গণতন্ত্রে পথহারা বাংলাদেশ উন্নয়নে পথ দেখাচ্ছে

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বিশ্বের নামকরা গণমাধ্যমেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইকোনমিস্ট বাংলাদেশের উন্নয়নকে বলেছে ধাঁধা। বিশ্বব্যাংকও আমাদের উন্নয়নের তারিফ করেছে। সম্প্রতি প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক নিকোলাস ক্রিস্টোফ নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতামত কলামে লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের দারিদ্র্য বিমোচনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। তাঁর ভাষায়, বিশ্বের ধনীতম ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র যে শিশু দারিদ্র্যের বিষয়টি আমলে নিয়েছে, আমি মনে করি এটি তার বিরাট নৈতিক শক্তি।

১০ মার্চ বাইডেনের ১ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলারের উদ্ধার পরিকল্পনা অনুমোদন পেয়েছে। এ কর্মসূচি মার্কিন শিশুদের দারিদ্র্য ব্যাপকভাবে কমাবে বলে মন্তব্য করেছেন নিকোলাস। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সমীক্ষা বলেছে, এ কর্মসূচি দরিদ্র শিশুদের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনবে। বাইডেন শিশুদের জন্য এমন কিছু করছেন, যার সঙ্গে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের প্রবীণ নাগরিক সহায়তার তুলনা করা যায়।

এরপরই নিকোলাস ক্রিস্টোফ বাংলাদেশ প্রসঙ্গ টেনে বললেন, ৫০ বছর আগে যখন গণহত্যা, দুর্দশা ও ক্ষুধার মধ্য দিয়ে দেশটির জন্ম হলো, তখন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার একে অভিহিত করেছিলেন তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের ভীতিকর ছবিগুলো দেশটিকে আশাহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ের খবর সংগ্রহ করতে নিকোলাস বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, দেশটি হতভাগা। সে সময় বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি যে হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন, তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে বলেও এ নিবন্ধে মন্তব্য করেন নিকোলাস। তাঁর সাক্ষ্য, গত তিন দশকে বাংলাদেশ অসাধারণ অগ্রগতি লাভ করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত বেড়ে চলেছে, করোনা মহামারির আগের চার বছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭-৮ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের মতে, এটি চীনের চেয়েও দ্রুতগামী। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর, যা মিশিগানের ১০টি কাউন্টিসহ যুক্তরাষ্ট্রের কিছু এলাকার চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ আবার মহামারির শিকার হতে পারে, কিন্তু কীভাবে অগ্রগতি করতে হয়, তা বিশ্বকে শেখাতে পারে।

বাংলাদেশের এ সাফল্যের গোপন রহস্য কী? নিকোলাসের জবাব—শিক্ষা ও নারী। ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশে এক-তৃতীয়াংশের কম শিশু প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পার হতো। মেয়েরা খুব কমই লেখাপড়া করত এবং অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল অনুল্লেখ্য। কিন্তু এরপর সরকার ও নাগরিক সংগঠনগুলো (এনজিও) শিক্ষার উন্নয়নে মনোনিবেশ করে। বর্তমানে ৯৮ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করতে পারছে। নিকোলাসের কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলেশিক্ষার্থীর চেয়ে মেয়েশিক্ষার্থীর হার বেশি।

নিকোলাস তাঁর নিবন্ধে শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁকে বলেছেন, নাটকীয় ঘটনা হলো বাংলাদেশের নারীর উন্নয়নের কাজটি শুরু করেছেন গরিব নারীরাই। গ্রামীণ ব্যাংক এক লাখ নারী উদ্যোক্তা তৈরি করেছে।

শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের কারণে নারীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির স্তম্ভ (পিলার) হতে পেরেছেন। এ ছাড়া দেশের তৈরি পোশাকশিল্প নারীদের জন্য ভালো সুযোগ এনে দিয়েছে। নিকোলাস তাঁর দেশের পাঠকদের উদ্দেশে বলেছেন, আপনি যে শার্ট পরছেন, তা বাংলাদেশের এবং তাঁদের (নারী) কেউ না কেউ তৈরি করেছেন। চীনের পর বাংলাদেশই দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ।

ব্র্যাক এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে মেয়েরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। প্রতিষ্ঠানটি মেয়েদের টিকাদান ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার পাওয়া নিশ্চিত করেছে। ব্র্যাকের কর্মীরা গ্রামের মানুষকে বই পড়া এবং জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী ব্যবহার শেখাচ্ছেন। তাঁরা বাল্যবিবাহ রোধেও কাজ করছেন।

বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে দারিদ্র্য বিমোচনের প্রেরণাসঞ্চারী গল্প বলে অভিহিত করেছে। গত ১৫ বছরে আড়াই কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে অপুষ্টির মাত্রা অর্ধেকে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে, যা ভারতের চেয়ে বেশি। অধিক জনসংখ্যা অগ্রগতির চাকা থামিয়ে দেয়, এ কথা উল্লেখ করে নিকোলাস জানিয়েছেন, বাংলাদেশের নারীরা এখন গড়ে দুটি সন্তান নিচ্ছেন। তিনি বলেননি, তবে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার রিপোর্টে দেখা যায়, বাংলাদেশে জন্মহার ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে কম। ১৯৭১ সালে বর্তমান পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ছয় কোটি, আর বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি। এখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি, পাকিস্তানের ২০ কোটি।

নিকোলাস বলেছেন, বাংলাদেশ এখন সেই জনসম্পদকেই বেশি ব্যবহার করছে, যাদের কম কাজে লাগানো হয়। কেননা, তারাই বেশি উৎপাদনশীল। আমেরিকার জন্যও সেটি সত্য হতে পারে। আমরা আমাদের বিলিয়নিয়ারদের নিংড়ে খুব বেশি লাভবান হতে পারব না। কিন্তু আমরা সেই শিশুদের জন্য বিনিয়োগ করে অনেক বেশি লাভবান হতে পারি, যাদের প্রতি সাতজনের একজন হাইস্কুলের গণ্ডি পার হয়নি। নিকোলাসের শেষ মন্তব্য বাইডেনের এ শিশুকর ঋণ কর্মসূচি স্থায়ী করা উচিত, যা শিশু দারিদ্র্য কমাতে সহায়ক হবে। বাংলাদেশ আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, প্রান্তিক শিশুদের জন্য বিনিয়োগ কেবল ক্ষতিপূরণ নয়, এটি জাতির অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখতে পারে।

নিকোলাসের কলমে বাংলাদেশের যে সাফল্যের কাহিনি উঠে এসেছে, তার কৃতিত্ব দল, ব্যক্তি বা সরকারবিশেষের নয়। এর পেছনে আছে প্রতিটি সরকারের নারী শিক্ষাবান্ধব কর্মসূচি, যার সূচনা হয়েছিল খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে। তাঁর সরকার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা উপবৃত্তি চালু করে। পরবর্তীকালে শেখ হাসিনার সরকার সেই কর্মসূচিকে আরও প্রসারিত করে। অন্যদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবসম্পদ উন্নয়নে আরও অনেক বেসরকারি সংস্থা কাজ করেছে, যার উল্লেখ নিকোলাসের লেখায় নেই।

বাংলাদেশের এ গৌরবের পাশাপাশি কিছু অগৌরবের কাহিনিও আছে, যা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের আহত ও পীড়িত করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা যতটা সফলতা অর্জন করেছি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। এ ক্ষেত্রে পরের প্রতিটি সরকার আগের সরকারের রেকর্ড ভঙ্গ করে চলেছে। বিএনপির প্রথম সরকারের সঙ্গে দ্বিতীয় সরকার এবং আওয়ামী লীগের ২০০৯ সালের সরকারের সঙ্গে ২০২০ সালের সরকারের তুলনা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

সুইডেনের ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি (ভি-ডেম) ইনস্টিটিউট উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দেশের ওপর যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। ১৭৯টি দেশের মধ্যে ১৫৪তম। ভি-ডেমের মতে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশের অবস্থান উল্লেখযোগ্য হারে খারাপ হয়েছে। এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র বা ইলেকটোরাল অটোক্রেসি বলে অভিহিত করা হয়েছে। সরকারের যেসব বৈশিষ্ট্য স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা তৈরি করে, তা হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হুমকি ও গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ বেড়ে যাওয়া। সেই সঙ্গে আছে রাজনৈতিক বিরোধীদের অসম্মান করা, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো ও নির্বাচনকে হেয় করা। এর সব প্রবণতা বেশ ভালোভাবেই বাংলাদেশে আছে। প্রতিবেশীদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার পর। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্রিডম হাউস পরিচালিত গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সূচকেও বাংলাদেশের অবনতির কথা বলা হয়েছে। পাঁচ বছরে সূচক কমেছে ৮ পয়েন্ট।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর গণতন্ত্রের এ চিত্র আমাদের মোটেই স্বস্তি দেয় না। আমরা উন্নয়নে অন্যদের পথ দেখাচ্ছি। কিন্তু যে গণতন্ত্রের পথ ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছিল, সেই গণতন্ত্রই এখন পথহারা। অবস্থা এতটাই ভঙ্গুর যে কেবল বিএনপি নয়, একদা স্বৈরতন্ত্রের গর্ভে জন্ম নেওয়া জাতীয় পার্টির নেতারাও এখন গণতন্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগকে সবক দিয়ে যাচ্ছেন।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]