গণি মিয়া ও নগরের অগণিত গরিব গণগাড়ি

গণপরিবহনে হাফ ভাড়ার দাবিতে রাস্তায় শিক্ষার্থীরা
ছবি: প্রথম আলো

গরিব চাষি হিসেবে গণি মিয়া একজন সুপারস্টার পর্যায়ের সেলিব্রিটি। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, পয়সাকড়ির দিক দিয়ে বেচারার মারাত্মক কাহিল দশা। তাঁর নিজের জমিজমা নাই। তিনি অন্যের জমি চাষবাস করেন। ধান–পান যা হয়, তার অর্ধেক যায় মালিকের গোলায়। ভাগের ফসলাদি দিয়ে সংসার চলে না। পরীক্ষার খাতায় এই ভদ্রলোকের কষ্টের কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করে করে সেই কত বছর ধরে লাখোকোটি ছেলেপেলে পাস করে চিকিৎসক-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গাড়িঘোড়া দাপিয়ে বেড়াল। কিন্তু বইয়ের সেই গণি মিয়ার গরিবি গেল না।

গৌরবের কথা, বাস্তবের গাঁওগেরামের অগণিত গণি মিয়া এখন নগরে এসে গণপরিবহনের মালিক হয়েছেন। আফসোসের কথা, বাসমালিক গণি মিয়াদের বউ–ঝিদের গলায় ভরি ভরি ভারী গয়না উঠলেও গগনবিস্তারি গরিবি তাঁদের পিছু ছাড়েনি।

এই যে ঢাকা নগরে হাজারে হাজারে বাস যায় বাস আসে, সেই বাসের যাত্রীর সঙ্গে চিটিং করে সিটিং ভাড়ার নামে বাড়তি টাকা ফিটিং করা হয়। তারপরও বাসের মালিকদের ৮০ শতাংশই গণি মিয়ার মতো গরিব। মাত্র ২০ শতাংশ মালিক গরিবি হালতের বাইরে। এটা কোনো যদু–মধুর কথার কথা না। এ কথা বলেছেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ।

ছাত্রছাত্রীদের জন্য হাফ ভাড়া ঠিক করা নিয়ে গত শনিবার (২৭ নভেম্বর) বিআরটিএ এবং পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধির বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকে বাসমালিকদের টানাটানির সংসারের একটি হৃদয়বিদারক চিত্র তুলে ধরেছেন এনায়েত উল্যাহ। সেখানে তিনি বলেছেন, ঢাকা শহরে চলাচলকারী বাসের মালিকদের ৮০ শতাংশই গরিব। তিনি বলেছেন, ‘একটি বাস দিয়ে নিজের সংসার চালায় কেউ কেউ। (ছাত্রছাত্রীরা হাফ ভাড়া দিলে) তারা কীভাবে এই ক্ষতি সামলাবে?’ বাসমালিকদের দারিদ্র্যপীড়িত গরিবি জীবনের সেই প্রামাণ্য অশ্রুসজল সামাজিক বর্ণনার চোটে সেখানকার বাতাস ভারী হওয়ার একটা বিকট আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।

গরিববান্ধব সরকারের সঙ্গে গরিব বাসমালিক নেতাদের বৈঠকের পর বাসভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা এল। এরপরই পথে বাস নামল। কিন্তু চির–গরিবের অনন্ত গরিবি তাতে কাটল না। দেখা গেল, ভুল করে বেঁধে দেওয়া ভাড়ার কথা ভুলে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে সর্বনিম্ন ৩০ এবং সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বেশি।

কয়েক দিন আগে সরকার ডিজেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ডিজেলের দাম কত বাড়বে, তা নিয়ে সরকার গেজেট প্রকাশের আগেই কোনোরকম নোটিশ ছাড়াই দু–তিন দিন মালিকদের বাধ্য হয়ে সব বাস বন্ধ রাখতে হয়েছিল। যেসব বাস সিএনজিতে চলে, সেগুলোর মালিকেরা ‘আমার চক্ষে ডিজেল–সিএনজিতে কোনো ভেদাভেদ নাই’ বলে তাঁদের বাসও বন্ধ রেখেছিলেন। সেই দু–তিন দিন বাস বন্ধ থাকায় গরিব বাস মালিকদের অনেককে হয়তো ছেলেপুলে নিয়ে অনাহারে–অর্ধাহারে থাকতে হয়েছিল। তাঁদের সেই মহান আত্মত্যাগ ও ধর্ম স্থাপনার্থে পাতা ঘটের কল্যাণে ওই দু–তিন দিন দেশবাসী, বিশেষ করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত লোকেরা ইবনে বতুতার মতো পদব্রজে মাইলের পর মাইল পাড়ি দেওয়ার অবারিত সুযোগ পেয়েছিলেন। পাবলিককে প্রীতি উপহার হিসেবে তাঁদের দেওয়া সেই হাঁটাবান্ধব দিনগুলোর কথা ডায়াবেটিক সমিতির সদস্যরাসহ গোটা জাতি বহু দিন মনে রাখবে।

গরিববান্ধব সরকারের সঙ্গে গরিব বাসমালিক নেতাদের বৈঠকের পর বাসভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা এল। এরপরই পথে বাস নামল। কিন্তু চির–গরিবের অনন্ত গরিবি তাতে কাটল না। দেখা গেল, ভুল করে বেঁধে দেওয়া ভাড়ার কথা ভুলে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে সর্বনিম্ন ৩০ এবং সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বেশি।

চুপচাপ করে এভাবে চললে বাসমালিকদের গরিবি যাহোক একটা টলারেন্স লেভেলে থাকত। কিন্তু কিছু না-বুঝ, নাবেলেগ, নালায়েক ছাত্রপাত্র হুট করে হাফ ভাড়ার দাবি তুলে বসল। আরে বাবারা! হাফ ভাড়া দিলে গরিব মালিকদের যে বাসের বদলে থালা নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে, সেটা তোরা বুঝবি না!

বাসের ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, হেলপার—সবাই তো ঠিকই গরিব মালিকদের কষ্ট বোঝেন। মালিকেরা ভাড়া বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে এই স্টাফদের বেতনকড়ির একটা লিষ্টি সরকারের হাতে দিয়ে থাকেন। সরকারের খাতায় লেখা থাকে, বাসের মালিকেরা ড্রাইভারকে এত টাকা, কন্ডাক্টরকে এত টাকা এবং হেলপারকে এত টাকা বেতন দেন। তাঁদের সেই বিশাল ব্যায়ের ফিরিস্তি দেখেই তো সরকার ভাড়া বাড়িয়েছে। কিন্তু খাতাপত্রে যা–ই লেখা থাক, আদতে এই স্টাফদের বেশির ভাগই বেতন নেন না। তাঁরা গরিব মালিকদের কষ্টকে নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়ে মালিকদের সঙ্গে দিনের ভাড়ার চুক্তিতে যান। দিন শেষে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দেওয়ার শর্তে বাস নিয়ে পথে নামেন। সারাদিনে আয়–রোজগার হোক বা না হোক, দিন শেষে সেই নির্দিষ্ট টাকা মালিকদের পরিশোধ করেন।

মালিকদের গরিবি নিয়ে ড্রাইভার-হেলপারদের যতটুকু মানবিক সংবেদনশীলতা আছে, হতচ্ছাড়া ছাত্রছাত্রীদের তা-ও নেই। তারা বুঝতে পারছে না তারা ভাড়া হাফ দিলে স্টাফদের আয় কম হবে। স্টাফদের আয় কম হলে মালিকদের তাঁরা আগের মতো টাকা দিতে পারবেন না। এতে মালিকদের হাতে দুটো বাড়তি পয়সা দান হিসেবে তুলে দেওয়ার পুন্যি কামানোর সুযোগ থেকে বেচারা স্টাফরা বঞ্চিত হবেন—এমন মহান বিবেচনা থেকেই তো বাসমালিকেরা হাফ ভাড়ার দাবি মানতে চাইছেন না। এই সহজ বিষয়টি বোঝার মতো মানবিক মূল্যবোধ ছাত্রছাত্রীদের থাকবে না!

সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবিষয়ক বেশ কিছু কার্যক্রম আছে। সেগুলোতে এই ৮০ শতাংশ বাসমালিকের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেমন সরকার ৫০ লাখ দুস্থ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ দেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে তাঁদের নাম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যোগ করা যেতে পারে।

এনায়েত উল্যাহ সাহেব বৈঠকে সাফ–সাফ বলে দিয়েছেন, ‘হাফ ভাড়া নেওয়া হলে সরকার কীভাবে বাসমালিকদের ক্ষতি পোষাবে, আগে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

খুবই বিবেচনার কথা। গরিব বাসমালিকদের কী হবে, তা ঠিক না করেই ছাত্রছাত্রীরা ভাড়া অর্ধেক করতে বলছে। এমন মামাবাড়ির আবদার তো দাদাবাড়িতে চলতে পারে না।

বাসমালিকেরা বলেছেন, অর্ধেক ভাড়া যদি ছাত্রদের মওকুফ করতেই হয়, তাহলে বাসমালিকদের জন্য আগে ভর্তুকি নিশ্চিত করতে হবে। এর আগে কোনো ফয়সালা হবে না। দিন কয়েক আগে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোয় গরিবি সামান্য একটু কমেছে, এখন ভর্তুকি হিসেবে আরও ৩০-৪০ শতাংশ অর্থ দিলে মালিকদের দুটো ডালভাত খেয়ে বেঁচে থাকার একটা কায়দা হয়।

হাফ ভাড়া চালু হলে সেই সুবিধা পাওয়ার জন্য ঢাকা শহরের সব যাত্রী ছাত্র অথবা ছাত্রী বনে যেতে পারে, এমন একটা আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে এনায়েত উল্যাহ সাহেব বলেছেন, ‘বাসে উঠে সবাই বলবে আমরা ছাত্র। অনেকে এ সুবিধা নেওয়ার জন্য আইডি কার্ড বানিয়ে নিতে পারে। সরকার এর সমাধান কীভাবে করবে, সেটাও দেখতে হবে।’ অর্থাৎ ছাত্র পরিচয়ের জন্য আইডি কার্ড যথেষ্ট হবে না। কে ছাত্র আর কে নয়, সেটিও সরকারকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে সুরাহা করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে ঢাকা শহরের সব ছাত্র–ছাত্রীর আইডি কার্ড ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তাঁরা একটি টাস্কফোর্স গঠন করে শিক্ষার্থীদের বাপ–দাদা চৌদ্দগুষ্টির বিষয়ে খোঁজ নিতে করতে পারে এবং তারপর সেই আইডি কার্ডে ‘সত্যায়িত’ সিল দিয়ে দিতে পারে। এতে অছাত্র কেউ হাফ ভাড়া দিয়ে গরিব মালিকদের পেটে লাথি মারতে পারবে না।

তবে শুধু ভাড়া বাড়ানো ও ভর্তুকি দিয়ে মালিকদের গরিবি পুরোপুরি কাটানো যাবে বলে মনে হয় না। এ জন্য কিছু সম্পূরক পদক্ষেপ নিতে হবে।

সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবিষয়ক বেশ কিছু কার্যক্রম আছে। সেগুলোতে এই ৮০ শতাংশ বাসমালিকের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেমন সরকার ৫০ লাখ দুস্থ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ দেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে তাঁদের নাম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যোগ করা যেতে পারে। গরিব মানুষের জন্য সরকার ট্রাকে করে টিসিবির পণ্য সরবরাহের যে ব্যবস্থা রেখেছে, সেখানে লাইন ছাড়াই তাঁরা যাতে চাল–ডাল কিনতে পারেন, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এর বাইরে কাবিখা-কাবিটা প্রকল্পের কিছু সুবিধাও যদি রাখা যায়, তাহলে তাদের গরিবি কিছুটা লাঘব হতে পারে।

গতকাল জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা জি এম কাদের প্রশ্ন রেখেছিলেন, পরিবহন খাত আসলে কে নিয়ন্ত্রণ করছে? সরকার নাকি মালিক ও শ্রমিক সমিতিগুলো? সরকারের কর্তাব্যক্তিরা কি এ খাতের নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করছেন?

জি এম কাদের যখন এ বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর পাশেই ছিলেন তাঁরই দলের নেতা ও পরিবহনমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান। এ সময় মসিউরকে মধ্যবিত্ত এনজিও-পুষ্ট সুশীল গরিবি মুখে মুচকি মুচকি হাসতে দেখা গেছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউস ছাড়ার আগে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি নিয়ে একটি বৈঠক করেছিলেন। সেখানে ফিলিস্তিনিদের কিসে কিসে ভালো হবে, তা নিয়ে হোয়াইট হাউসে আলোচনা হয়েছিল। সেই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অনেক দেশ ও সংগঠনের প্রতিনিধিকে রাখা হয়েছিল। শুধু যাঁদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, সেই ফিলিস্তিনিদেরই রাখা হয়নি। ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু হয়তো ভেবেছিলেন, ফিলিস্তিনিরা বোধে খাটো, তাঁদের খালি খালি মিটিংয়ে ডেকে কাজ নেই। তাঁদের বিষয়ে ‘বড়রা’ই সিদ্ধান্ত নিক।

সেই একই তরিকা দেখা গেল বিআরটিএ এবং পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের বৈঠকে। সেখানে ছাত্রছাত্রীদের ভাড়া নিয়ে কথা হচ্ছিল। কিন্তু সেই ছাত্রছাত্রীদেরই কোনো প্রতিনিধি সেখানে ছিল না।

বিশ্বব্যাংকের ‘পভার্টি অ্যান্ড শেয়ার প্রসপারিটি বা দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধির অংশীদার-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, গরিব মানুষের বসবাসে বিশ্বে পঞ্চম বাংলাদেশ। অন্যদিকে অতিধনী বৃদ্ধির হারেও একেবারে প্রথম সারিতে বাংলাদেশ। অতিধনী বাড়াতেও আমরা প্রথম দিকে, অতিগরিবিতেও প্রথম দিকে। মানে আমরা ধাওয়ারও আগে, দৌড়ানোরও আগে।

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ‘গরিবি হটাও’ স্লোগান দিয়েছিলেন। আমাদের সরকার ও মন্ত্রীরা মনে হচ্ছে সেই মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছেন এবং গরিবি হটানোর অভিযান বাসমালিকদের দিয়ে শুরু করেছেন। এ অবস্থা দেখে গরিবি হটছে না। হটছে আসল গরিব। কী ‘আচানক’ বিষয়!

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]