খুনের আসামি সাংসদপুত্র এত দিন কোথায় ছিলেন?

আত্মসমর্পণের পর আসামি সহিদুর রহমান খানকে কারাগারে নিয়ে যায় পুলিশ
ছবি: প্রথম আলো

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম সেখানকার ভোটের হালচাল দেখতে। সঙ্গে ছিলেন প্রথম আলোর টাঙ্গাইল প্রতিনিধি কামনাশীষ শেখর। টাঙ্গাইলে সে সময় ভোটের চেয়ে বেশি আলোচনায় ছিলেন দুজন প্রার্থী।

আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আতাউর রহমান খান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। দুজন দুই আসনে—আতাউর ঘাটাইল ও লতিফ সিদ্দিকী কালিহাতী থেকে নির্বাচন করছিলেন। প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে লতিফ সিদ্দিকী ‘আমরণ অনশন’ করতে গিয়ে তখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আর ঘাটাইলে আওয়ামী লীগ যাঁকে মনোনয়ন দিয়েছে, তাঁর চার পুত্র একটি খুনের মামলার আসামি। দুই পুত্র এখনো পলাতক। একপুত্র জামিনে, আরেক পুত্র কারাগারে।

২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি খুন হন মুক্তিযোদ্ধা ও টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ফারুক আহমেদ। ঘটনার তিন দিন পর তাঁর স্ত্রী নাহার আহমেদ বাদী হয়ে টাঙ্গাইল সদর থানায় মামলা করেন। ফারুক হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ২০১৪ সালের আগস্টে গোয়েন্দা পুলিশ আনিসুল ইসলাম রাজা নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে।

পরে রাজার দেওয়া স্বীকারোক্তিতে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তৎকালীন সাংসদ আমানুর রহমান খান ওরফে রানা ও তাঁর ছোট ভাই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সহসভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পার জড়িত থাকার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। পরবর্তী তদন্তে আরও দুই ভাইয়ের নাম আসে।

২০১৪ সালে ঘাটাইল আসনে নির্বাচিত হন আমানুর রহমান রানা। খুনের মামলার আসামি হওয়ায় অনেক দিন আত্মগোপনে ছিলেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি সংসদে গিয়ে অধিবেশনে যোগ না দিয়ে হাজিরা খাতায় সই দিয়ে সাংসদ পদ রক্ষা করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তাঁর মনোনয়ন নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগে আপত্তি উঠলে দল আমানুরকে মনোনয়ন না দিয়ে তাঁর বাবা আতাউর রহমানকে মনোনয়ন দেয় এবং তিনি অনায়াসে জিতেও যান। খুনের মামলার চার আসামির পিতা এখন সাংসদ।

ফারুক হত্যা মামলায় পুলিশ ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ১৪ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়, যাঁদের মধ্যে সাবেক সাংসদ আমানুর ও তাঁর তিন ভাই এবং তাঁদের ব্যক্তিগত সহকারী ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা আছেন। চার্জশিট দেওয়ার পর সাংসদ আমানুর আদালতে আত্মসমর্পণ করে পৌনে দুই বছর হাজতবাস করেন। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন। গত বুধবার অপর ভাই সহিদুর রহমান আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে আদালত তা মঞ্জুর না করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আমানুরের অপর দুই ভাই ও মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি জাহিদুর রহমান খান কাকন ও সানইয়াত খান বাপ্পা ফারুক হত্যার পর থেকেই পলাতক। তাঁরা পালিয়ে বিদেশে গেছেন বলে টাঙ্গাইলের সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন।

টাঙ্গাইল পুলিশ বলেছে, আসামিকে তাঁরা খুঁজে পাচ্ছেন না। কিন্তু যে আসামি দু–দুবার প্রকাশ্যে আদালতে এলেন, তাঁকে কেন তারা খুঁজে পেল না?

নির্বাচনের আগে কামনাশীষ শেখরকে সঙ্গে নিয়ে নিহত ফারুক আহমেদের স্ত্রী নাহার আহমদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করি। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনিও আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। একই দলে খুনের মামলার আসামি ও বাদী অবস্থান করছেন। এটাও আমাতদের রাজনীতির নির্মম বাস্তবতা। দেশের বিভিন্ন স্থানে যত রাজনৈতিক খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে, বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দলে। নাহার আহমেদ বলেছেন, তিনি স্বামী হত্যার বিচার চান। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছেও তিনি এই আরজি রেখেছেন। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, ফারুক হত্যার আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় তিনি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন, মনোনয়ন যিনিই পান না কেন আইন নিজস্ব গতিতে চলবে। তাঁর দাবি, সরকার বিদেশে পলাতক অনেক আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ইন্টারপোলের সহায়তা চাইছে। মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হত্যা মামলার আসামিদেরও একই কায়দায় ফিরিয়ে আনা হোক। নাহার আহমেদ সাত বছর ধরে স্বামী হত্যার বিচারের অপেক্ষা করছেন। আদালতে একবার আসামি আমানুরকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘তুই আমাকে কেন বিধবার পোশাক পরালি।’

