খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে সরকারের অবস্থান ও মিনমিনে বিএনপি

খালেদা জিয়া
Sarfuddin Ahmed

খালেদা জিয়া ৫৪ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন। বিভিন্ন ব্যাধিতে ধুঁকছেন কারাবন্দী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের মতে, উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরেই আর্থ্রাইটিসে ভুগছেন। তাঁর যকৃৎ ও বৃক্ক আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। সম্প্রতি কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পর যকৃৎ ও বৃক্ক আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চিকিৎসক ও বিএনপির নেতা–কর্মীরা শঙ্কা করছেন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হতে পারে। কারণ, এখনো তিনি পুরোপুরি সুস্থ নন।

কিন্তু খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে সরকারের তরফ থেকে ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়েছে। খালেদা জিয়া বর্তমানে জেলবন্দী। যদিও তিনি সরকারের বিশেষ অনুমতিতে নিজ বাসভবনে অবস্থান করছেন। ব্যক্তিগত চিকিৎসক দলের কাছ থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু তাঁকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে সরকারের অনুমতি লাগবে।

যেহেতু খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকেরা বিদেশে নেওয়ার কথা বলছেন, তাই সরকারি চিকিৎসকেরা খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মতামত দিতে পারেন। উভয় পক্ষের চিকিৎসকদের মতামতের ভিত্তিতে সরকার বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। নতুবা সরকার ঘোষণা দিক খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। তাহলে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে ধোঁয়াশার অবসান হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার যেকোনো পরিণতির দায়–দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে।

খালেদা জিয়ার দল বিএনপিও এ বিষয়ে যোগ্য ভূমিকা রাখছে না। বরং মিনমিন করে কথা বলছে। অনেকটা সরকারের কাছে কাতর অনুরোধ করছে খালেদা জিয়ার জীবন রক্ষার জন্য। খালেদা জিয়া যদি যথাযথ চিকিৎসা না পান, তবে এটা দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্পষ্ট করে তুলে ধরা উচিত বিএনপির

অপর দিকে খালেদা জিয়ার দল বিএনপিও এ বিষয়ে যোগ্য ভূমিকা রাখছে না। বরং মিনমিন করে কথা বলছে। অনেকটা সরকারের কাছে কাতর অনুরোধ করছে খালেদা জিয়ার জীবন রক্ষার জন্য। খালেদা জিয়া যদি যথাযথ চিকিৎসা না পান, তবে এটা দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্পষ্ট করে তুলে ধরা উচিত বিএনপির। অবশ্য বর্তমান বিএনপির কাছে খুব বেশি কিছু আশা করা সমীচীনও হবে না। খালেদা জিয়াকে জেলে রেখেই বিএনপির সদস্যরা সংসদে যোগ দিয়েছেন। যোগ দেওয়ার আগে তাঁদের ভাবখানা এমন ছিল যে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সংসদ কাঁপিয়ে তুলবেন।

রীতিমতো বিশাল বিপ্লবের স্বপ্ন দেখানোর পর দেখা গেল তাঁরা হাস্যকর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছেন। কেউ সরকারি প্লটের জন্য আবেদন করছেন। কেউ কেউ সংসদে বিনা বিচারের অপরাধীদের হত্যার দাবি করছেন। আরেকজন প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন সংসদে আসার সুযোগ দেওয়ার জন্য। এই হচ্ছে বিএনপির সংসদ সদস্যদের অবস্থা। তাঁদের কথাবার্তা শুনলে মাঝেমধ্যে সরকারি দলের সদস্য বলে ভ্রম হয়।

যদিও বিএনপি দাবি করে সরকার খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জেলবন্দী করেছে। কিন্তু এই অবস্থানের ভিত্তিতে বিএনপি দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো জনমত তৈরি করতে পারেনি। বিএনপির মানবাধিকার বা আইন বিষয় এবং আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক বলে কয়েকটি পদ আছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগের জন্য একটি কমিটিও আছে। এসব কমিটির সদস্যরা খালেদা জিয়ার বিষয়ে মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠনগুলোর সঙ্গে আদৌ কথা বলেছেন বলে মনে হচ্ছে না।

