গণমাধ্যমের বড় বিপদ যখন ভুয়া সংবাদ

জার্মানির বন শহরে গত ১৯ থেকে ২১ জুন আসর বসেছিল গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামের
জার্মানির বন শহরে গত ১৯ থেকে ২১ জুন আসর বসেছিল গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামের

বট কথাটি আমাদের অতিচেনা। বটবৃক্ষ শব্দটি আমরা প্রায় উঠতে-বসতে ব্যবহার করি। কিন্তু এই ‘বট’-এর প্রতি এখন থেকে আমাদের খুব সন্দেহ বা সতর্কতায় চোখ রাখতে কিংবা একে নতুন করে চিনতে ও বুঝতে শিখতে হবে। আর সেটা খুব আঁচ করি সম্প্রতি যখন হাজির হই আঙ্গেলা ম্যার্কেলের দেশে।

আঙ্গেলা ম্যার্কেল, যিনি ইসলামের নামে আইএসের ভয়ংকর সন্ত্রাস এবং ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামভীতির এক জটিল ও কণ্টকিত বিশ্বব্যবস্থায় একসঙ্গে ১০ লাখের বেশি সিরীয় মুসলিম উদ্বাস্তুকে সম্মানিত অভিবাসী হিসেবে বরণ করে নেওয়ায় এক অবিস্মরণীয় নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁর সরকারের উদ্যোগেই গত ১৯ থেকে ২১ জুন বন শহরে আসর বসেছিল গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামের। অবশ্য এটাই প্রথম নয়। এবার হলো ১০ বছর পূর্তি। শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সংঘাত প্রতিরোধ (২০০৮), মানবাধিকার ও বিশ্বায়ন (২০১১), একটি টেকসই বিশ্বের রূপায়ণে সংস্কৃতি, শিক্ষা ও মিডিয়া (২০১২) এ ধরনের থিমের পর এবার ১০ বছর পূর্তির থিম ছিল ‘পরিচিতি ও বৈচিত্র্য’। তবে সবকিছু ছাপিয়ে পোস্ট ট্রুথ এরা বা সত্য-পরবর্তী যুগ (তথ্যের চেয়ে আবেগের প্রাধান্য) হিসেবে বর্তমান সময়কে বিশেষজ্ঞরা যেভাবে চিহ্নিত করেছেন, সেখানে রাজনীতির অঙ্গন ও সামাজিক মিডিয়ায় ছড়ানো ভুয়া সংবাদ কী ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে এবং তা থেকে পাঠককে কী করে রেহাই দেওয়া যায়, সেসব বিষয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা হয়েছে। এটাই স্বীকৃত হয়েছে যে মিডিয়া, তা সেটা সনাতনী বা সামাজিক ডিজিটাল যা-ই হোক, কোনোভাবেই কোনো একটি দেশের সীমান্ত দিয়ে তাকে সীমিত করার চেষ্টা বৃথা।

আমরা বহু আগেই পোস্ট ট্রুথ যুগে ঢুকে গেছি এবং সেখানেই ঘুরপাক খাচ্ছি কি না, সেই প্রশ্নটা আমাদের আন্দোলিত করে। এর একটি লক্ষণ পরিষ্কার, ইতিহাসচর্চায় রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাকেই সব থেকে বেশি জোর দেওয়া। তথ্যনিষ্ঠ থাকার প্রতি সব থেকে কম আগ্রহ। কী রাজনীতি, কী অর্থনীতি, কী বিদেশনীতি—সর্বদা সবচেয়ে বেশি আগ্রহ আবেগকে প্রাধান্য দেওয়ার। আর সেই আবেগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে। যদিও ভয়েস অব আমেরিকার একজন জ্যেষ্ঠ নারী সাংবাদিক ‘পোস্ট ট্রুথ এরা’ (সত্য-পরবর্তী যুগ) পরিভাষাটির বিরোধিতা করেন। তাঁর যুক্তি হচ্ছে সত্য চিরন্তন, কালজয়ী। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কদর আগেও ছিল, এখনো আছে। তবে আমার বিবেচনায় সার্বিক বিচারে বাংলাদেশে এখন যা চলছে, তাকে পোস্ট ট্রুথ যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা চলে।

