গণতন্ত্র থেকে আমরা সংকর শাসনে!

করোনাকালে অনেক কিছু বদলে গেলেও রাজনীতি যে সামান্য বদলায়নি, তা নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতি থেকেই উপলব্ধি করা যায়। সরকারি বা বিরোধী দল—কারও মধ্যে সামনের দিকে এগোনোর চিন্তাভাবনা আছে বলে মনে হয় না।

গত ৩০ ডিসেম্বর ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই বছর পূর্তি। দিনটিকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষই গৎবাঁধা কিছু কথা বলেছে। যুক্তি নয়, কথার তির ছুড়ে দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চেয়েছে।

৪৯ বছর পেরিয়ে আমাদের স্বাধীনতা ৫০ বছরে পড়েছে। এই সময়ে দেশের অর্থনীতি অনেক ঋদ্ধ হয়েছে, তলাবিহীন ঝুড়ির তলাটা মজবুত হয়েছে। একদা খাদ্যঘাটতির দেশটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। করোনাকালে অনলাইন ব্যবসা-বাণিজ্য বিকল্প পথ খুলে দিয়েছে। এত সব উন্নতি-অগ্রগতি সত্ত্বেও যে বিষয়টি আমাদের নিয়ত পীড়িত ও বিচলিত করে, তা হলো গণতন্ত্রের ভঙ্গুর অবস্থা। আর্থসামাজিক খাতে আমরা অনেক উন্নতি করলেও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো হয়েছে দুর্বল থেকে দুর্বলতর। আজ যাঁরা বিরোধী দলে থাকতে গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালন করছেন, তাঁরাও ক্ষমতায় থাকতে গণতন্ত্র রক্ষার চেষ্টা করেননি। আবার ক্ষমতায় থেকে যাঁরা ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ উদ্‌যাপন করছেন, তাঁরাও বিরোধী দলে থাকতে এ রকম বিজয় বরদাশত করেননি।

আওয়ামী লীগের দাবি, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় আছে, উন্নয়ন গতি পেয়েছে। যে দেশে কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব মনে করেন তাঁরা না থাকলে গণতন্ত্র, উন্নয়ন, স্বাধীনতা কিছুই থাকবে না; সে দেশে আর যা-ই হোক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপি ভোট ডাকাতির যে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে, তা কেউ ভাঙতে পারবে না।’ কথাটি খুবই বিপজ্জনক। আমাদের রাজনৈতিক দল ও সরকারগুলো একে অপরের রেকর্ড ভাঙতে বেশ তৎপর। তবে সেটি যতটা না ভালো কাজে, তার চেয়ে বেশি গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নাগরিক অধিকার ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণে। একই সভায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, ‘অতীতে যাঁরা গণতন্ত্র হত্যা করেছেন, তাঁদের মুখে গণতন্ত্রের কথা মানায় না।’ তাঁর কথা যদি সত্য ধরেও নিই, দেশের সাধারণ মানুষ কী অন্যায় করেছেন? তঁারা কেন ভোট দিতে পারলেন না? নির্বাচনের বিষয়টি তো নিছক আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নয়। এর সঙ্গে জনগণের ভোটাধিকার জড়িত। আওয়ামী লীগের নেতারা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ফল আর কেন্দ্রের ভোটের চিত্র এক ছিল? যদি না থাকে, তার দায় তঁাদের নিতে হবে। যেমন ১৯৭৯ ও ১৯৯৬ সালের (১৫ ফেব্রুয়ারি) নির্বাচনের দায় বিএনপিকে এবং ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনের দায় জাতীয় পার্টিকে নিতে হবে।

বিএনপি ৩০ ডিসেম্বর পালন করেছে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে। এ উপলক্ষে আয়োজিত সভা-সমাবেশ থেকে দলের নেতারা অবিলম্বে সংসদ ভেঙে দিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি তুলেছেন। আরও কয়েকটি দল একই দাবি তুলেছে। বিএনপি ৩০ ডিসেম্বরে ঢাকায় বড় জমায়েত করতে পারেনি। কিন্তু পুলিশের বাধা সত্ত্বেও জেলায় জেলায় তারা যে দাপট দেখিয়েছে, তাতে বলা যাবে না বিএনপি গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

