আজ ২০ নভেম্বর জননী সাহসিকা সুফিয়া কামালের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রুশ সাংবাদিক আলেক্সান্দর তের-গ্রিগোরিয়ানের রুশ ভাষায় লেখা বেনগালিস্ক আগিন নাদিয়েঝদি (বাংলার আশার আগুন) বই থেকে সুফিয়া কামাল-সম্পর্কিত একটি
অংশ অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো।
ঢাকার খুব কম মানুষই তাঁকে অন্য কোনো নামে ডাকে। ‘খালাম্মা’ শব্দটি দুটো শব্দ দিয়ে তৈরি হয়েছে—খালা ও আম্মা, যার অর্থ মায়ের বোন। এই শীর্ণকায় নারীর জন্য প্রতিটি মানুষেরই আছে সন্তানের মতো অনুভূতি। আর এই খালাম্মা—খুব বড় সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ, আলোকিত মানুষটি অনেক বইও লিখেছেন। সুফিয়া কামাল মনোযোগ ও সক্রিয়তার মাধ্যমে মায়ের ভালোবাসায় সিক্ত করে চলেছেন দেশের মানুষকে। মনে পড়ছে দুই ছাত্রের মধ্যে পলপট নিয়ে বিতর্কের কথা—পলপটকে কি খুনি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? ঢাকার পত্রিকাগুলো এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত প্রকাশ করছে। তারা তর্ক করছিল, যে যার মতো তথ্যের সপক্ষে যুক্তি দিচ্ছিল, পরে তারা শান্ত হয়ে ভাবল—এ ব্যাপারে খালাম্মা কী বলেন? তারা ঠিকই এ ব্যাপারে খালাম্মার একটি বক্তৃতা খুঁজে বের করল এবং সবাই একমত হলো, পলপট খুনি, কারণ সুফিয়া কামাল সে কথাই বলেছেন। খালাম্মা সত্য ছাড়া আর কিছুই বলেন না।
আমি সাদা শাড়ি লাল পাড়ে শরীর জড়িয়ে নেওয়া এই ক্ষীণকায় নারীর দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি, কীভাবে তিনি নিজের এই দীর্ঘজীবনে প্রচণ্ড স্বার্থপর ও শক্তিশালী পৃথিবীর সব ধরনের প্রতিকূলতা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখলেন এবং নিজের মধ্যে লালন করলেন মানবতাবাদ? ছোট্ট নারী, এই দেশের রেওয়াজ অনুযায়ী ছোট্ট একটা ঘোমটা মাথায় দিয়ে চশমার আড়ালে থাকা সুতীক্ষ্ণ চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। বলিরেখায় আকীর্ণ হাত দুটি দিয়ে তিন বছর বয়সী নাতনিকে আদর করছিলেন তিনি। খালাম্মার কোলেই বসে ছিল এই শিশুটি।
‘নাতনি রে নাতনি, তুই খুব সুন্দরী হবি। একেবারে মাদাম শুকুরোভার মতো!’ খালাম্মা হঠাৎ তাসখন্দের লেখক শুকুরোভার কথা মনে করেন। তাঁরই আতিথ্য তিনি গ্রহণ করেছিলেন, যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন।
‘মেয়েটা তোমার মতো সুন্দরী হবে, মা!’ সুফিয়া কামালের ছেলে, সাংবাদিক শাহেদ কামাল বলে ওঠেন।
আমরা ধানমন্ডিতে সুফিয়া কামালের বাড়িতে এসেছি। দেয়ালের এক পাশে একটি লতানো গাছ হিরের মতো রং নিয়ে লতিয়ে উঠেছে। খালাম্মার মেয়ে আমাদের সামনে শুকনো সেমাই, বিস্কুট আর বাদাম এনে রাখলেন।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে জিজ্ঞেস করি খালাম্মাকে।
‘আমার তখন মাত্র আঠারো বছর বয়স। আর তাঁর বয়স তখন ষাট! দেখা হয়েছিল কলকাতায়...’
