গাজা থেকে মিসর, খরুচে ও অপমানের যাত্রাপথ

গাজা থেকে কায়রো যাওয়ার পথে রাফা সীমান্তচৌকি
ছবি : রয়টার্স

গাজার বাসিন্দা মোস্তফা আল-সাওয়াফ সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা পোস্ট দেন। তাঁর পোস্টটা ছিল অবরুদ্ধ গাজা থেকে রাফা হয়ে কায়রোর পথে যাত্রা বিষয়ে। এ যাত্রাপথে সীমাহীন দুর্ভোগ এবং ভ্রমণ কোম্পানিগুলোর মুনাফার বলি হতে হয় গাজাবাসীকে। সাওয়াফ তাঁর পোস্টে এ যাত্রাপথকে ‘অপমানের যাত্রা’ বলে সমালোচনা করেন। এই পোস্ট দেওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে তাঁর টেলিফোনে একটি কল আসে। হামাসের পরিচয় দিয়ে টেলিফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি তাঁকে পোস্টটি মুছে দিতে বলেন। সাওয়াফকে তিনি বলেন, ‘সীমান্ত ব্যবসা মিসরের জন্য খুব সংবেদনশীল একটা বিষয়। আপনার পোস্টটি ফিলিস্তিনিদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।’

সাওয়াফ খুব দ্রুত পোস্টটি মুছে দেন। কিন্তু এরই মধ্যে পোস্টটিতে অনেকে মন্তব্য করে বসেন। সেসব মন্তব্যে গাজাবাসীর হতাশার প্রতিফলন ঘটেছে। গাজা থেকে রাফা হয়ে কায়রো—বাইরের বিশ্বের সঙ্গে গাজার বাসিন্দাদের যোগাযোগের প্রধান পথ এটি। এ পথের দৈর্ঘ্য ৩৮০ কিলোমিটার। যাত্রাপথে সিনাই উপদ্বীপের মরুভূমি পার হতে হয়, ইসলামিক স্টেটের জিহাদিদের সঙ্গে মিসরীয় বাহিনীর সংঘাত সেখানে চলছে। কিছু দূর পরপর তল্লাশিচৌকির পাশাপাশি রাতের বেলায় সেখানে কারফিউ জারি থাকে। এ যাত্রাপথে সুয়েজ খালও পার হতে হয়।

মরুভূমির তীব্র গরমে জনাকীর্ণ বাসে দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয় যাত্রীদের। দুর্বিষহ এ যাত্রাপথ অত্যন্ত কষ্টকর। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো ভিআইপি সেবা চালু করেছে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এ রকম একটা ট্রাভেল এজেন্সির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা এএফপিকে বলেন, ‘এটা ফিলিস্তিনিদের জন্য একটা বিপর্যয়। প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ৭৫ হাজার ডলারের ব্যবসা হয়। মিসরীয়রা নিত্যনতুন চাপ তৈরি করে। গাজা থেকে বাইরে যাওয়া-আসা করা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। এর ফলে তারা ব্যয়বহুল ভিআইপি সেবা নিতে বাধ্য হন।’

২০ লাখ জনগোষ্ঠীর গাজা একটি দারিদ্র্যপীড়িত ভূখণ্ড। গত মে মাসে হামাস সেখানে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। গাজায় যাওয়া কিংবা সেখান থেকে ফিরে আসা বেশ কঠিন। ইসরায়েল মাঝেমধ্যেই গাজার ভূখণ্ড দখল করে। গাজায় যাওয়া-আসার স্থল ও জলপথের ওপর তারা কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। ২০০০-০৫ সাল পর্যন্ত চলা ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তেফাদার সময়ে ইসরায়েল ইয়াসির আরাফাত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বোমা হামলা চালিয়ে সেটি ধ্বংস করে দিয়েছিল। সেখানকার রানওয়েতে এখন গবাদিপশু চড়ে। ভূমধ্যসাগরের তীরে গাজার বন্দরে কোনো যাত্রীবাহী ফেরি ভিড়তে দেয় না ইসরায়েল।

