খালখেকোর সাজা যখন সিগারেটখেকোর সমান

এভাবেই নদীর পার দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্থাপনা

এবারের ঝড় কি একজন আসলামুল হকে থেমে যাবে? আসলামুলের নদী দখলের বিষয়টি যেভাবে প্রায় এক ডজন সংস্থার তদন্তে প্রমাণিত হলো, সেটা একটা রোল মডেল। এই মডেল রাষ্ট্র গ্রহণ করতে পারে। গ্রহণ করার মানে হলো নদী কমিশনকে উৎসাহিত করা। মনে রাখতে হবে, আবার যাতে এ রকম তদন্ত না হতে পারে, সে জন্য নদী কমিশনকে হতোদ্যম করার লোকের অভাব হবে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে নদী কমিশন গঠন অবশ্যই একটি মাইলফলক অগ্রগতি। একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এর সঙ্গে আরও কতগুলো কাজ আছে, সেসব সম্পন্ন না করা হলে রাজনৈতিক অঙ্গীকার অর্থপূর্ণ হবে না। এর মধ্যে প্রধান হলো নদ–নদীসংক্রান্ত প্রচলিত আইনগুলো কার্যকর করা। নদী কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তাকে পুলিশি দায়িত্ব পালন করতে হবে।

১ ডিসেম্বর নদী কমিশনের ওয়েবসাইটে তাদের প্রস্তাবিত আইনটি জনমতের জন্য আবার আপলোড করেছে। এ আইন খুবই দরকারি। আইন কমিশনের কাছ থেকেও তারা মতামত নিয়েছে। ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা মতামত নেবে। এই লেখায় আমরা এ বিষয়ে কিছু মতামত দিতে চাই। তবে কথা হলো, তার আগে আমরা দেখে নেব প্রচলিত আইনগুলো কী বলে। ১৯৫২ সালের এমব্যাংকমেন্ট অ্যান্ড ড্রেনেজ অ্যাক্ট, ১৯২০ সালের দ্য এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড স্যানিটারি ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৩৯ সালের দ্য ট্যাঙ্কস ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৬৪ সালের ক্যানাল অ্যাক্টগুলো কী অবস্থায় আছে? এগুলো কারা কার্যকর করবে? নদী কমিশনের কাছে আমরা খুব বেশি আশা করলে কি চলবে?

নদীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। ৫৩টি নদীতে উজানের পানি আসা কমে গেছে, ভবিষ্যতে আরও কম আসবে। তাই অভ্যন্তরীণভাবে নদী রক্ষা ও শাসনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নদী হত্যার জন্য উজানের পানিপ্রবাহ কম আসাই তো একমাত্র মারাত্মক বাধা নয়। উজানের দেশগুলোকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমরা অভ্যন্তরীণভাবে যা যা করতে পারার তা কি করছি?

আবার এ ধরনের আইনগুলো যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো হালনাগাদ বা বাস্তবায়ন শুরু করে তাহলে নদী কমিশন নামের একটি শক্তিশালী সংস্থার প্রতি জনগণের মধ্যে একটি বিশেষ সচেতনতা তৈরি হবে। আমরা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা না হলে নদী কমিশনকে একটি গতিশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যাবে না। নদী কমিশনের আইনের খসড়ায় ‘একটি কার্যকর, স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ কমিশন হইবে’ মর্মে উল্লেখ করেছে। এ রকম প্রতিষ্ঠান আমরা আইন দিয়ে করেছি। কিন্তু শুধু সেই কারণে তা শক্তিশালী হয়নি। এক-এগারোতে দুদককে প্রজ্ঞাপন দিয়ে ‘স্বশাসিত’ করেছিলাম। কিন্তু হাওয়া বদলের সঙ্গে সেই স্বশাসনের চেহারা বদলেছে। আমরা মানবাধিকার কমিশন করেছি। এখন তা শ্বেতহস্তী।

