গাছ লাগানো সদকায়ে জারিয়া

আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে খলিফা হিসেবে পাঠানোর জন্য মানব তৈরি করলেন। আর তার আগেই পৃথিবীকে সাজালেন মানব বসবাসের উপযোগী করে। মানুষের জীবনধারণের জন্য মাটি, পানি, অগ্নি, বায়ু এবং জড়-জীব, উদ্ভিদ, গুল্ম-লতা, গাছগাছালি, বৃক্ষরাজি, ফুল- ফলমূল ইত্যাদি। জীব ও জীবনের জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। প্রাণ ও প্রাণীর জীবন সম্পূর্ণ নির্ভর করে উদ্ভিদের ওপর। উদ্ভিদই আমাদের অতিপ্রয়োজনীয় জীবনের উপাদান অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং মানবদেহ থেকে নিঃসরিত ক্ষতিকর কার্বন ডাই–অক্সাইড শোষণ করে আমাদের পরিবেশকে দূষণমুক্ত ও বাসযোগ্য রাখে।

মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার সব উপাদানই আসে উদ্ভিদ থেকে। আমিষের উপকরণ পশুপাখিও উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। নবীজি (সা.) বৃক্ষরাজি খুবই ভালোবাসতেন। মহানবী (সা.) নিজ হাতে গাছ লাগিয়েছেন এবং গাছ লাগানোর জন্য অন্যদের উৎসাহিত করেছেন। রাসুল (সা.)-এর সাহাবিরাও গাছ লাগাতেন। বর্তমান পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রতিরোধে তথা মানবসভ্যতার সুরক্ষার জন্য মহানবী (সা.)–এর মহান সুন্নাত বৃক্ষরোপণ অতীব প্রয়োজন।

কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি ও তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে সর্বপ্রকার নয়নাভিরাম উদ্ভিদ উদ্‌গত করেছি, অনুরাগী সকল বান্দার জন্য জ্ঞানও উদাহরণস্বরূপ। আর আমি আকাশ থেকে কল্যাণকর বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং এর দ্বারা উদ্যান ও পরিপক্ব শস্যরাজি উদ্‌গত করি, যেগুলোর ফসল আহরণ করা হয়। আছে সমুন্নত খেজুরগাছ যাতে রয়েছে কঁাদি কাঁদি খেজুর, বান্দাদের জন্য রিজিক। বৃষ্টির পানি দ্বারা মৃত ভূমিকে জীবিত করি অনুরূপই পুনরুত্থান।’ (সুরা-৫০ কাফ, আয়াত: ৭-১১)। ‘তিনি তোমাদের জন্য তা দিয়ে জন্মান শস্য, জয়তুন, খেজুরগাছ, আঙুর ও সব ধরনের ফল। অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’ (সুরা-১৬ নাহল, আয়াত: ১১)। ‘তারা কি লক্ষ করে না, আমি ঊষর ভূমির ওপর পানি প্রবাহিত করে তার মাধ্যমে উদ্‌গত করি শস্য, যা থেকে তাদের গবাদিপশু এবং তারা নিজেরা আহার গ্রহণ করে।’ (সুরা-৩২ সাজদা, আয়াত: ২৭)।

বৃক্ষরোপণের ওপর গুরুত্বারোপ করে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যদি কোনো মুসলমান একটি বৃক্ষ রোপণ করে অথবা কোনো শস্য উৎপাদন করে এবং তা থেকে কোনো মানুষ কিংবা পাখি অথবা পশু ভক্ষণ করে, তবে তা উৎপাদনকারীর জন্য সদকাস্বরূপ গণ্য হবে।’ (বুখারি: ২৩২০, মুসলিম: ১৫৬৩)।

অন্য হাদিসে রয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বৃক্ষরোপণ করে তা ফলবান হওয়া পর্যন্ত তার পরিচর্যা ও সংরক্ষণে ধৈর্য ধারণ করে, তার প্রতিটি ফল যদি নষ্টও হয়, তার বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা তাকে সদকার নেকি দেবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ: ১৬৭০২)। হাদিসে আরও বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষ রোপণ করে, আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তাকে ওই বৃক্ষের ফলের সমপরিমাণ প্রতিদান দেবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ: ২৩৫৬৭)।

হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে।’ (বুখারি, আদাবুল মুফরাদ: ৪৭৯; মুসনাদে আহমাদ: ৩/ ১৮৩)। আরও ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামত এসে গেছে, এমন অবস্থায় তোমাদের কারও হাতে যদি ছোট একটি খেজুরের চারা থাকে, তাহলে সে যেন চারাটি রোপণ করে দেয়।’ (মুসনাদে আহমাদ: ১২৯০২ ও ১২৯৮১; আদাবুল মুফরাদ: ৪৭৯; মুসনাদে বাজজার: ৭৪০৮)।

বৃক্ষরোপণ, পরিচর্যাকরণ ও সংরক্ষণ সবারই দায়িত্ব। বৃক্ষ সংরক্ষণের নির্দেশ ও নিধনে হুঁশিয়ারি দিয়ে নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে, আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন।’ (আবু দাউদ: ৫২৪১, বায়হাকী: ৬/১৪০।

গাছ লাগানো সদকায়ে জারিয়া। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো মুসলিম গাছ লাগায় অথবা কোনো ফসল বোনে আর মানুষ ও পশুপাখি তা থেকে খায়, এটা রোপণকারীর জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হয়।’ (বুখারি: ২৩২০)। যত দিন পর্যন্ত রোপণকৃত গাছটি জীবিত থাকবে ঠিক তত দিন যত প্রাণী, পশুপাখি ও মানুষ সে গাছ থেকে ফুল, ফল ও ছায়া অর্থাৎ যেকোনো উপকার পাবে, তা রোপণকারীর আমলনামায় সদকায়ে জারিয়া হিসেবে লেখা হবে। রোপণকারী ব্যক্তি যদি মারাও যান তাহলে তাঁর আমলনামায় এ সওয়াব পৌঁছাতে থাকবে। যদি না জানিয়ে গাছ থেকে কোনো ফল খায় বা নিয়ে যায় তাতেও রোপণকারীর আমলনামায় সওয়াব পৌঁছে যাবে।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব

[email protected]