এর ফলে গাজার বাসিন্দাদের বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের মাত্র দুটি পথ খোলা রয়েছে। ইসরায়েল কিংবা মিসরের ভূমি ব্যবহার করে তারা বাইরে যেতে পারে। কিছু ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েলের ভেতরে ব্যবসা ও কাজের অনুমতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে কাউকে কাউকে জর্ডান যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। ইসরায়েলের এই কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে গাজাবাসীর জন্য রাফা হয়ে কায়রোর পথটিতে যাতায়াত করা সুবিধাজনক। কিন্তু খরচ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এ পথের কুখ্যাতি রয়েছে। ভ্রমণের কয়েক সপ্তাহ আগে ফিলিস্তিনিদের নিবন্ধন করতে বাধ্য করা হয়। এরপরও ভ্রমণের অনুমতি মিলবে কি না, সেটা নিশ্চিত নয়।

মরুভূমির তীব্র গরমে জনাকীর্ণ বাসে দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয় যাত্রীদের। দুর্বিষহ এ যাত্রাপথ অত্যন্ত কষ্টকর। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো ভিআইপি সেবা চালু করেছে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এ রকম একটা ট্রাভেল এজেন্সির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা এএফপিকে বলেন, ‘এটা ফিলিস্তিনিদের জন্য একটা বিপর্যয়। প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ৭৫ হাজার ডলারের ব্যবসা হয়। মিসরীয়রা নিত্যনতুন চাপ তৈরি করে। গাজা থেকে বাইরে যাওয়া-আসা করা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। এর ফলে তারা ব্যয়বহুল ভিআইপি সেবা নিতে বাধ্য হন।’

ভ্রমণের নিশ্চয়তা পাওয়ার জন্য প্রাইভেট কোম্পানি কিংবা মধ্যস্বত্বভোগীদের দ্বারস্থ হতে হয়। তারা যে ভিআইপি সেবা চালু করেছে, সেটা নিতে হলে শত শত ডলার খরচ করতে হয়। গাজায় হামাস শাসন শুরুর পর খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য রাফার এই পথে চলাচল ছিল সহজতর। সেটা ২০১৩ সালের ঘটনা। মিসরের ক্ষমতায় তখন ছিলেন মোহম্মদ মুরসি। মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যরা হামাসের প্রতি কিছুটা উদার ছিলেন। সে সময়ে পাঁচ লাখের মতো ফিলিস্তিনি রাফা পাড়ি দিয়েছিল। যেটা ছিল রেকর্ড। কিন্তু ওই বছরের জুলাই মাসে মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির পর এ সংখ্যা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেতে শুরু করে। মিসরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির আমলে রাফা কিছুদিনের জন্য খোলা ও কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়। হামাসের কাছ থেকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কৌশল হিসেবেই এটা করা হচ্ছে।

রাফা সীমান্ত ব্যবহার করে সাম্প্রতিক কালে মিসর থেকে গাজায় এসেছেন, এমন কয়েকজনের সঙ্গে এএফপির কথা হয়ে। নাম প্রকাশ করা হলে ভবিষ্যৎ ভ্রমণের জন্য মিসরীয় কর্তৃপক্ষ তাঁদের কালো তালিকাভুক্ত করতে পারে, সে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তাঁরা। আহমেদ (ছদ্মনাম) নামের একজন এ বছরের প্রথম দিকে কায়রো থেকে গাজায় ফেরেন। এ যাত্রাপথের যে দূরত্ব, তাতে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু চার দিনের আগে তিনি গাজায় পৌঁছাতে পারেননি। প্রথমে তিনি একটা ট্যাক্সি ভাড়া করেন। বুধবার ভোর চারটায় তাঁর যাত্রা শুরু হয়। চালকের সঙ্গে রাফা পর্যন্ত যেতে ১৩০ ডলারের চুক্তি হয়। সুয়েজ খালের প্রবেশমুখে তাঁদের গাড়িটি থেমে যায়। সে সময় সেখানে যানবাহন পারাপার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আহমেদ তাঁর ভাড়া করা গাড়িটা সেখানে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। আরও পাঁচজন যাত্রীর সঙ্গে ভাগাভাগি করে একটা গাড়িতে রাত যাপন করেন।