আসলে ম্যার্কেল প্রশাসন সত্যিই বিবেচনায় নিয়েছে যে নিজেরা আলাদাভাবে ভালো ও নিরাপদ থাকা যাবে না। সবাইকে নিয়েই নিরাপদে থাকতে হবে। ইন্টারনেটহীন বিশ্বে দরিদ্র ও নিরক্ষর লোকদের কোনোই কণ্ঠ ছিল না। ইন্টারনেট, মুঠোফোন বিশ্বের ৮৫ কোটিনিরক্ষরকে নতুন এক কণ্ঠ দিয়েছে। জার্মানরা স্মরণে রেখেছে যে বিশ্ব শাসনে এই নবাগত অথচ অবিসংবাদিত ও অপ্রতিরোধ্য অংশীজনদের অগ্রাহ্য করা যাবে না।

রাষ্ট্র বা সরকারনিয়ন্ত্রিত মিডিয়া বলতে আমাদের যে ধারণা, জার্মান বেতার ডয়চে ভেলে তা নয়, তারা যথেষ্ট কার্যকর স্বাধীনতা ভোগ করে। এর বাজেট সংকুলান হয় জনগণের করের টাকায়। যাহোক, আপাতত তিনটি নতুন পরিভাষা সম্পর্কে জনগণকে চটজলদি শিক্ষিত ও সচেতন হতে হবে। টুইটারবটস, চ্যাটবটস ও গুগলবটস। বট প্রধানত একটি ‘সফটওয়্যার রোবট ডিভাইস’। ইন্টারনেট বট মানে এমন একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। তবে ‘বট’ নিজেই একটি নেতিবাচক বা ক্ষতিকর বিষয় নয়। যেমন এখন জানা যাচ্ছে, লাইক বা টুইটারে অনুসারীদের যে সংখ্যা আমরা খালি চোখে দেখি বা শুনি, সেটা ভুয়া হতে পরে। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় এমন টুইট দেখা গেছে, মনে হয়েছে ট্রাম্প নিজেই ভক্তদের টুইটের উত্তর দিচ্ছেন, আসলে তিনি নন, দিয়েছে কোনো বট সফটওয়্যার। আবার দুজন সাংবাদিক এমনভাবে বট ব্যবহার করেছেন, যাতে তাঁদের কাছে ‘ইলিগ্যাল ইমিগ্র্যান্ট’ লেখা কোনো মেইল পৌঁছালে সেখানে তাঁদের তরফে ফিরতি মেইল যাবে, ইলিগ্যাল বলা সঠিক নয়, এটা হবে আনডকুমেন্টেড মাইগ্র্যান্ট। কারণ তাঁদের যুক্তি, মানুষ কখনো অবৈধ হয় না। গুগলবটকে বলা হয় একটি মাকড়সা ওয়েব। এটা মাসে একবার বা প্রায় প্রতিদিন সক্রিয় হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দরকারি তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্ক্যান করতে পারে। তো কথা হলো আমরা যে সংবাদ জগৎকে চিনতাম, সেটা জটিলভাবে বদলাচ্ছে, আরও বদলাবে।

