গর্ভাবস্থায় করোনার টিকা নেওয়া না নেওয়া

আমাদের দেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে অচিরেই। এ কারণে গর্ভাবস্থায় করোনা ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে কি যাবে না, তা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনে অ্যাডিনো ভাইরাসের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন শরীরে প্রবেশ করানো হয়, যাতে আপনার শরীর এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে। তাহলে কীভাবে সুরক্ষা দেবে এই ভ্যাকসিন? করোনাভাইরাসের গায়ে যে স্পাইক প্রোটিন থাকে, তার মাধ্যমে সে শরীরের বিভিন্ন কোষে প্রবেশ করে। আপনার অ্যান্টিবডি এই স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে লেগে যায় এবং ভাইরাসটিকে কোষে প্রবেশ করতে দেয় না। যে অ্যাডিনো ভাইরাসের মাধ্যমে শরীরে স্পাইক প্রোটিন প্রবেশ করানো হয়, তা অক্ষম অবস্থায় থাকে। আপনার শরীরে কোনো উপসর্গই প্রকাশ পাবে না। এদের রেপ্লিকেশন অর্থাৎ একটা ভাইরাস থেকে একাধিক ভাইরাস হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া হয় বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে। সুতরাং করোনা ভ্যাকসিন যদি গর্ভবতী মা বা শিশুকে বুকের দুধ পান করান এমন মায়েরা গ্রহণ করেন, তাহলে তাত্ত্বিকভাবে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না এবং এই পর্যন্ত যাঁরা জেনে না-জেনে টিকাটি গ্রহণ করেছেন, তাঁদের কোনো বড় সমস্যা দেখা দেয়নি।

তবু আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, এটি মায়ের পেটে বেড়ে ওঠা আদরের সন্তানের নিরাপত্তার বিষয়। এখন পর্যন্ত যে উপাত্ত পাওয়া গেছে, তাতে গর্ভাবস্থায় ভ্যাকসিনের সরাসরি কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। যদিও এখানে একটি ‘কিন্তু’ আছে। করোনা ভ্যাকসিন যে গর্ভবতী মা এবং বাচ্চার জন্য ক্ষতিকারক নয়, এটি এখনো সর্বসম্মতভাবে প্রমাণিত হয়নি। কারণ, এটি একটি লম্বা সময়ের গবেষণার বিষয়। করোনা মহামারিতে বিশ্বব্যাপী যা অবস্থা, তাতে এখন অত লম্বা সময়ের গবেষণার সুযোগ নেই। সে জন্য গর্ভাবস্থায় অক্সফোর্ডের টিকা দেওয়ার জন্য বলা হয় না। কিন্তু সব ক্ষেত্রে এই বিধিনিষেধ নেই।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে যেটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়, সেটি হলো যে ওষুধ/টিকা দেওয়া হবে, তা কি উপকার বেশি করবে নাকি ক্ষতি বেশি করবে। তাহলে দেখা যাক কোন কোন ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে।

১. যদি গর্ভবতী মায়ের কিডনি বা অন্য কোনো অঙ্গ (যেমন লিভার বা যকৃৎ) ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়ে থাকে, তাহলে তাঁদের ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে। কারণ, এই রোগীদের স্টেরয়েড দিয়ে তাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দাবিয়ে রাখা হয়। ফলে তাঁরা সহজেই করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন।
২. যাঁদের খুব বেশি অ্যাজমার সমস্যা আছে, তাঁদের জন্য ভ্যাকসিন নেওয়া অবশ্য কর্তব্য।
৩. সিকেল সেল অ্যানিমিয়া একধরনের রক্ত রোগ। এই রোগ যাঁর আছে তিনি গর্ভাবস্থায় থাকলে তাঁকে ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে।
৪। অন্য কোনো রোগের জন্য যদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দাবিয়ে রাখা হয়, সে ক্ষেত্রেও ভ্যাকসিন দেওয়াই সঠিক হবে।
৫. যদি গর্ভবতী মায়ের ক্রনিক কিডনি ডিজিজ থাকে বা তাঁর কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হয়, তাহলে তাঁর জন্য ভ্যাকসিন নেওয়া জরুরি।

এ ছাড়া যেসব গর্ভবতী মা সম্মুখসারির যোদ্ধা যেমন ডাক্তার, নার্স বা যেকোনো স্বাস্থ্যকর্মী, তাঁরা এই টিকা নেওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন। কার জন্য কোন চিকিৎসা প্রয়োজন বা কাকে টিকা দেওয়া যাবে, তার জন্য প্রত্যেককে আলাদা আলাদাভাবে বিচার করতে হবে। আর যেসব মা তাঁদের বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, তাঁদের টিকা নিলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু টিকা দেওয়ার ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি করা যাবে না। এটা মেডিকেল এথিক্সে পড়ে না। তবে স্বাস্থ্যকর্মীদের অবশ্যই টিকা নেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক চিন্তা করা উচিত।
মোটকথা, যাঁদের করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তাঁদের এই টিকা নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকাটা জরুরি। তবে অবশ্যই এ ব্যাপারে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে হবে। আপনার সব মেডিকেল রিপোর্ট, কোনো রোগে ভুগছেন কি না, সামগ্রিক শারীরিক অবস্থা, কোন ওষুধ খাচ্ছেন ইত্যাদি ডাক্তারকে জানালে তিনি সঠিক উপদেশ দিতে পারবেন।

আরেটা গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, যাঁরা বাচ্চা নেওয়ার কথা ভাবছেন, তাঁরা কিন্তু গর্ভধারণ নিয়ে ভয় পাবেন না। যাঁরা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও একই কথা। বাচ্চার জন্য মায়ের দুধের উপকারিতার কথা চিন্তা করুন এবং সঙ্গে সঙ্গে করোনাভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির কথাও চিন্তা করুন। সিদ্ধান্ত নিন। টিকা নিয়ে বুকের দুধ খাওয়ালে বাচ্চার ক্ষতি হবে, এ রকম তেমন কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। তেমনি করোনার টিকা পেটের বাচ্চার জন্য নিরাপদ কি না, এটারও পর্যাপ্ত তথ্য নেই।

তবে সব সময় দেখতে হবে লাভের পরিমাণ বেশি নাকি ক্ষতির পরিমাণ বেশি। সেই দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।


ড. মোরতায়েজ আমিন বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের ন্যাশনাল হেলথ কেয়ার নেটওয়ার্কের পরামর্শক।