সাংসদ আসলামুল হক অবশ্যই নদী কমিশনের দুর্বলতায় আঘাত হানতে ভুল করেননি। তাই তিনি ফৌজদারি অপরাধ করেছেন কি না, তার থেকেও বড় প্রশ্ন তঁার মাথায়, নদী কমিশনের এখতিয়ার আছে কি না। কমিশন সুপারিশ করতে পারে। কিন্তু সেটা মানতে সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বাধ্য নয়। অবশ্যই এ অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। কিন্তু নদীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। ৫৩টি নদীতে উজানের পানি আসা কমে গেছে, ভবিষ্যতে আরও কম আসবে। তাই অভ্যন্তরীণভাবে নদী রক্ষা ও শাসনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নদী হত্যার জন্য উজানের পানিপ্রবাহ কম আসাই তো একমাত্র মারাত্মক বাধা নয়। উজানের দেশগুলোকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমরা অভ্যন্তরীণভাবে যা যা করতে পারার তা কি করছি?

আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা দরকার। নদ–নদী, জলাশয়, খাল-বিল রক্ষায় একটা সামাজিক আন্দোলন দরকার। করোনায় মাস্ক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবহার অল্প দিনে আমরা ভালোই বুঝেছি। স্বাস্থ্যবিধি কি তা শিশুরাও শিখেছে। কারণ, রাষ্ট্র তার প্রচারণা শক্তিকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে। নদী ও জলাশয় রক্ষায় সেই সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করতে হবে।

মাত্র গত কয়েক বছর হলো আমরা নদীর দিকে মনোযোগী হয়েছি। আগেই যেমন বলেছি, গঙ্গা ও তিস্তার মতো নদী নিয়ে রাজনীতি ও কূটনীতি দুটোতেই ঐতিহাসিকভাবে আমরা নিজেদের সরগরম রেখেছি। কিন্তু তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে আমরা অভ্যন্তরীণভাবে যারা নদ-নদীর ক্ষতি করেছে, শুকিয়ে ফেলেছে বা মেরে ফেলেছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা সেভাবে সোচ্চার হতে পারিনি। নদী চোরকে আমরা কম ঘৃণা করি। টাকা চোরকে আমরা বেশি ঘৃণা করি। টাকা চোর ধরা পড়ুক এ ব্যাপারে আমরা যতটা সোচ্চার থাকি, নদী চোর ধরা পড়ল কি না, তাতে উদ্বেগ নেই।

কারা ডাকাত, কারা সন্ত্রাসী তা বুঝতে এবং বোঝাতে আমাদের বেগ পেতে হয় না। এমনকি ভূমিদস্যু কী এবং তারা যে অপরাধী, সেটাও সমাজে কিছুটা স্বীকৃত। অবশ্য এখানেও শ্রেণিভেদে সংবেদনশীলতার বিষয় আছে। যেমন গুলশানের একখণ্ড জমি কেউ জাল দলিল করে নিলে এবং সেটা ধরা পড়লে যেভাবে গেল গেল শোর উঠবে, সেটা চরের জমির ক্ষেত্রে ঘটবে না। কারণ, চরে গরিব মানুষ থাকে।

এখন প্রশ্ন হলো, নদী কমিশন আইন পাস হলেই নদী বাঁচবে? ভূমিখেকো, বনখেকোর পর নদীখেকোদের দল ভারী। একজন সাংসদ আসলামুল হক কোনো বিচ্ছিন্ন চরিত্রের নাম নয়। বাংলাদেশের বহু স্থানে নদীখেকোদের তালিকা তৈরি হয়ে আছে। এঁদের বলা হয় অবৈধ দখলদার। সেই চিহ্নিতরাও সারা দেশে সমানভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন না। প্রভাব খাটিয়ে নানা তালে নিজেদের রক্ষা করছেন। ডিসিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হোক। নদী পুনরুদ্ধারের বাজেটে কেন কম টাকা রাখা হয়, তার কৈফিয়ত নেওয়া হোক।