আলোচনায় যে কথাটি গুরুত্ব পেয়েছে সেটি হলো সাংবাদিকেরা যদি উপযুক্ত বট ব্যবহার করা শুরু করেন, তাহলে তা মিডিয়ার ওপর একটি অসামান্য গঠনমূলক প্রভাব তৈরি করবে। বটকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে সতর্ক ও বুদ্ধিদীপ্ত করা, তথ্যের সমন্বয় সাধন করা এবং মনিটরিং করাই হবে ভবিষ্যতের ব্লগিং এবং ডিজিটাল সাংবাদিকতার প্রাণ। প্রশ্ন উঠেছে, মানব সাংবাদিকেরা কি তবে বটের মতো পুরোপুরি কৃত্রিম কিছু ডিভাইস দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবেন? এর উত্তর অবশ্যই না। সত্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদা আরও বেশি বাড়বে। দেশে যেভাবে ডিজিটাল মিডিয়ার বিস্তার ঘটছে এবং আমাদের প্রবাসী নাগরিকেরা যেভাবে ডিজিটাল বা সামাজিক মিডিয়া ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন, তাতে আমরা আশাবাদী হতে পারি। শঙ্কার জায়গা যেটা আছে, সেটা দূর করতে এখন থেকেই মিডিয়া লিটারেসি বা গণমাধ্যম–সংক্রান্ত নানা কারিগরি (বটের মতো) দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতেহবে।

কোনো সন্দেহ নেই ইন্টারনেট এসে মিথ্যা, ঘৃণা-বিদ্বেষ বহুমাত্রায় বিস্তার ঘটিয়ে চলছে। আগে মিথ্যা খবরের উত্সগুলো চিহ্নিত ছিল কিংবা অনেকটাই জানাবোঝার মধ্যে ছিল। কিন্তু এখন তা নেই। আর সেখানে বট কী করছে এবং ভবিষ্যতে কী করবে, তা আমরা ধারণা করতেও পারছি না। অনেকে বট অপব্যবহার করছেন এমনভাবে, যাতে মনে হবে বটের কাজই হলো চারপাশে বিপুল পরিমাণে মিথ্যা খবর ছড়ানো, নিউইয়র্ক টাইমসকে এ কথা বলেছেন অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের সমাজবিদ ফিলিপ এন হাওয়ার্ড। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় এই বট ব্যবহার করা হয়েছিল এবং তা সামাজিক মিডিয়ায় আগ্রাসন চালিয়েছিল। ধরে নেওয়াই ভালো, এই কারিগরি আগ্রাসন ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে অনুপ্রবেশ করার বিষয়টি একদিন দেশে দেশে ‘চিকুনগুনিয়ার’ মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে। সে জন্য গুণগত মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা ও প্রশিক্ষণে বিপুল বিনিয়োগ দরকার। আমাদের দক্ষ ডিজিটাল মিডিয়াকর্মী দরকার, কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকোচনের যে নীতি চলছে, তা বটবিশ্বের বাস্তবতা, বিপদ ও সম্ভাবনা সম্পর্কে সবার সচেতনতা আছে বলে ইঙ্গিত দেয় না।

গত ৩০ মে নিউজউইক বলেছে, ট্রাম্পের টুইটার অনুসারীদের প্রায় অর্ধেকই ছিল ভুয়া অ্যাকাউন্টধারী। সেসব ছিল বটের কারসাজি। ট্রাম্পের প্রচারণায় অশুভ উপায়ে বট ব্যবহারে উন্নত বিশ্বের যাঁরা সতর্ক ছিলেন, তাঁরাও বিভ্রান্ত হয়েছেন। কারণ, ব্যাপকতা ও দ্রুতগতির সঙ্গে তাঁরাও পেরে ওঠেননি। কারও মতে, ২০০৪ সালের মার্কিন নির্বাচন বা তারও আগে থেকে বট ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প ও পুতিন জমানায় এসে এটা বিশ্বব্যাপী ঝড় তুলল। আমরা এখন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব বিষয়কে হুমকি মনে করছি, সেখানে ভবিষ্যতে যুক্ত হতে পারে এই বট। গণতন্ত্রপন্থী নেতা ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাঁখো, জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে বৈরী বিদেশি নেটওয়ার্ক, এমনকি নানা গুপ্তচর গোষ্ঠী সক্রিয় থেকেছে।

আমি অন্য আরও অনেকের সঙ্গে জার্মান ফেডারেল ফরেন অফিসের অন্যতম অতিথি হিসেবেএতে অংশ নিই। সরকারের অতিথি হওয়ার মধ্যে কখনো একটা অস্বস্তি দানা বাঁধে। কারণ, অহর্নিশ একটা সংশয় ঘুরপাক খায়, এই বুঝি বাক্‌স্বাধীনতায় তার একটা ছাপ পড়ে গেল। কিন্তু সম্মেলন শুরু হতে না হতেই সেই সংশয়ের চাদর ফিকে হলো, তার জায়গায় জায়গা করে নিল একটা উপলব্ধি। আর সেটা হলো জার্মান জাতি বাক্‌স্বাধীনতাকে তাদের উন্নয়ন-দর্শনের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে নিয়েছে। বাক্‌স্বাধীনতা, সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা জার্মান গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামো। সে কারণেই ট্রাম্প যখন স্বাধীন মিডিয়াকে কটাক্ষ করতে ‘ভুয়া নিউজ মার্কিন জনগণের শত্রু’ বলে মন্তব্য করেছিলেন, তখন মুক্তবিশ্বের নেত্রী ম্যার্কেল মিউনিখ সফররত মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের উপস্থিতিতে বলেছিলেন, তিনি একটি অবাধ ও স্বাধীন মিডিয়ায় বিশ্বাসী। জার্মান সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর রয়েছে পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক। একটি শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে তারা এটাও বুঝে নিয়েছে, শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়তে বাক্‌স্বাধীনতার বিকল্প নেই। আর এটা কোনোভাবেই একটি সীমান্তভিত্তিক কোনো বিচ্ছিন্ন ধারণা নয়, এটা সর্বজনীন।

আমরা মানি আর না মানি, আমাদের চেনা বিশ্ব আর বিশ্ব নেই। এটা বটবিশ্বে পরিণত হয়েছে। এই বটবিশ্বের একটা ধেয়ে আসা যন্ত্রণা হলো কোনটা সত্য, কোনটা ভুয়া, সে বিষয়ে বহুগুণে বেশি হুঁশিয়ার থাকতে হবে। আগে আমরা উন্নয়নশীল বা তৃতীয় বিশ্বের লোকেরা কারণে-অকারণে বাতিকগ্রস্ত ছিলাম যে সিএনএন, বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি ইত্যাদি বিশ্বকে যেভাবে আমাদের সামনে হাজির করে, সেই বিশ্বকে আমাদের দেখতে হয়। সেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হয়। কিন্তু সে যুগ বাসি হয়ে গেছে। কারণ, ওই সংবাদ সংস্থাগুলোও বটবিশ্বের প্রভাবের বাইরে যেতে পারছে না। এ কারণে তিন দিনের সম্মেলনের প্রধান আকর্ষণীয় আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল পোস্ট ট্রুথ এবং ভুয়া সংবাদ। আমি আর আগের বিশ্বে থাকি না। এখন বটবিশ্বের বাসিন্দা। কিন্তু বটবিশ্বের সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের তৈরি করে নিতে হবে। এটা অবশ্যই শুরু করবেন মিডিয়ার কর্মীরা। জেফারসন একদা মিডিয়াকে চতুর্থ স্তম্ভের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এখন সম্ভবত সময় এসেছে এটা ভাবা যে মিডিয়াই প্রথম স্তম্ভ এবং সেটা ভাবতে হবে বৈশ্বিক মাত্রায়, কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় সীমানা তার জন্য আর প্রযোজ্য বা প্রাসঙ্গিক নয়। আর সেই বিশ্বে মানবজাতির অভিন্ন শত্রু ভুয়া সংবাদ।

ডয়চে ভেলের মহাপরিচালক পিটার লিমবুর্গ তাঁর বক্তৃতায় ভুয়া সংবাদ ছাড়া আরেকটি বিষয়কে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। সেটি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আরও বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। তাঁর বর্ণনায় সেটি ‘আনহেলদি ন্যাশনালিজম’ বা অস্বাস্থ্যকর জাতীয়তাবাদ। আমাদের দেশের পোস্ট ট্রুথ পলিটিকসে এই বিষয়টি গোদের উপর বিষফোড়ার সৃষ্টি করেছে।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