছি পৃথিবীর বিভিন্ন খাদ্যশস্য রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশকে খুবই পছন্দ করে। আমাদের খাদ্য মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রভুদের সঙ্গে তাদের খুবই বন্ধুতা। গত বছর ফ্রান্স থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টন গম এল। মিডিয়ার কারণে ধরা পড়ল তা খাওয়ার অনুপযোগী। বাধ্য হয়ে ফেরত পাঠানো হলো গমবোঝাই জাহাজ। এখন দুবাইয়ের ফিনিক্স কমোডিটিজ কোম্পানি ৫০ হাজার টন গম পাঠিয়েছে। তাতে ব্রাজিলের গমের মতো পোকা কিলবিল না করলেও ভুসি, ধুলা, বালু, আবর্জনা প্রচুর। এর আগে ব্রাজিল থেকে আমদানি করা ২ লাখ ৫ হাজার ১২৮ টন গমের আটা খেয়ে পুলিশ বিভাগের অনেক সদস্য বমি করে দেন। খাওয়ার অযোগ্য খাদ্যশস্য শুধু বাংলাদেশেই আসবে কেন? মনে হয় বিদেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্তারা জানেন, পচা মালে বাঙালির আপত্তি নেই। পচা খাদ্যশস্য ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের বন্দর থেকে ফেরত যায় না কেন? নিম্নমানের চালও আমদানি করা হচ্ছে দেদার।
পত্রিকায় কী লেখা হলো তার দাম নেই। কিন্তু গত হপ্তায় অনুষ্ঠিত কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চাল আমদানি নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকার পরও কেন দেশের বাইরে থেকে চাল আমদানি করা হলো, এর কারণ জানতে চেয়েছে কমিটি। সভায় ‘আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কী কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চাল আমদানি করছে, সে বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়কে খতিয়ে দেখতে বলেছে কমিটি। পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করতে কৃষিমন্ত্রীকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’
বাংলাদেশ উর্বর পলিমাটির কৃষিপ্রধান দেশ। আমাদের কৃষিজাত পণ্য আমরাই উৎপন্ন করব, সেটাই প্রত্যাশিত ও স্বাভাবিক। সব শস্য হয়তো পারব না, কিন্তু প্রধান খাদ্যশস্য ফলানো উচিত। এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, গোলমরিচ, জিরা, ধনে, কালিজিরা, তেজপাতা, আলুবোখারা প্রভৃতি যদি কিছু বিদেশ থেকে আসে, ক্ষতি নেই। দানাজাতীয় খাদ্যশস্যের আমদানি-রপ্তানির প্রশ্নে কোনো রকম গোঁজামিল একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
ষাটের দশকে আইয়ুব খান সবুজ বিপ্লবের স্লোগান দিয়েছিলেন। শুধু ওই স্লোগানে আমাদের মন ভরেনি। আমাদের দাবি ছিল ভূমি সংস্কার ও কৃষি সংস্কার। স্বাধীনতার পরেও সেটা হয়নি। মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলের সরকারের পক্ষে ভূমি সংস্কার করা সম্ভব নয়। ভূমি সংস্কারে উপকৃত হয় কৃষক এবং ক্ষতি হয় জোতদার জমিদারদের। প্রবল পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ভূমি সংস্কার এখন আর করা সম্ভব নয়। সে জন্য সুষম খাদ্যশস্য উৎপাদনও সম্ভব হচ্ছে না। প্রয়োজন মেটাতে কতটা জমিতে ধান উৎপাদন হবে, কতটায় গম ও যব, কতটায় পেঁয়াজ-রসুন, কতটায় মুগ-মসুর-খেসারি-মাষকলাই— তা হিসাবমতো না করতে পারলে আমদানির ওপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
যদিও দেশে এখন খাদ্যাভাব নেই, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ সুষম খাদ্য থেকে বঞ্চিত। প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্যের খুবই অভাব। দুধের স্বাদ পনেরো আনা মানুষ ভুলে গেছে। মাখন, পনির শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষের কাছে স্বপ্ন। গরু-ছাগলের মাংস, মুরগির মাংস খুব কম মানুষই জোগাড় করতে পারে। মুরগির ডিমটা বেশি দামে হলেও পাওয়া যাচ্ছে। চাষের মাছটা আছে বলে মানুষ খেতে পারছে। দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার। স্বাস্থ্যহীন মানুষ মেধাবী হয় না। তারা জাতিকে কিছু দিতে পারে না।
প্রচলিত কৃষিনীতি ও কৃষিব্যবস্থা আমাদের খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। সুতরাং দেরি না করে কৃষিনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে কৃষকের স্বার্থে, ভোক্তাদের স্বার্থে, জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।