খেলা এখনো কিম উনের হাতে

কিম জং উন। ছবি: রয়টার্স
কিম জং উন। ছবি: রয়টার্স

দীর্ঘ টিভি সিরিয়ালের কেন্দ্রীয় চরিত্রের কায়দায় উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং-উন আগের মতোই নাটকীয়ভাবে কোরীয় উপদ্বীপে নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছেন। এ মাসের প্রথমে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করার পর এবার তাঁর দেশে দক্ষিণ কোরীয় কূটনীতিকদের স্বাগত জানানোর ভবনটি বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। বেসামরিকীকৃত সীমান্ত এলাকায় নতুন করে সেনা মোতায়েন করেছেন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে নতুন করে হুমকি জারি করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বোধগম্য কারণে বিষয়টা উপেক্ষা করে চলেছেন। দুই বছর ধরে ট্রাম্পের সঙ্গে টিভিমুখী সম্মেলনের পর কিম বুঝতে পেরেছেন, ‘পিরিতের’ দিন শেষ। বরং পুরোনো গল্পটাই তাঁর টিভি রেটিং বাড়াবে। ট্রাম্পের ভুজুং ভাজুং থেকে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার পর কিম এখন উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক ক্ষমতাধর দেশের কাতারে প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। দেশের মধ্যে সেটা বোঝাতে পরমাণু কর্মসূচির দায়িত্বে থাকা জেনারেলকে কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যানের পদে উন্নীত করেছেন। পাশাপাশি সাম্প্রতিক কালে দেশের কৌশলগত সাফল্যে অবদান রাখার জন্য আরও ৬৯ জন জেনারেলকে এ বছর বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করেছেন।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভিয়েতনামের হ্যানয়ে অনুষ্ঠিত ব্যর্থ পরমাণু সম্মেলনের পর কিম কথা ও কাজ উভয় ক্ষেত্রেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছেন। গত এপ্রিলে তিনি ট্রাম্পকে হুঁশিয়ারি জানিয়ে বলেন যে ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার ওপর মার্কিন অবরোধ তোলার জন্য ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময় পেয়েছিলেন। তখন থেকেই উত্তর কোরিয়া স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে (উল্লেখযোগ্য সাফল্যসহ), মিসাইল উৎপাদন কারখানা আরও বড় করা হয়েছে এবং ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি সহায়ক ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।

উত্তর কোরিয়ার গোপন আয়ের উৎস ও বাণিজ্যের ওপর ‘সর্বোচ্চ চাপ’ প্রয়োগের ট্রাম্পীয় কৌশল উত্তর কোরিয়ার পরমাণু ও মিসাইল কর্মসূচি বন্ধ করতে স্পষ্টত চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এর জবাবে আমেরিকা ২৮ জন উত্তর কোরীয় এবং ৫ জন চীনা কর্মকর্তা ও ব্যাংকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার ওপর অবরোধ অমান্য করার অভিযোগ আনা হয়। ২০১৪ সাল থেকে উত্তর কোরিয়ার বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক—চীনা সহায়তায়—দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র, মিসাইল ও উচ্চপ্রযুক্তিগত কর্মসূচিতে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করেছে।

নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সর্বাত্মক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া প্রযুক্তিগতভাবে অনেক এগিয়ে থাকবে। কিন্তু অল্প সময়ের যুদ্ধই আড়াই কোটি জনসংখ্যার দক্ষিণ কোরীয় রাজধানীর জন্য বিপর্যয়কর হবে। দক্ষিণ কোরিয়ার অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বাস এই শহরে এবং এটি দেশটির জিডিপির ৭০ ভাগের উৎস। এর পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্প দক্ষিণ কোরিয়ায় মোতায়েন মার্কিন সেনাদের পেছনে খরচ চার গুণ বাড়ানোর জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর যে চাপ সৃষ্টি করছেন, তা দায়িত্বহীন আচরণ। সেখানকার মার্কিন অবকাঠামোয় কর্মরত চার হাজার দক্ষিণ কোরীয়র বেতন দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারকে দিতে বলা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কিম জেনে আরও স্বস্তি পাবেন যে ট্রাম্প জাপানে মোতায়েন মার্কিন সেনাদের পেছনে ব্যয় বাড়াতে বলেছেন জাপানের সরকারকেও। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষায় জাপানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও এ দুই দেশের সম্পর্ক চড়াই-উতরাইয়ে ভরা। দক্ষিণ কোরীয়দের মতো বেশির ভাগ জাপানিই ট্রাম্পের ওপর আস্থাশীল নয়। এসব ঘটনা দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে কূটনৈতিক অসংগতি সৃষ্টি করছে; তার সুফল পাচ্ছেন কিম।

ওই অঞ্চলে মার্কিন মিত্রদের খাটো করা ছাড়াও চীনের সঙ্গে বিবাদ বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিমের জন্য কল্যাণ বয়ে আনছে। উত্তর কোরিয়ার বাণিজ্যের ৯০ শতাংশই চীনের সঙ্গে। তা ছাড়া চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কিমের সম্পর্কও বেশ ঘনিষ্ঠ। গত জুনে তিনি উত্তর কোরিয়া সফর করেন। এসব থেকে বোঝা যায়, চীন কিমের আচরণে অবাকও হয়নি, বিরক্তও হয়নি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে কিমের জন্য আগামী দিনগুলো মসৃণ হবে। মার্কিন অবরোধের কারণে খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি এবং বেশ কিছু সংস্কারকাজে ব্যর্থতার পরিণতিতে উত্তর কোরিয়া কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ক্ষমতাসীন ওয়ার্কার্স পার্টির বার্ষিক সম্মেলনে কিম তাই বলেছেন, বছরের প্রথম অর্ধেক সময় তিনি স্থানীয় সমস্যাকে অগ্রাধিকার দেবেন। করোনা মহামারির কারণে চীনের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ রাখায় উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগের অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়নে কঠোর তদারকি ইঙ্গিত করে যে দেশীয় ফ্রন্টে কিমের জন্য মুশকিল
অপেক্ষা করছে।

অর্থনৈতিক সংকট থাক বা না থাক, কিম তাঁর পরিবারের ঐতিহ্য থেকে নড়বেন না। বাপ–দাদার মতো তিনিও সহিংসতার হুমকি, আবেগপ্রবণ উসকানি ও সম্ভাব্য সামরিক কার্যক্রম দিয়ে অবস্থান শক্ত করতে চাইবেন। সব ইঙ্গিত এটাই বলে যে উত্তর কোরিয়া আরও কঠোর হবে। কোরীয় উপদ্বীপে যে দীর্ঘ নাটক অভিনীত হয়ে চলেছে, সেখানে নতুন চরিত্র আসতে পারে, কিন্তু নাটকের অভিমুখ তাতে বদলাবে না।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত

কেন্ট হ্যারিংটন সিআইএর সাবেক বিশ্লেষক ও পরিচালক, ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স অফিসার হিসেবে পূর্ব এশিয়ায় কাজ করেছেন