একজন জেলবন্দী ব্যক্তির যথাযথ সুচিকিৎসা পাওয়া মানবাধিকারের অংশ। কিন্তু খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসার বিষয়ে এই নেতাদের আন্তরিক বলেও মনে হচ্ছে না।
অবশ্য বিএনপির লোকজন গত দুই দশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। বিশ্বরাজনীতির মেরুকরণ কীভাবে পরিবর্তন হচ্ছে, কে কোন দিকে যাচ্ছে, কোন দিকের পালে হাওয়া লাগছে, এসব বিষয়কে তারা ধরতেই পারেনি। কখন কোন দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে, কার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, এসব ভাবনা বিএনপির পরিকল্পনা ও কৌশলেই নেই। বরং দলীয় পদ নিয়ে কোন্দল, হুড়োহুড়ি ও মারামারিতে মত্ত বিএনপির নেতা–কর্মীরা। বছরের পর বছর যায় মাঠপর্যায়ে বিএনপির নতুন কমিটি হয় না। অঙ্গসংগঠনগুলোরও একই অবস্থা।

দেশের অন্যতম একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিসেবে খালেদা জিয়া যথাযথ চিকিৎসার দাবি রাখেন। রাজনৈতিক জীবন ও রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে খালেদা জিয়ার অনেক সমালোচনা আছে। মাগুরার উপনির্বাচন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনে বড় একটি ভুল হিসেবে সব সময়ই চিহ্নিত হবে।

এসব কারণেই বিএনপি ধুঁকছে এবং দেশের বাইরে ও ভেতরে উভয় ক্ষেত্রেই ভাবমূর্তির সংকটে ভুগছে। দলের এই অগোছালো অবস্থা খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন ও চিকিৎসার ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে বিএনপির অনেক নেতা ধরেই নিয়েছেন খালেদা জিয়ার জেলেই মৃত্যু হবে। এই নেতারা শোকসভা আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

অথচ এখন বিএনপির সব ধরনের রাজনীতি কেন্দ্রীভূত হওয়ার কথা খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসার বিষয়ে। দেশের অন্যতম একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিসেবে খালেদা জিয়া যথাযথ চিকিৎসার দাবি রাখেন। রাজনৈতিক জীবন ও রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে খালেদা জিয়ার অনেক সমালোচনা আছে। মাগুরার উপনির্বাচন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনে বড় একটি ভুল হিসেবে সব সময়ই চিহ্নিত হবে।

চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদে দুর্নীতির লাগাম যথাযথভাবে টেনে ধরতে পারেননি। সরকার ও দলে পরিবারের লোকজনদের দ্বিধাহীন চিত্তে জায়গা করে দিয়েছেন। সার বিতরণ নিয়েও একবার সংকট হয়েছিল। র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন গঠন ও তাঁর সময়েই বিনা বিচারে হত্যা শুরু হয়। যদিও অনেকেই বলে থাকেন দেশে বিনা বিচারে হত্যার প্রথম শিকার হচ্ছেন বাম রাজনৈতিক নেতা সিরাজ শিকদার। এসব ছাড়াও খালেদা জিয়ার আরও অনেক ভুলত্রুটি আছে।

অনেকেই প্রশ্ন করছেন, প্রধানমন্ত্রী ও দলের প্রধান হিসেবে তিনি কী করেছেন বা কতটা সফল? কিন্তু মনে রাখতে হবে রাজনৈতিক ভুল, সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার পাশাপাশি রাষ্ট্র ও দল পরিচালনার খেরোখাতায় খালেদা জিয়ার সফলতার তালিকাও নেহাতই কম না। একজন গৃহবধূর পরিচিতি নিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করে রাষ্ট্র ও দল একাই সামলেছেন। রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। বিএনপিকে পতনের খাদ থেকে টেনে তুলেছেন। ভাঙন রোধ করে একক ভাবমূর্তি দিয়ে নির্বাচনে জিতিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। খালেদা জিয়া একদল অভিজ্ঞ ও দক্ষ রাজনৈতিক নেতার সাহচর্য পেয়েছিলেন। এই নেতাদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতিতে নিজস্ব ভাবমূর্তি গঠন করেছেন।