৩০ ডিসেম্বর নিয়ে যখন সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে ঝগড়া চলছে, তখন দেখা যাক বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অবস্থানটি কোথায়। বিভিন্ন দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান, নাগরিক অধিকার, সরকারের সক্রিয়তা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ইত্যাদি মানদণ্ড ধরে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা ইআইইউ প্রতিবছর প্রতিবেদন তৈরি করে। চলতি বছরের প্রতিবেদনটি এখনো প্রকাশিত হয়নি। গত বছরের জানুয়ারিতে ২০১৯ সালের যে সূচক প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশ আট ধাপ এগোনোর পরও হাইব্রিড রেজিম বা সংকর শাসনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। খাঁটি গণতন্ত্র দূরের কথা, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রেও আমরা উন্নীত হতে পারিনি। ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মতে, এক যুগ ধরে বাংলাদেশ স্বৈরতান্ত্রিক ও ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অবস্থার মাঝামাঝি অবস্থানে আছে, যাকে বলে ‘হাইব্রিড রেজিম’ বা সংকর শাসনব্যবস্থা।

তবে বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের স্কোর আগের বছরের তুলনায় শূন্য দশমিক ১৪ বেড়েছে। ফলে ২০১৭ সালে যেখানে দেশটির অবস্থান ছিল ৯২তম, পরের বছর হয়েছে ৮৮তম।

প্রাপ্ত স্কোরের ভিত্তিতে দেশগুলোকে চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়: স্বৈরতন্ত্র, হাইব্রিড রেজিম, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র ও পূর্ণ গণতন্ত্র। ‘পূর্ণ গণতান্ত্রিক’ অবস্থায় যেতে হলে গণতান্ত্রিক সূচকে ৯ থেকে ১০ স্কোর করতে হয়। যেসব দেশের স্কোর ৭ থেকে ৮, সেসব দেশকে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ বলা হয়েছে। তবে এর নিচের অবস্থান ‘হাইব্রিড রেজিম’-এ তালিকাভুক্ত দেশগুলোর স্কোর ৫ থেকে ৬ এবং ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ দেশগুলোর স্কোর শূন্য থেকে ৪-এর মধ্যে। ১৬৭টি দেশের মধ্যে মাত্র ২০টি দেশ গণতন্ত্রের তালিকায়, ৫৫টি দেশ ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায়, ৩৯টি দেশ হাইব্রিড রেজিমের তালিকায় এবং ৫৩টি দেশ স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় আছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ৫ দশমিক ৫৭ স্কোর পেয়ে ইআইইউর হাইব্রিড রেজিম তালিকায় রয়েছে। (সূত্র: ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট)

ইআইইউর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ বিরাজ করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তানে হাইব্রিড রেজিম এবং আফগানিস্তানে ‘স্বৈরতন্ত্র’ সরকারব্যবস্থা আছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ২০০৬ সাল থেকে এ ধরনের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করছে ইআইইউ। ২০০৬ সালে ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। ২০২১ সালে আওয়ামী লীগ। সূচকে তেমন পরিবর্তন নেই।

কোনো দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই বলা যাবে না গণতন্ত্র আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চারটি নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছিল বলে দেশে-বিদেশে স্বীকৃত। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের গোঁয়ার্তুমি ও হঠকারি মনোভাবের কারণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টেকসই হয়নি। বরাবর বিরোধী দল রাজপথে সমাধান খুঁজেছে এবং সরকারি দল সবকিছু দখলে রাখতে চেয়েছে।

২০১৮ সালের নির্বাচনের দুই বছরের মাথায় বিরোধী দল মধ্যবর্তী নির্বাচনের আওয়াজ তুলেছে। সংবিধান অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা। মেয়াদ শেষের আগে সংসদ ভেঙেছে ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে। আবার ২০০৭ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নির্বাচন হতে পারেনি। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নেতারা তাকে সংবিধান রক্ষার নির্বাচন বলে অভিহিত করে সবাইকে নিয়ে আরেকটি নির্বাচন করার কথাও বলেছিলেন। সেটি হয়নি। দশম সংসদ মেয়াদ পূরণ করেছে। একাদশ সংসদের মেয়াদ নিয়ে কথা বলার সময় এখনো আসেনি। যাঁরা মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি তুলেছেন, তাঁরাও মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার তাঁদের কথা শুনবে না। আবার যে ভাষা ব্যবহার করলে সরকার শুনবে, সেই ক্ষমতাও তাদের নেই। নির্বাচন যখনই হোক না কেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও যদি আমরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে না পারি, সংকর রেজিম বা শাসনব্যবস্থায় আটকে থাকি, এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কী হতে পারে।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]