আহমেদ বলেন, ‘তল্লাশিচৌকিতে মিসরীয়রা আমার সমস্ত ব্যাগ খুলে ফেলে। তারা আমার সুগন্ধি ও সিগারেট বাজেয়াপ্ত করে। আমার ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ প্রোফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করে।’ এরপরের তিনটি তল্লাশিচৌকি খুব সহজেই তিনি পার হতে পারেন। রাফা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে সিনাই তল্লাশিচৌকিতে তিনি পৌঁছান বৃহস্পতিবার বিকেলে। এ সময় রাস্তা বন্ধ বলে ঘোষণা দেয় মিসরীয় কর্তৃপক্ষ। রাস্তা খুলে দেওয়ার আগপর্যন্ত পার্শ্ববর্তী আল-আরিশ শহরে একটা নোংরা-ঘিঞ্জি ঘরে তাঁকে দুই দিন অবস্থান করতে হয়। রাস্তা খুলে দেওয়ার কথা শুনে তড়িঘড়ি করে তল্লাশিচৌকিতে পৌঁছালে সেদিনের মতো আবার সেটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরদিন সকাল পর্যন্ত তাঁকে ওই রাস্তাতেই থাকতে হয়।

আহমেদের মতো অসংখ্য ফিলিস্তিনিকে রাফা-কায়রোর রাস্তায় একই দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। এ যাত্রাপথের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় সিনাইয়ে। আইএস জিহাদিদের সঙ্গে মিসরীয় বাহিনীর যুদ্ধ চলায় সেখানকার নিরাপত্তাব্যবস্থা অনেক বেশি জটিল। ফাতিমা (ছদ্মনাম) নামের এক নারী জানান, গত বছর আরও কয়েকজন নারীর সঙ্গে তিনি কায়রো থেকে গাজায় ফিরছিলেন। সিনাইয়ের তল্লাশিচৌকিতে শীতের রাতেও ভয়ে তিনি ঘামছিলেন। একটা কার্ডবোর্ডের বাক্সের মধ্যে জড়সড় হয়ে তাঁকে রাত পার করতে হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা একটা মরুভূমিতে। আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম। সেখানে একফোঁটা খাওয়ার পানি ছিল না। কোনো টয়লেটও ছিল না। খুব কাছেই গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।’

সীমাহীন দুর্ভোগের এই যাত্রা ফিলিস্তিনিদের জন্য ভয়ানক অপমানকর। আহমেদ বলেন, ‘এটা আমাকে ভেতর থেকে মেরে ফেলেছে। গাজার অধিবাসীদের সঙ্গে ভয়ংকর খারাপ আচরণ করা হয়। যেন আমরা সবাই সন্ত্রাসী।’ গাজায় ফিরে তাঁর হতাশা চরমে পৌঁছায়। তিনি জানতে পারেন, যাঁরা ভিআইপি সেবার জন্য বাড়তি টাকা খরচ করেন, তাঁরা মাত্র এক দিনেই কায়রো থেকে গাজায় আসতে পারেন।

নিবন্ধন, গাড়িভাড়া, কাগজপত্র ঠিক করাসহ কায়রো যাওয়ার জন্য ভ্রমণ কোম্পানি এক হাজার ডলার করে নেয়। ফেরার জন্য গুনতে হয় আরও ৬০০ ডলার। বেশির ভাগ গাজাবাসীর জন্য এ খরচ জোগাড় করা অসম্ভব। মিসরীয় মালিকানাধীন একটি কোম্পানি এ ব্যবসা পরিচালনা করে। ফিলিস্তিনি অর্থনীতিবিদ ওমর শাবান বলেন, চলাচলের জন্য গাজাবাসীদের বড় অঙ্কের টাকা গুনতে বাধ্য করানো মিসরের জন্য বাজে একটা কৌশল। সীমান্ত ব্যবসা তাদের টাকা বানানোর একটা বড় ক্ষেত্র।

এএফপি থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
গিওম ল্যাভালি এএফপির জেরুজালেমের ব্যুরো প্রধান