প্রথম মেয়াদে খালেদা জিয়া যখন দায়িত্ব নেন, তখন দেশের অর্থনীতি খুব নাজুক অবস্থায় ছিল। নাজুক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কাঠামোগত পরিবর্তন করে অর্থনৈতিক সংস্কারের সূচনা করা হয়। তাঁর প্রথম মেয়াদকে বলা হয় অর্থনৈতিক সংস্কারের শাসনামল। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে পণ্য আমদানিতে লাইসেন্স প্রথা বিলোপ করা হয় ওই সময়, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করেছিল।

খালেদা জিয়া প্রথম পর্যায়ে রাজনীতিবিদ ছিলেন না, কোনো রাজনৈতিক প্রশিক্ষণও ছিল না। রাজনীতিতে তাঁর আসার কথাও ছিল না। কিন্তু সময়ের বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনি রাজনীতির মাঠে প্রবেশ করেন। এরপর তিনি তাঁর মেধা ও দক্ষতা অনুসারে রাষ্ট্র ও দল পরিচালনা করেছেন।

২৭ ধরনের শুল্ক হ্রাস করে ৭ ধরনের আমদানি শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য মূল্য সংযোজন কর প্রবর্তন করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করা করা হয়। তৃতীয় প্রজন্মের নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। ব্যক্তিগত আয়কর প্রদানের হার ৫৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ করা হয়। কাঁচামাল আমদানি সহজ করায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের নতুন পরিবেশ তৈরি হয়। ফলে রপ্তানি আয়ও বৃদ্ধি পায়।
উল্লেখ্য, বর্তমানে জিডিপির ৮৯ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। এসব কারণে নানা ধরনের রাজনৈতিক সংঘাত, অনিশ্চয়তা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরও ৯০–পরবর্তী সময়ে দেশে কখনোই খাদ্যসংকট সৃষ্টি হয়নি। দুর্ভিক্ষ হয়নি। অর্থনীতির উদারীকরণ ছাড়াও খালেদা জিয়ার আমলে নারীর ক্ষমতায়নকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা ও শিক্ষা উপবৃত্তি শুরু করা হয়।

শিক্ষা খাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয় ব্যাপক হারে। গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্গঠনের জন্য পোলট্রি, মাছ চাষ, শাকসবজি চাষ, গরুর খামারিদের বিভিন্ন ধরনের সুবিধা প্রদান করা হয়। প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ একাধিক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় খালেদা জিয়ার আমলেই।

খালেদা জিয়া প্রথম পর্যায়ে রাজনীতিবিদ ছিলেন না, কোনো রাজনৈতিক প্রশিক্ষণও ছিল না। রাজনীতিতে তাঁর আসার কথাও ছিল না। কিন্তু সময়ের বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনি রাজনীতির মাঠে প্রবেশ করেন। এরপর তিনি তাঁর মেধা ও দক্ষতা অনুসারে রাষ্ট্র ও দল পরিচালনা করেছেন। এসব কারণেই তিনি দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। দেশকে তিনি কতটুকু এগিয়ে নিতে পেরেছেন তা নিয়ে তর্ক, বিতর্ক থাকবেই।

প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির ব্যবধানও হয়তো তিনি পুরোপুরি ঘোচাতে পারেননি জনসাধারণের চাহিদা অনুসারে। কিন্তু বিন্দুমাত্র হলেও দেশের ঘুরে দাঁড়ানোর হাল তিনি শক্তভাবেই ধরেছিলেন। ১৯৮০–এর দশকের গালভরা উন্নয়নের ভাঁওতাবাজি থেকে দেশকে উন্নয়নের স্রোতে নিয়ে এসেছিলেন। তাই বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদের চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি কখনোই কাম্য না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ বিষয়ে নানা সমীকরণের রাজনীতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এর অবসান হওয়া উচিত। খালেদা জিয়ার বয়স এখন ৭৬ বছর। বয়স বিবেচনা করেও তাঁর চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আপসহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়েই বরং নানা ধরনের আপস হচ্ছে। এমনকি এই আপস প্রক্রিয়ায় তাঁর দলের অনেকেরই অংশগ্রহণের কথা বাতাসে উড়ে বেড়ায়।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক