গরিবতম জেলার গরিবতম উপজেলায় ট্রেন আসে না

করোনা পরবর্তী সবগুলো ট্রেন চলাচল শুরু হলেও এখনো বন্ধ রমনা লোকাল ট্রেনটি

করোনার কারণে সেই ১৯-২০ মাস আগে রমনা লোকাল ট্রেনটি বন্ধ হয়েছে। তারপর সারা দেশের সব রুটে লোকাল ট্রেন চলছে। নতুন ট্রেনও উদ্বোধন হলো, কিন্তু গরিবতম জেলার গরিবতম উপজেলার রুটে আর ট্রেন আসে না। এখানকার জনগণ বেশি দামে পণ্য কিনুক আর স্থানীয় পণ্য পানির দরে বেচুক। তবু কুড়িগ্রামের প্রতি নাকি সবার বাড়তি দরদ!

কুড়িগ্রাম-রমনাবাজার সেকশনের সার্ভে করা হয় ২০২০ সালের জুন-জুলাইয়ে। রাজশাহী পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী কর্তৃক নকশাটি অনুমোদিত হয় একই সালের ২৫ অক্টোবর। ৬৮ কিলোমিটার রেললাইন আনতে আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্প থেকে ৭৫ পাউন্ড গড় ওজনের পাতের অনুমোদন দেন ডিজি তারও আগে একই সালের ৮ জুলাই। লালমনিরহাট ডিইএন দপ্তর থেকে দ্বিতীয় দফা ও শেষ দফা বাজেট পাঠানো হয় ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর ও ২০২১ সালের ১১ আগস্ট, এখনো কাজটি ফাইলবন্দী। সচিবেরা চান এমপিদের ডিও লেটার। এমপিরা জানান, তাঁরা বৈদ্যুতিক ট্রেন চেয়ে ডিও লেটার দিয়েছেন। এদিকে জনগণ বন্ধ থাকা লোকাল মেইলটিই পায় না।

মুজিব বর্ষ উপলক্ষে পশ্চিমাঞ্চল রেলের ১৯ জেলার ২৬টি স্টেশনের উন্নয়নকাজ চলমান, তার মধ্যে রংপুর বিভাগের ৭টি জেলা আছে, নেই শুধু কুড়িগ্রাম। উল্লেখ্য, মুজিব বর্ষের আগেই ২০১২-১৪ সালে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও স্টেশন দ্বিতল ও রেললাইন সংস্কার করা হয়েছিল। দিনাজপুর সদর, পার্বতীপুর ও বিরামপুর স্টেশন তিনটি ২০১২-১৪ সালে ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক করা হয়। তেমনিভাবে নীলফামারী জেলার সদর, সৈয়দপুর ও ডোমার স্টেশন ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক করা হয়। রংপুর ও লালমনিরহাট স্টেশন ২০০৬ সালেই দ্বিতল ও প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ করা হয়। গাইবান্ধার সদর ও বোনারপাড়াও একই সালে দ্বিতল ও আধুনিক হয়। যশোরেও একই সালে তা–ই। ২০১৭-১৮ সালে ৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুনভাবে সজ্জিত হয়। মুজিব বর্ষেও নতুন করে হচ্ছে। বাদ শুধু কুড়িগ্রামের স্টেশনগুলো। কুড়িগ্রামে রেলের জায়গা প্রভাবশালীরা দখলে রাখুক। বন্দর পর্যন্ত রেলের জায়গায় প্রভাবশালীরা পুকুর ও অবৈধ বালুর পাহাড় বানিয়ে রাখুক। চিলমারী নদীবন্দর দিন শেষে ব্যর্থ হোক। কুড়িগ্রামের জনগণ দারিদ্র্যের শীর্ষে থাকুক।

ট্রেনের জন্য গণসমাবেশসহ এহেন কর্মসূচি নেই, যা কুড়িগ্রামে পালিত হয়নি। ট্রেনের দাবিতে লাখ লোকের গণস্বাক্ষর প্রধানমন্ত্রী বরাবর জমা দিয়েও কুড়িগ্রামবাসী ট্রেন চায়নি! গণ–উদ্যোগকে ব্যর্থ করার কী নিদান! সব তাঁরাই করেন।

২.

‘কারও বাড়িত বেড়াবার গেইলে মানুষ কিছু না নিয়া গেইলেও চকলেট হৈলেও নিয়া যায়। এত বড় একজন মন্ত্রী আইলো, কিছুই দিলে না। কত লোক আশা করি আছিল। লোকাল ট্রেনখেন চালুর কথা কয়া গেইলেও তো হৈল হয়।’ কথাগুলো রমনা রেলস্টেশনের কলা ব্যবসায়ী আবদুল মজিদের (৫০)। গণকমিটিসহ এলাকাবাসী চিলমারী পর্যন্ত কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস চালু, বন্দর পর্যন্ত রেল সম্প্রসারণ, বর্তমান লোকালটিসহ আরও একটি লোকাল ট্রেন চালু, দেওয়ানগঞ্জ থেকে রৌমারী পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণের দাবিতে স্টেশনজুড়ে ব্যানার টাঙিয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রী এলেন আর গেলেন। স্টেশনের শেষ মাথায় গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিলেন। হাঁটতে হাঁটতেই স্মারকলিপি নিলেন। সাংবাদিকদের জানালেন, চিলমারী পর্যন্ত নয়, উলিপুর পর্যন্ত কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস আসবে। চিলমারী বন্দরে ট্রেন এলে রৌমারী-রাজীবপুরবাসীও উপকৃত হয়।

১২ নভেম্বর রেলমন্ত্রী রমনা রেলস্টেশনে আসবেন বলে এলাকাবাসীর মধ্যে সাজ সাজ রব। ভাঙা ছাদে নতুন বাঁশ কিনে দেওয়া হলো। এক দিনের জন্য পানির পাম্প কিনে বসানো হলো। রেলের পাত দিয়ে দেওয়া হলো সীমানাপ্রাচীর। মন্ত্রী আসবেন তাই শ খানেক কার-মাইক্রো আর পুলিশের গাড়ির আনাগোনা হলো। প্রিন্ট-অনলাইন আর টিভির সাংবাদিকে স্টেশন সয়লাব হলো। দলীয় নেতা–কর্মীদের স্লোগানে চারপাশ মুখর হলো। মন্ত্রী এলেন। সাংবাদিকেরা ‘কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস’–এ কুড়িগ্রামের আসন কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘কুড়িগ্রামবাসী তো ট্রেন চায়নি। এই ট্রেন রংপুর পর্যন্ত চলার কথা ছিল, আমি তা কুড়িগ্রাম পর্যন্ত করেছি।’

তাহলে গণকমিটির নেতারা রেলভবনে ‘ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস’ নামকরণের দাবিতে দেখা করলে তখন বর্তমান রেলমন্ত্রী বলেছিলেন, কুড়িগ্রামের জন্য ট্রেন, তাই কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস করা হবে। এলাকাবাসী রেলের জন্য দাবি যদি না–ই করবে, তাহলে ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর কুড়িগ্রামের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী আন্তনগরের প্রতিশ্রুতি কেন দেবেন? প্রধানমন্ত্রীর সেই দিনের সফরসঙ্গী সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ফোন দিয়ে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তো আপনাদের দাবির প্রতিশ্রুতি দিলেন।

ট্রেনের জন্য গণসমাবেশসহ এহেন কর্মসূচি নেই, যা কুড়িগ্রামে পালিত হয়নি। ট্রেনের দাবিতে লাখ লোকের গণস্বাক্ষর প্রধানমন্ত্রী বরাবর জমা দিয়েও কুড়িগ্রামবাসী ট্রেন চায়নি! গণ–উদ্যোগকে ব্যর্থ করার কী নিদান! সব তাঁরাই করেন।

৩.

নববিবাহিত তরুণ বসেছে বয়স্কদের হাসিঠাট্টার আড্ডায়। কে কী যৌতুক পেয়েছে তা নিয়ে গল্প। একজনকে জিজ্ঞাসা করা হলো, সে কী কী উপহার পেল শ্বশুরবাড়ি থেকে?

নববিবাহিত: এই দুইটা গরু।

অন্যরা বললেন, মানে?

নববিবাহিত: মানে এই দুইটা গরু আরকি।

সে আর খুলে বলে না। যখন ঠেসে ধরা হলো, তখন বলল, দুইটা গরুর একটা দিতে চেয়েছে, আরেকটা দেবে।

মানে একটাও দেয়নি। কথার প্যাঁচে মনে হবে, একটা বোধ হয় দিয়েছে আরেকটা দেবে। আসলে দেয়নি একটাও। কৌতুকটি যৌতুক নিয়ে হলেও বলতে হয়, চিলমারী-রৌমারীও পেয়েছে, তবে এই রকম পেয়েছে।

নাহিদ হাসান রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সভাপতি

[email protected]