গণদেশত্যাগের ঝুঁকিতে তুরস্কের আর্মেনীয়রা

রয়টার্স ফাইল ছবি।

আজারবাইজানের মানচিত্রভুক্ত নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে গত ২৭ সেপ্টেম্বর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে নিজের পিতৃভূমি ইস্তাম্বুলে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছেন ইলেন। ইলেনের মা একজন ফরাসি এবং বাবা তুর্কি-আর্মেনীয়। ফ্রান্স ও তুরস্ক দুই দেশেই যাওয়া–আসার মধ্য দিয়ে ইলেন বড় হয়েছেন। তুরস্কে লেখাপড়া করেছেন এবং জাতিগতভাবে তাঁর বাবা আর্মেনীয় হওয়ায় তিনি নিজে আর্মেনীয় সংস্কৃতির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত।

ইলেন বর্তমানে ইস্তাম্বুলে একটি বহুজাতিক অফিসে পরামর্শক স্থপতি হিসেবে কাজ করছেন। এমনিতে তাঁর কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। তবে নাগোরনো–কারাবাখে যুদ্ধ লেগে যাওয়ার পর তিনি প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কারণ, তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা আর্মেনীয়দের শত্রু হিসেবে মনে করেন। তুরস্কের এরদোয়ান সরকার নাগোরনো-কারাবাখের আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর ক্ষেত্রে আজারবাইজানকে সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে। জাতীয়তাবাদী তুর্কিরা তাঁদের আচার–আচরণে আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে এতটাই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে যে ইস্তাম্বুল বা তুরস্কের অন্যান্য শহরের আর্মেনীয়রা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

ইলেন নামের যে নারী স্থপতির কথা বলছিলাম, তিনি আমাকে বললেন, ‘নাগোরনো-কারাবাখে লড়াই শুরু হওয়ার পর প্রথম দিকে আমরা বিষয়টিকে তেমন পাত্তা দিইনি। কয়েক বছর পরপর সেখানে জাতিগত অস্থিরতা দেখা দেয়, আবার দু–এক দিনের মধ্যে তা শান্তও হয়ে যায়। কিন্তু এবার যে অবস্থা দেখা দিয়েছে, তা নজিরবিহীন।’

নাগোরনো-কারাবাখের সবচেয়ে বড় শহর স্তেপানাকার্তে প্রথম এক সপ্তাহ ধরে লাগাতার বোমা পড়েছে। এই সময়ের মধ্যে আজারবাইজানকে সর্বাত্মক সাহায্য দিচ্ছে তুরস্ক। তুর্কি ও আজেরি জাতীয়তাবাদীরা রাস্তায় নেমে আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে ঘৃণাসূচক স্লোগান দিচ্ছেন। রাস্তায় তাঁরা দল বেঁধে গাড়ি নিয়ে একটানা হর্ন দিচ্ছেন। ইলেন বলেছেন, ‘তুরস্কের সংখ্যালঘু আর্মেনীয়রা এই যুদ্ধের ওজন অনুভব করতে পারছেন এবং আমার কথা যদি বলেন, তাহলে বলতে পারি আমি প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্যে আছি।’

গত আড়াই সপ্তাহে পাঁচ শ জনের বেশি আর্মেনীয় সেনা নিহত হয়েছে। তবে কতজন আজেরি সেনা নিহত হয়েছে, তার তথ্য আজারবাইজানের পক্ষ থেকে কঠোরভাবে গোপন করা হচ্ছে। এর বাইরে উভয় পক্ষের বহু বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে।

তুরস্কের কট্টর ডানপন্থী সংগঠন গ্যারি উলভসের সদস্যরা নিয়মিত আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছেন। ইস্তাম্বুলের ওসমানবে এলাকায় আর্মেনীয়দের যে ঐতিহাসিক পল্লি আছে, সেখানে তাঁরা মিছিল করছেন। ওসমানবে এলাকার হালাস্ক রাজি অ্যাভিনিউতে একটি বাড়িতে ইলেন থাকেন। ইলেন বলেছেন, ‘কয়েক দিন আগে গ্রে উলভসের সদস্যরা আমাদের এখানে যেভাবে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে আর্মেনীয়বিরোধী মিছিল করছিলেন, তা দেখে আমি আমার বিড়াল, ল্যাপটপ ও কয়েকটা কাপড় নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে চলে এসেছি। আমার মনে হচ্ছিল যেকোনো মুহূর্তে জাতিগত দাঙ্গা শুরু হয়ে যেতে পারে। আমার নিজেকে একটা ইঁদুরের মতো মনে হচ্ছিল।’

তবে সবচেয়ে বড় চিন্তার কথা হলো তুরস্কে ইলেনের মতো বেশির ভাগ আর্মেনীয়র মনে যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, তা আর্মেনীয়দের গণদেশত্যাগে বাধ্য করতে পারে। এরদোয়ান সরকার যদি এখনই আর্মেনীয়দের নিরাপত্তায় মনোযোগ না দেয়, তাহলে সে ধরনের ঘটনা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।

কুর্দি ও আলেভির মতো মুসলিম সংখ্যালঘুরা তুরস্কে সংখ্যাগুরু সুন্নি মুসলমানদের সঙ্গে কার্যত মিশে গিয়ে জীবন কাটায়। কিন্তু আর্মেনীয়, গ্রিক অর্থোডক্স ও ইহুদিরা সেটি করতে পারে না। ফলে এই তিন সম্প্রদায়ের লোক সবচেয়ে বেশি কোণঠাসা হয়ে থাকতে বাধ্য হয়।

কয়েক দিন আগে গাসবার নামের একজন তুর্কি-আর্মেনীয় লন্ডন থেকে ইস্তাম্বুলে চলে এসেছেন। গাসবার আমাকে বললেন, ইস্তাম্বুলে তাঁর মা–বাবা থাকেন। নাগোরনো-কারাবাখে লড়াই লাগার পর তিনি মা–বাবার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। এ কারণে তিনি মা–বাবাকে লন্ডনে নিয়ে যেতে এসেছেন।

জাতিগতভাবে যিনি আর্মেনীয়, তিনি যদি আর্মেনিয়ায় যান এবং সেখানে বাস করতে চান, সে ক্ষেত্রে আর্মেনিয়া তাঁকে বিনা প্রশ্নে নাগরিকত্ব দিয়ে থাকে। তুরস্কের আর্মেনীয়রা সেই সুযোগ নিতে বাধ্য হবে কি না, এখন সে রকম আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

লরা মায়ি গাভেরিয়া: ফরাসি সাংবাদিক ও লেখক