গণতন্ত্রকে ‘শোকেসে’ সাজাচ্ছে মোদি সরকার

নরেন্দ্র মোদি
ছবি: এএফপি

নতুন বছরের ভোরে আমরা ভারতে দুটি বিষয় দেখলাম। একটি হলো, দেশটির পার্লামেন্টের শীতকালীন অধিবেশন একেবারেই বসল না। দ্বিতীয়টি হলো, ১৯২৭ সালে দিল্লিতে নির্মিত মহাসৌকর্যমণ্ডিত পার্লামেন্ট ভবন চত্বর একটি নির্মাণ এলাকায় পরিণত হয়েছে।

একদিকে সংসদীয় গণতন্ত্রের শেষ ধাপ জনগণের প্রতিনিধিদের জবাবদিহিকে সরকার উড়িয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে মোদিজি তাঁর দাড়ি এবং চুল সাধারণত যে পরিমাণ রেখে থাকেন, তার চেয়ে অনেক বড় হতে দিচ্ছেন এবং এর মাধ্যমে নিজের চেহারায় প্রাচীনকালের ‘রাজ ঋষি’ আদল প্রতিষ্ঠা করছেন। তিনি প্রজাতন্ত্রকে নিজের চেহারাবদলের মতোই রাজনৈতিক ও কাঠামোগতভাবে পরিবর্তিত করতে যা যা করা দরকার, তার সবই করছেন। তিনি পুরোনো পার্লামেন্ট ভবনের পাশে বিশাল একটি নতুন পার্লামেন্ট ভবন কমপ্লেক্স গড়ে তুলছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি রাজধানীতে নিজের একটি কীর্তির স্মারক রেখে যেতে চাইছেন। নতুন কমপ্লেক্সের মধ্যে উপরাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বাসভবনও থাকছে।

২০২০ সালে পার্লামেন্টে অধিবেশন বসেনি বলা যায়। এর আনুষ্ঠানিক কারণ অবশ্যই কোভিড-১৯ মহামারি। এই মহামারির কারণে প্রথম দুটি অধিবেশন সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে এবং তৃতীয়টি বাতিল করা হয়েছে।

বাজেট অধিবেশনে মাত্র ২৩ দিন পার্লামেন্ট বসেছিল। পরে করোনার কারণে মার্চে অধিবেশন স্থগিত হয়ে যায়। বর্ষাকালীন অধিবেশন জুনের শেষ থেকে মধ্য জুলাইয়ে সাধারণত বসে এবং তা আগস্ট পর্যন্ত চলে। কিন্তু এ অধিবেশন বসানোর বিষয়ে সরকারকে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। সংসদে আলোচনা-সমালোচনার ঝক্কি এড়িয়ে বিশেষ নির্দেশে কাজ চালিয়ে যাওয়ার এই সুযোগ তৈরি হওয়ায় সরকার খুশি হয়েছে বলেই মনে হয়েছে। পরে অনীহা নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে ১৪ সেপ্টেম্বর বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরু হয়। কোনো সাপ্তাহিক বন্ধ ছাড়াই ১০ দিন চালানোর মাথায় করোনার কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়।

শীতকালীন অধিবেশন সাধারণত মধ্য নভেম্বরে শুরু হয় এবং বড়দিন পর্যন্ত চলে। তবে সে অধিবেশন একেবারেই বসেনি। সন্দেহ নেই, সাড়ে সাত শ জন এমপি এবং শত শত কর্মকর্তা ও সাংবাদিক পার্লামেন্ট কমপ্লেক্সে এই করোনাকালে জড়ো হওয়া খুবই বিপজ্জনক। বর্ষাকালীন অধিবেশন চলার সময়ই তিনজন মন্ত্রী, দুই ডজন এমপি এবং বেশ কয়েকজন পার্লামেন্ট কর্মকর্তার দেহে করোনাভাইরাস ধরা পড়েছিল এবং তিনজন এমপি এবং একজন মন্ত্রী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। কিন্তু বিশ্বের বহু দেশের পার্লামেন্ট অধিবেশন ভিডিও কনফারেন্সে চালানো সম্ভব হলেও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে ভারত সারা বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে, সেই ভারতের পক্ষে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এমপিরা অধিবেশন চালাতে পারলেন না, সেটি হতাশ করার মতোই ঘটনা।

মোদি সরকারের কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে, তারা ধরেই নিয়েছে, জনগণ যেহেতু তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে, সেহেতু তাদের সব কাজকেই জনগণ ভোট দেওয়ার সময়ই আগাম অনুমোদন দিয়ে রেখেছে, এর জন্য নতুন করে পার্লামেন্টে এ নিয়ে আলোচনা বা কোনো বিল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা নেই।

এর মাধ্যমে সরকার কী এড়াতে চেয়েছে, তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। এটি আমরা বর্ষাকালীন অধিবেশনেই বুঝতে পেরেছি। সেখানে আগে থেকেই ঠিক করে রাখা কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নামকাওয়াস্তে আলোচনার মাধ্যমে পাস করিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে বহুল বিতর্কিত শ্রম ও কৃষি আইন পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই বলা যায় কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই পাস করিয়ে নেওয়া হয়েছে।

জুনে সীমান্তে চীনের বাহিনীর হাতে ২০ জন ভারতীয় জওয়ানের নিহত হওয়া, চীনা সেনাদের ভারতীয় জমি দখল করে নেওয়া, নতুন শিক্ষানীতি এবং আরও অনেকগুলো বিষয় যাতে পার্লামেন্টে আলোচিত না হয়, সে জন্য ওই অধিবেশন দ্রুত শেষ করে ফেলা হয়।

২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সরকারের উত্থাপিত মোট বিলের ৭১ শতাংশ বিল সংসদীয় স্থায়ী কমিটি খতিয়ে দেখেছে। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর সেই হার ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে এবং ২০ মাস আগে মোদি দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পর একটি বিলও সংসদীয় কমিটিতে পর্যালোচনার জন্য যায়নি। এর মধ্যে কৃষি সংস্কার আইনও রয়েছে, যার কারণে কৃষকদের আন্দোলনে গোটা রাজধানী এখন অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে।

মোদি সরকারের কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে, তারা ধরেই নিয়েছে, জনগণ যেহেতু তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে, সেহেতু তাদের সব কাজকেই জনগণ ভোট দেওয়ার সময়ই আগাম অনুমোদন দিয়ে রেখেছে, এর জন্য নতুন করে পার্লামেন্টে এ নিয়ে আলোচনা বা কোনো বিল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা নেই।

মোদি সরকার মহাসমারোহে নতুন পার্লামেন্ট ভবন বানাচ্ছে, কিন্তু ভয়ের কথা হলো সেই ভবনকে গণতন্ত্রের ‘শোকেস’ হিসেবে দাঁড় করানো হবে। সেখানে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর কেন্দ্রস্থল হিসেবে একটি বিশাল ভবন থাকবে, কিন্তু গণতন্ত্র থাকবে না। বিজেপি সরকারের মতিগতি দেখে অন্তত সেটাই মনে হচ্ছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

শশী থারুর: ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব