গরু-বিতর্ক নিয়ে আরও দু-চার কথা

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

ভারতের গরু-বিতর্ক নিয়ে লেখার সময় দুটি বিষয়ে আমার আশঙ্কা ছিল। প্রথমটি আর্যাবর্তে, মানে গো-বলয়ে সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির মাথাচাড়া দেওয়া নিয়ে। আশঙ্কাটা খুবই তাড়াতাড়ি সত্য হয়ে যায়। লোকজন খামাখা খুন হয়। টেনশন বেড়ে যায়। মানুষ মানুষকে সন্দেহ করতে শুরু করে। ঘৃণাও। বহু বছরের চেনা এলাকা থেকে ঠাঁইনাড়া হয় বহু সাধারণ মানুষ। এ এক অসহ্য যন্ত্রণা।
আমাদের দেশে তো বটেই, এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার সাপটা সব সময় কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে। দরকার একটা সাপুড়ে ও তার বিন। মুহূর্তের মধ্যে কোমর থেকে টান টান হয়ে হিস হিস করতে করতে ফণা তুলে ছোবল মারবে। গরু-বিতর্কটা সেই বিনেরই কাজ করল। এই আশঙ্কাটাই প্রথম করেছিলাম।
দ্বিতীয় আশঙ্কাটা ছিল অর্থনীতিকে ঘিরে। বিজেপির ক্ষমতায়নের ফলে রাজ্যে রাজ্যে গো-হত্যা যেভাবে নিষিদ্ধ হতে থাকে এবং সেই সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার ঝাপটা শুরু হয়, তাতে আশঙ্কা হচ্ছিল, এই অশান্তির ফলে ভারতের গো-মাংস রপ্তানি না মার খায়। পৃথিবীতে ভারত থেকে গো-মাংস (‘বিফ’ বললেও অধিকাংশই অবশ্য মহিষ বা বলদের মাংস) ও গো-পণ্য রপ্তানি হয় বছরে ৩৩ হাজার কোটি টাকার। ভারতের পরেই স্থান ব্রাজিল ও অস্ট্রেলিয়ার। দ্বিতীয় আশঙ্কাটাও যদি সত্যি হয়ে ওঠে, তাহলে ব্রাজিল-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে পোয়াবারো চীনেরও। এ দুই আশঙ্কা চূড়ান্ত সত্যি হলে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা হয়তো আনন্দে দুহাত তুলে নাচবে, কিন্তু ভারতের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল একটা দেশের পক্ষে সেটা মোটেই ভালো বিজ্ঞাপন হবে না।
গরু-বিতর্কের জের ভারতকে শেষ পর্যন্ত যেখানে দাঁড় করাবে, সেটা যে দেশের পক্ষে মোটেই ভালো নয়, এটা আমার মতো অনেকে বুঝলেও দেশের প্রধানমন্ত্রী তা বুঝতে পারছেন না—এটা ভাবতেই যেন কেমন কেমন লাগছে। বিশেষ করে সেই প্রধানমন্ত্রী, দেশের শিল্পপতিরা যাঁকে কোল পেতে দিয়েছেন, যিনি উদ্যোগপতিদের চোখে ‘ডার্লিং’! আরও একটা বিষয় আমাকে অবাক করেছে। গরু-বিতর্ককে ঘিরে অসহিষ্ণুতার মাথাচাড়া দেওয়ার প্রশ্নে দেশের একশ্রেণির মানুষের বিক্ষোভ সত্ত্বেও যিনি নির্বাক থেকে গেলেন, নিন্দা তো দূরের কথা, স্পষ্ট করে একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না, সেই মানুষটি বিলেতে গিয়ে এ প্রসঙ্গে মুখ খুললেন! নরেন্দ্র মোদির এই আচরণ শুধু বিস্ময়করই নয়, দেশের মানুষের দাবির প্রতি অপমানজনকও।
যাকগে। নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা আমার এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। গো-হত্যা, অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িকতা, রেষারেষি, মারদাঙ্গার মতো বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে দেশে কেন তিনি নির্বাক এবং কেনই বা বিদেশে সবাক, তার ব্যাখ্যা আগে বিস্তারে দিয়েছি। পাঠকদের স্মৃতি উসকে দিতে অতি সংক্ষেপে তা আরও একবার বলতে হলে বলি, এর একটা কারণ দেশের নির্বাচনী রাজনীতি, অন্য কারণ তাঁর এযাবৎ লালিত বিশ্বাস ও কর্তব্যের মধ্যে সংঘাত। প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য পালন করতে গেলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের আদর্শ ও বিশ্বাসকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। ফলে সাপও মরবে, অথচ লাঠিও ভাঙবে না—এ ধরনের একটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের অবস্থান নিতে গিয়ে বিহারে তাঁদের ভরাডুবি হলো। দেশে রা না কাড়লেও বিলেতে গিয়ে তিনি সবাক হলেন কেন? কারণটা ভাবমূর্তি অটুট রাখা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের ও দেশের বহুত্ববাদী চরিত্রের প্রতি এই তঞ্চকতা দেশের গো-ভিত্তিক অর্থনীতিকে কোন অতলে ঠেলে দিয়ে কোন সংকটের জন্ম দেবে, তা তিনি বুঝেও বুঝতে চাইছেন না। দুঃখের বিষয় এটাই।
গরু-বিতর্কের রেশ দেশের গো-ভিত্তিক অর্থনীতির কী হাল করতে চলেছে, এক সর্বভারতীয় বৃহৎ ইংরেজি সংবাদপত্র সম্প্রতি তার এক চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে। সেই বিশ্লেষণ তুলে ধরার আগে পাঠককে জানিয়ে রাখি, ভারতের এতগুলো রাজ্যের কোথায় কোথায় গো-হত্যা ও গো-মাংস নিষিদ্ধ নয়, কোথায় পূর্ণ নিষিদ্ধ ও কোথায় বা আংশিক। গো-হত্যা বা গো-মাংস খাওয়ায় বিন্দুমাত্র কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই যে রাজ্যগুলোতে, সেগুলো হলো পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, গোয়া, অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, আসাম, সিকিম ও ত্রিপুরা। যে রাজ্যগুলোতে গো-হত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ সেগুলো হলো জম্মু-কাশ্মীর, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, দিল্লি, উত্তরাখন্ড, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খন্ড, মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও রাজস্থান। এর বাইরে আটটি রাজ্যে গো-হত্যা করা যেতে পারে, তবে তা নানা ধরনের শর্তভিত্তিক। যেমন: কোথাও গরু মারা যেতে পারে যদি তার শরীরে রোগ দেখা দেয়, যদি তারা কর্মক্ষম হয়ে যায়, কোথাও ১৫ বছরের বেশি বয়সী বলদ মারা যেতে পারে, কোথাও বা গবেষণার স্বার্থে গো-হত্যা করা যায়। কোথাও বা এমন নিয়ম রয়েছে, যেখানে গরু-বাছুর হত্যা নিষিদ্ধ হলেও যাদের পোষা খরচসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে অথচ যারা কোনো কাজে আসে না, তাদের কেটে মাংস খাওয়া যেতে পারে। এমন রাজ্যও রয়েছে যেমন: পাঞ্জাব, যেখানে সরকারি অনুমতি নিয়ে গো-হত্যা করা যায়। তবে তার মাংস শুধু বিদেশে রপ্তানির জন্য। কিছু রাজ্য রয়েছে, যেখানে গো-হত্যার ক্ষেত্রে সরকারি অনুমোদনের একটা শর্ত রাখা হয়েছে, অনুমোদনের যে সিলমোহর অনেক বেআইনি কাজকে আইনি করে দেওয়ার অধিকারী। এই রাষ্ট্রগুলো হলো তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব, ওডিশা, কর্ণাটক, হিমাচল প্রদেশ, বিহার, অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও উত্তর প্রদেশ।
বিজেপি দিল্লি ও অন্যান্য রাজ্য দখলের পর থেকে গো-হত্যা বন্ধে ও গো-সংরক্ষণের নামে যা চলেছে, তাতে রপ্তানির এই বিপুল বাণিজ্য ইতিমধ্যে ভয় পেতে শুরু করেছে। দেশে মোট ২৪টি ‘মিট প্রসেসিং’ কারখানা রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে ১৩টি ১০০ শতাংশ রপ্তানি করে থাকে। এগুলোর অধিকাংশই উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবে। হিন্দুত্ববাদীদের দাপাদাপিতে এই কারখানাগুলোতে সরবরাহ কমতে শুরু করেছে। ফলে কমছে মাংস রপ্তানি। মাংস রপ্তানি কমার পাশাপাশি মার খেতে শুরু করেছে চামড়াশিল্প। রয়েছে দৈনন্দিন জীবিকার প্রশ্নও। গরু মারা গেলে যারা তার ছাল ছাড়ানোর কাজ করেন অথবা গো-মাংস বিক্রির সঙ্গে জড়িত, মার খেতে শুরু করেছেন তাঁরাও। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে শুরু করেছেন সাধারণ চাষিও। যে গরু আর কাজে লাগছে না, সেগুলো রাখতে হচ্ছে, খাওয়াতে হচ্ছে। এদের বিক্রি করে আগে চাষিদের কিছুটা অর্থ সাশ্রয় হতো। একটা হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এর ফলে দেশে অকর্মণ্য ও ছেড়ে দেওয়া গরুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫৫ লাখ!
গরু, মহিষ, ভেড়া বা ছাগলের ছাল ছাড়ান যাঁরা, যাঁদের অনেকেই চামড়াশিল্পের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের সংখ্যা কমবেশি আট লাখ। এই শ্রেণির মানুষ সাধারণত মুসলমান ও দলিত হিন্দু। বংশপরম্পরায় তাঁরা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তিন দশক ধরে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের যিনি খুব কাছ থেকে দেখছেন, তিনি দিল্লি সায়েন্স ফোরামের ডি রঘুনন্দন। তাঁর কথায়, এই পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা সমাজের একেবারে দরিদ্র শ্রেণির। ক্রমবর্ধমান ভয়, হুমকি ও জবরদস্তির ফলে এঁরা যে শুধু রোজগার হারাচ্ছেন তা নয়, গরিব মানুষদের সস্তার প্রোটিন (গো-মাংস) থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এই মানুষজনের সংখ্যা কত? একটি সরকারি হিসাবও ওই সংবাদপত্রে দাখিল করা হয়েছে। ভারতের প্রায় ৫ কোটি ২০ লাখ দরিদ্র মানুষ শুধু গরু-মহিষের মাংস থেকে প্রয়োজনীয় প্রোটিন সংগ্রহ করেন। এঁদের সবাই কিন্তু মুসলমান নন। হিন্দু আছেন, খ্রিষ্টান আছেন, উপজাতি আছেন, বৌদ্ধ আছেন, আছেন সব মতাবলম্বীরাই। মিল তাঁদের এক ক্ষেত্রেই, সবাই অতিদরিদ্র। গো-বিতর্ক এঁদেরই পেটে ঘা মেরেছে সবচেয়ে বেশি।
উগ্র হিন্দুত্ববাদী, যাঁরা ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলমানকে পাকিস্তানে পাঠানোর স্বপ্ন দেখেন, যাঁরা পাকিস্তানকে দুরমুশ করার বাসনা পুষে নিত্য নিদ্রা যান, তাঁরা কিন্তু দিনে দিনে তাঁদের সেই ‘ঘোর শত্রুর’ পরম মিত্র হয়ে উঠতে চলেছেন। কেননা, তাঁদের এই গো-সংরক্ষণ ও গো-হত্যা বন্ধের হুজুগ পাকিস্তানের পৌষ মাস হয়ে উঠছে। কীভাবে? দেশজোড়া চামড়াশিল্পে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ছোট ‘ট্যানারি’গুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকেরা যাঁরা ভারতীয় চামড়ার জন্য বছরভর হাপিত্যেশ করে বসে থাকতেন, তাঁরা পাকিস্তানের দিকে তাকাতে শুরু করেছেন। কাউন্সিল ফর লেদার এক্সপোর্টের (সিএলই) চেয়ারম্যান এম রফিক আহমেদ বলেছেন, কাঁচামালের জোগান দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। তাঁর হিসাবে এখনই ১৫ শতাংশ জোগান কমে গেছে। দেশের জুতো তৈরি শিল্প এখনো আগ্রার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই শিল্প সংগঠনের প্রেসিডেন্ট পুরান দাওয়ার জানিয়েছেন, চলতি আর্থিক বছরের প্রথম তিন মাসে দেশের পূর্বাঞ্চল থেকে ‘ফিনিশড লেদার’-এর রপ্তানি সাড়ে ১৮ শতাংশ কম হয়েছে। জুতাশিল্প কমে গেছে ৭৩ শতাংশ।
আমদানিকারকেরা আর ভারতীয় বাজারের প্রতি ভরসা রাখছেন না। সিএলইর পূর্বাঞ্চলীয় চেয়ারম্যান রমেশ জুনেজা কোনো রকম ঢাকঢাক গুড়গুড় না করেই বলেছেন, ভারতের অন্যতম প্রধান রপ্তানিশিল্প আজ মনুষ্যসৃষ্ট সংকটে পড়ে খাবি খাচ্ছে। জার্মানিতে রপ্তানি কমেছে ২৪ শতাংশ, ফ্রান্সে ২০ শতাংশ। সারা দেশের মোট চামড়া রপ্তানির ৩৫ শতাংশ জোগান দেয় পশ্চিমবঙ্গ। রপ্তানির অর্ডার যে রাজ্য এক বছর আগেও ফিরিয়ে দিত, আজ সেই পশ্চিমবঙ্গ অর্ডার পেতে মরিয়া। ঔরঙ্গাবাদের চামড়া ব্যবসায়ী ফয়াজ কুরেশি জানিয়েছেন, মহারাষ্ট্রের মারাঠাওয়াড়া অঞ্চল থেকে মাসে ৮০ হাজার চামড়া আসত। আজ হিন্দুত্ববাদীদের ভয়ে তাঁরা চামড়া কেনা বন্ধ রেখেছেন, কখন কী হয় সেই আতঙ্কে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্দেশে কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আগামী পাঁচ বছরে (২০১৪-১৫ থেকে ২০১৯-২০) চামড়াশিল্পের মোট রপ্তানি দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছে। হিসাবটা হলো সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার থেকে রপ্তানি বাড়িয়ে পৌঁছাতে হবে ১৩ বিলিয়নে। গো-বিতর্কের দরুন ‘মিট প্রসেসিং’য়ের মতো এই শিল্পও আপাতত ঘোর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ২৫ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা শুধু এই চামড়াশিল্পের ওপর নির্ভরশীল। মাংস-নির্ভরতায় আরও কয়েক লাখ। এবং এসব মানুষ নিদান দেওয়া কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের মতো সমাজের উঁচুতলার বাসিন্দা নন। তাঁরা সবাই সমাজের একেবারে নিচুতলায় মাথা নিচু করে থাকেন। তাঁরা প্রান্তিক মানুষ। নুন আনতে তাঁদের পান্তা ফুরোয় প্রতিদিন।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।