যঁারা সাময়িকভাবে দখল করে অস্থায়ীভাবে কোনো কাঠামো করেছেন এবং সময় সুযোগ পেলে ধীরে ধীরে কাগজপত্র বানাবেন, তঁারা অপেক্ষাকৃত লঘু অপরাধী। তাঁরা অবৈধ দখলদার। কিন্তু তাঁরাই সংগঠিত ও শক্তিশালী যঁাদের হাতে ‘বৈধ’ কাগজপত্র আছে। অনেকে আছেন যাঁরা জানতেন না, তঁারা বৈধভাবেই বহু দশক আগে ভরাট হওয়া সরকারি জলাশয়, নর্দমার ওপরে গড়ে ওঠা সম্পত্তি কিনেছেন। তঁাদের সম্পত্তিও রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করতে পারে। কারণ, ওই সম্পত্তি তঁারা কত আগে কিনেছেন, এমনকি সিএস আরএস বা তারও আগের যদি পুরোনো রেকর্ড থাকে, তাহলেই তা বৈধ হবে না। রাষ্ট্র মুহূর্তেই তা নিতে পারবে। এগুলো উদ্ধারে একটা ট্রুথ কমিশন ধরনের কিছু করা যায় কি না, তা ভাবতে হবে। এ জন্য একটা নীতিমালা দরকার।

কমিশনকে অর্থ পেতে হবে সুপ্রিম কোর্টের মতো করে। সংসদ তাকে সরাসরি টাকা দেবে। সরকার থেকে সে নেবে না। মোবাইল কোর্টের প্রতি তার অসাংবিধানিক অনুরাগ প্রকাশ পেয়েছে। আইনে তেমন বিধান রাখা হয়েছে। এটা বাদ দেওয়া জরুরি।

শেষ করি নদী কমিশন আইনটি নিয়ে। আমরা অবশ্যই এ রকম আইনের পক্ষে। তবে কমিশন চেয়ারম্যানসহ তঁাদের পাঁচ সদস্যের নিয়োগে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতির নেতৃত্বে বাছাই কমিটির প্রস্তাব করেছে। কিন্তু অপসারণে তারা অভিশংসন বা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অর্থাৎ বিচারক অপসারণের পদ্ধতিকে নেয়নি। তারা বলেছে, রাষ্ট্রপতি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে অপসারণ করবেন। সোজা কথায়, তারা প্রধানমন্ত্রীর চূড়ান্ত ইচ্ছায় অপসারণের বিধান করেছে। এর সঙ্গে আমরা দ্বিমত করি। আবার আর্থিক স্বাধীনতায় তারা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এককালীন বরাদ্দ চেয়েছে। এটাও যথাযথ নয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে এখন তারা অনধিক চার কোটি টাকা খরচ করতে পারে। প্রস্তাবিত বিধান বর্তমান অবস্থার চেয়ে ভালো। কিন্তু এটা তাকে স্বায়ত্তশাসনের স্বাদ দেবে না। কমিশনকে অর্থ পেতে হবে সুপ্রিম কোর্টের মতো করে। সংসদ তাকে সরাসরি টাকা দেবে। সরকার থেকে সে নেবে না। মোবাইল কোর্টের প্রতি তার অসাংবিধানিক অনুরাগ প্রকাশ পেয়েছে। আইনে তেমন বিধান রাখা হয়েছে। এটা বাদ দেওয়া জরুরি।

কিন্তু কমিশনকে শক্তিশালী করতে বিদ্যমান আইনের হালনাগাদকরণ ও তার বাস্তবায়ন জরুরি। যেমন ১৮৬৪ সালের ক্যানাল অ্যাক্টে খালখেকোর সাজা ৫০ টাকা জরিমানা। এটা তো প্রকাশ্যে সিগারেটখেকোর সাজার সমান। মানুষকে বোঝাতে হবে, নর্দমা বঁাচালে খাল বাঁচবে। খাল বাঁচলে নদী বাঁচবে। নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে।

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক

[email protected]