এবার তিনি একটু চুপ করে থাকেন। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কোনো কথা মনে করে মুখ টিপে হাসেন।
‘আমার মাথায় বড় ঘোমটা দেখে তিনি হাসতে লাগলেন। আমি তখন ঘোমটা দিয়ে চলতাম। যখন তিনি শুনলেন আমি বরিশালের মানুষ, তখন বললেন, আমরা তো নিজেদের মানুষ। তিনি তাঁর মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন বরিশালে। তাঁর জন্মদিন স্মরণে লেখা আমার একটি কবিতা তাঁকে দিলাম। এবং কী যে অবাক হলাম, পরদিনই কবিতায় তার উত্তর পেয়ে! মহান এই কবি আঠারো বছর বয়সী ঘোমটা পরা পিচ্চি মেয়েকে কবিতা দিয়ে সম্ভাষণ করছেন! সে সময়ই আমি বুঝেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাষাকে এক শ বছর এগিয়ে দিয়েছেন।
বছর পার হলো। কলকাতার সাহিত্যপত্রগুলোয় আমার কিছু কবিতা ছাপা হলো। রবীন্দ্রনাথ আমাকে অভিনন্দন জানালেন। তিনি সব সময় তাঁর নাটকের উদ্বোধনী মঞ্চায়নের দিন আমাকে আমন্ত্রণ জানাতেন। আমাকে কিন্তু নজরুল ইসলামও চিঠি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, তুমি মুসলমান মেয়ে হয়েও ট্যাবু ভেঙে কবিতা লিখেছ এবং তা নিয়ে লড়ছ, এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এরপর তিনি আমার সঙ্গে পরিচিত হতে এসেছেন। দরজার কড়া নাড়লেন এবং ঢুকে পড়লেন, যেন এ রকমটাই হওয়ার কথা ছিল। তিনি ওই সব রক্ষণশীলতার ধারই ধারতেন না। তিনি মুহূর্তের মধ্যেই পুরো ঘর অধিকার করে নিলেন, আমার বাড়ির সবাইকে বিব্রত করলেন। তারা ভাবতেই পারছিল না, তাদের এই ছোট মেয়ে সুফিয়া একজন বাইরের পুরুষের সঙ্গে একা একা রাজনীতি নিয়ে গল্প করবে একটা ঘরে বসে!
এরপর ব্যালকনিতে বসে তিনি কবিতা আবৃত্তি করলেন। রাস্তায় লোক জমে গেল। সবাই মনোযোগ দিয়ে তাঁর কবিতা শুনল। তিনি অসাধারণ আবৃত্তি করতেন। তিনি আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কয়েক বছর আগে, যখন তিনি বেঁচে ছিলেন কিন্তু হিতাহিত জ্ঞান ছিল না তাঁর, আমি তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তখন তিনি নিজের নামটাও মনে রাখতে পারতেন না, কথাও বলতে পারতেন না। কিন্তু আমি যখন তাঁর কাছে গেলাম, তিনি আমাকে চিনলেন। তাঁর চোখ আলোকিত হয়ে উঠল। তিনি চিৎকার করে উঠলেন।’
তাঁর চিকন বলিরেখাসমৃদ্ধ আঙুলগুলো খাম থেকে একটা রঙিন ছবি বের করল। সে ছবিতে খালাম্মা, এ রকমই একটা শাড়ি পরে। তিনি বসে আছেন নজরুল ইসলামের পাশে। মহান এই লোকটির চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই, তিনি বহুদিন ধরে নিজের মধ্যে নেই!
বেগম সুফিয়া কামাল আমার দিকে তাকালেন। তাঁর চোখে কষ্ট ভেসে উঠেছে। আমার মনে পড়ছে, এক মিটিংয়ে তাঁকে দেখেছিলাম। দৃঢ় চিত্তে তিনি বলছিলেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর সকল দেশের শোষিত মানুষের বন্ধু। এই দেশটির সমালোচনা করতে পারে শুধু তারাই, যারা মানবতাবাদের ধার ধারে না।’
রুশ থেকে অনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর
আলেক্সান্দর তের-গ্রিগোরিয়ান: রুশ সাংবাদিক।