গত বুধবার মামলার পলাতক আসামি ও আমানুরের অপর ভাই সহিদুর রহমান খান মুক্তি আদালতে এসে আত্মসমর্পণ করে জামিন প্রার্থনা করেন। রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি মনিরুল ইসলাম খান এবং বাদীপক্ষের আইনজীবী রফিকুল ইসলাম জামিনের বিরোধিতা করেন। এ সময় আদালতে উপস্থিত হয়ে নিহত ফারুক আহমেদের স্ত্রী ও মামলার বাদী নাহার আহমেদ ন্যায়বিচারের স্বার্থে সহিদুরকে জামিন না দেওয়ার জন্য আদালতের প্রতি অনুরোধ করেন। শুনানি শেষে বিচারক সিকান্দার জুলকান নাইন আসামিকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। টাঙ্গাইল পুলিশ বলেছে, আসামিকে তাঁরা খুঁজে পাচ্ছেন না। কিন্তু যে আসামি দু–দুবার প্রকাশ্যে আদালতে এলেন, তাঁকে কেন তারা খুঁজে পেল না?

একদা টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নেতা ছিলেন আবদুল মান্নান। তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। পঁচাত্তরের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসে সিদ্দিকী পরিবার—আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আবদুল কাদের সিদ্দিকী, মুরাদ সিদ্দিকীর কথায় টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগ চলত। এরপর সিদ্দিকী পরিবারের ভাটির টান দেখা দিলে খান পরিবারের আবির্ভাব ঘটে। আমানুর রহমান খান সাংসদ নির্বাচিত হন। তাঁর ভাই সহিদুর রহমান টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র হন। টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগের আরেক প্রভাবশালী নেতা ছিলেন ফারুক আহমেদ। তাঁর সঙ্গে খান পরিবারের রাজনৈতিক বিরোধ ছিল। তা থাকতেই পারে। কিন্তু তাই বলে সেই বিরোধ খুনোখুনিতে গড়াবে, এ কথা কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। যে দল নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক বলে দাবি করে, সেই দলে এ রকম খুনোখুনির ঘটনা কেন ঘটবে? ফারুক হত্যা মামলার চার্জশিট হওয়ার পরও আসামিদের বিরুদ্ধে দল থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং খুনের মামলার আসামিকে মনোনয়ন না দিতে পেরে তারা তাঁর বাবাকে সাংসদ বানিয়েছে।

টাঙ্গাইলের এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, তিনি ঢাকায় ছিলেন। তাঁর বাবা সাংসদ, তাঁর বড় ভাই সাবেক সাংসদ। আইন নিজস্ব গতিতে চললে খুনের মামলার চার্জশিটের কোনো আসামি ছয় বছর ধরে পালিয়ে থাকার কথা নয়।

সহিদুরের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা আছে। তিনি পলাতক হওয়ার পর ২০১৫ সালে গোয়েন্দা পুলিশ টাঙ্গাইল সদর উপজেলার পোড়াবাড়ি থেকে দুটি পিস্তলসহ এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। পরে ওই ব্যক্তি তাঁর স্বীকারোক্তিতে এই পিস্তল সহিদুর তাঁদের কাছে রাখতে দিয়েছিলেন বলে জানান। এ মামলায় গোয়েন্দা পুলিশ সহিদুরসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়।

সহিদুর দুই মামলার আসামি। তারপরও তিনি ছয় বছরের বেশি সময় ধরে পলাতক ছিলেন। টাঙ্গাইলের পুলিশ বলেছে, আসামি টাঙ্গাইলে ছিলেন না। তাহলে তিনি কোথায় ছিলেন? টাঙ্গাইলের এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, তিনি ঢাকায় ছিলেন। তাঁর বাবা সাংসদ, তাঁর বড় ভাই সাবেক সাংসদ। আইন নিজস্ব গতিতে চললে খুনের মামলার চার্জশিটের কোনো আসামি ছয় বছর ধরে পালিয়ে থাকার কথা নয়।

যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গায়েবি মামলার আসামিদের বাড়ি গিয়ে পাকড়াও করতে পারেন, সেখানে খুনের মামলার আসামিকে কেন ধরতে পারলেন না?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি